সাত গম্বুজ মসজিদ: ঢাকার বুকে জেগে থাকা মুঘল স্মৃতিচিহ্ন
ঢাকা যখন বাংলার রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি পায় তার অব্যবহিত পরই এ অঞ্চলের দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করে। রাজধানীর জৌলুসের সাথে পাল্লা দিয়ে নগরী সুশোভিত হয় নানান অবকাঠামোয়। শুরু হয় ইমারত নির্মাণের হিড়িক। মুঘল আমলের এসব ইমারতের ভিড়ে মুসলিম অধ্যুষিত ঢাকায় তাই নান্দনিক উপায়ে তৈরি হতে থাকে ছোটবড় সব মসজিদ। বলাই বাহুল্য যুগের চাহিদার সাথে নতুন রাজধানীর স্থাপত্যরীতিতে সিংহভাগই প্রতিফলন ঘটে মুঘল শিল্পকলার। ঢাকা শহরের মোহাম্মদপুর এলাকায় এমনিভাবে মুঘল স্মৃতি বহন করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো সাত গম্বুজ মসজিদ। লোকে যেটিকে আরো বলত তাজমহল মসজিদ। আজকের নিবেদন এই ঐতিহাসিক মসজিদ নিয়ে।
ইতিহাসঃ
সাত গম্বুজ মসজিদের নির্মাণকাল সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া গেলেও ধারণা করা হয় ১৬৮০ সালের দিকে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। শায়েস্তা খানের দরবেশ পুত্র উমিদ খান এ মসজিদ নির্মাণ করেন। চারটি মিনারসহ ছোটবড় সাতটি গম্বুজ থাকার কারণে এ স্থাপনা সাত গম্বুজ মসজিদ নামে পরিচিতি পায়। দূর থেকে দেখতে তাজমহলের মত মনে হত বলে একে তাজমহল মসজিদও বলা হত।১৮১৪ সালে স্যার চার্লস ডি ওয়াইলির আঁকা সাত গম্বুজ মসজিদের একটি চিত্রে দেখা যায় ঢাকার অন্যতম এ অভিজাত মসজিদের পাশেই বইছে নদী, নদীটি যে বুড়িগঙ্গা তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। মসজিদটির বর্তমান অবস্থানের দিকে তাকালে মনেই হবেনা এর পাশ দিয়ে বয়ে যেত হারিয়ে যাওয়া ঢাকাই রমণী বুড়িগঙ্গা। এই মসজিদের প্রান্তেই ভিড় করত ছোটবড় সব নৌকা, রেলিং ঘেঁষে মানুষ বড়শি দিয়ে মাছ ধরত। দূর দূরান্ত থেকে নৌকাযোগে নামাজ আদায়ের জন্য মুসুল্লিরা সাত গম্বুজ মসজিদে জড়ো হত, এক অন্যরকম চাকচিক্য শুধু ইতিহাস হয়ে গেঁথে আছে এ মসজিদের পরতে পরতে। তখনকার সময়ে এ মসজিদই ছিল ঢাকার অন্যতম উঁচু স্থাপনা, দূর থেকে এর গম্বুজগুলি সহজেই দৃষ্টিগোচর হত। ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাংলার বাখরগঞ্জের (বরিশাল-পটুয়াখালী) সার্জন হয়ে এসেছিলেন জেমস এটকিনসন নামের এক ভদ্রলোক। তার ‘এন্টিকুইটিজ অফ ঢাকা’ তে সাত গম্বুজ মসজিদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে যে কথার অবতারণ করেছিলেন তিনি তা এই যাদুর শহর ঢাকার জন্য একরাশ আফসোসই নিয়ে আসে শুধু।
“ঢাকার মোহাম্মদপুর নামক জায়গায় একটি মসজিদ রয়েছে। এই মসজিদের দিকে তাকালে আমার ভেনিসের কথা মনে পড়ে যায়। যেন মনে হয় হুট করে নদীর বুক থেকে জেগে উঠেছে এক অনন্য স্থাপনা”
১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এ মসজিদের পাশ দিয়ে বুড়িগঙ্গা প্রবাহমান ছিল। ধীরে ধীরে নগরায়নের করাল গ্রাসের সাথে পাল্লা দিয়ে মসজিদও হারায় তার আভিজাত্য, উবে যায় তার পাশ থেকে বয়ে যাওয়া নদী বুড়িগঙ্গা।
গঠনশৈলীঃ
অপরাপর মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে গড়ে উঠেছিল সাত গম্বুজ মসজিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মুসা খান মসজিদ এবং খাজা শাহবাজ মসজিদের সমসাময়িক হওয়ায় প্রায় একই নির্মাণশৈলী অনুসরণ করা হয়েছে এ স্থাপনায়। তবে বৈশিষ্টগত দিক দিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা হওয়ার কারণে এ মসজিদের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব অনেক। বড় তিনটি গম্বুজের সাথে চারটি অনু গম্বুজ থাকার কারণে সাত গম্বুজ মসজিদ এ জায়গায় তার নিজস্ব স্বকীয়তা সৃষ্টি করেছে। দৈর্ঘ্যে আয়তাকার নামাজ কোঠার পরিমাণ ১৭.৬৮ এবং প্রস্থে ৮.২৩ মিটার। এর পুবদিকে রয়েছে ভাঁজবিশিষ্ট তিনটি খিলান এবং পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মেহরাব। মসজিদের পূর্বপাশে বেনামি এক সমাধি এনে দিয়েছে মসজিদের এক অন্যরকম আবেদন। কিংবদন্তী বলছে, বিবির মাজার নামে এ সমাধিতে ঘুমিয়ে আছেন শায়েস্তা খানের মেয়ে। পুরো মসজিদটি এবং মসজিদ সংশ্লিষ্ট এলাকা বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
যেভাবে যাবেনঃ
ঢাকার যেকোন জায়গা থেকে সাত গম্বুজ মসজিদে আসতে চাইলে আপনাকে আসতে হবে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে বাঁশবাড়ি হয়ে শিয়া মসজিদের দিকে যে রাস্তা চলে গেছে সেদিকে হাটা ধরলেই রাস্তার বাঁ পাশেই দৃষ্টিগোচর হবে প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো পাথুরে সাত গম্বুজ মসজিদ।
এই সিরিজের আরেকটি লেখাঃ
buy generic lamisil online – fulvicin where to buy buy grifulvin v medication