ঢাকা যখন বাংলার রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি পায় তার অব্যবহিত পরই এ অঞ্চলের দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করে। রাজধানীর জৌলুসের সাথে পাল্লা দিয়ে নগরী সুশোভিত হয় নানান অবকাঠামোয়। শুরু হয় ইমারত নির্মাণের হিড়িক। মুঘল আমলের এসব ইমারতের ভিড়ে মুসলিম অধ্যুষিত ঢাকায় তাই নান্দনিক উপায়ে তৈরি হতে থাকে ছোটবড় সব মসজিদ। বলাই বাহুল্য যুগের চাহিদার সাথে নতুন রাজধানীর স্থাপত্যরীতিতে সিংহভাগই প্রতিফলন ঘটে মুঘল শিল্পকলার। ঢাকা শহরের রমনা এলাকায় বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোলঘেষে এমনিভাবে মুঘল স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো খাজা শাহবাজ মসজিদ। লোকে যাকে আরো বলে জোড়া মসজিদ বা লাল মসজিদ। আজকের নৈবেদ্য তাই সেই ঐতিহাসিক মসজিদকে ঘিরে।

Source : Wikimedia Commons
ইতিহাস
১৬৭৯ সালে যখন এ মসজিদ নির্মাণ করা হয় তখন বাংলার সুবাদার শাহজাদা মুহাম্মদ আজম। মুনতাসির মামুন তার ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগর বইতে এ মসজিদের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, কাশ্মীর অধিবাসী খাজা শাহবাজ নামের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বাংলায় আসলে রমনা অঞ্চলে তিনি এ মসজিদ নির্মাণ করেন। খাজা শাহবাজ, মসজিদ নির্মাণের পাশাপাশি তার জীবদ্দশায় পুবদিকে একটি মাজারও নির্মাণ করে যান। এজন্য মসজিদটি জোড়া মসজিদ নামেও পরিচয় পায়। কিংবদন্তি বলছে খাজা শাহবাজ যখন টঙ্গী থেকে এখানে এসে নামাজ আদায় করতে আসতেন তখন তার সাথে অনেক জ্বিনও নামাজ পড়ত। এজন্য এ মসজিদকে জ্বিনের মসজিদ নামেও নামাঙ্কিত করা হয়। শাহবাজের মৃত্যুর পর তাকে নির্ধারিত মাজারেই কবরস্থ করা হয়। তার এ মাজার খাজা শাহবাজের দরগা নামেই পরিচিত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষ করে মহিলারা প্রতিদিন তার মাজারে এসে ভিড় জমায়।মাজারের খাদেমের ভাষ্যমতে, এদের মধ্যে বেশিরভাগই আসে জ্বিনের আছর থেকে মুক্ত হতে। লোকশ্রুতি আছে, জ্বিনে ধরা কেউ এ মসজিদের আঙিনায় এলেই নাকি সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়।

গঠনশৈলী
খাজা শাহবাজ মসজিদের প্রবেশমুখেই প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের একটি সাইনবোর্ডে কিছু নির্দেশিকা ঝুলানো আছে। নির্দেশনায় একে সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ আখ্যা দিয়ে এর কোন অংশের ধ্বংস বা ক্ষতিসাধন করতে নিষেধ করা হয়েছে। অনেকটা উত্তর ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর অনুসরণে নির্মিত এ মসজিদের দেয়ালে পাথরের গাঁথুনি দেওয়া হয়েছে যাতে করে এ অঞ্চলের আর্দ্রতার সাথে পাল্লা দিয়ে মসজিদের স্থায়িত্ব নিশ্চিত হয়। মসজিদটিতে তিনটি গম্বুজ রয়েছে।

৬৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২৬ ফুট চওড়া এ স্থাপত্য প্রথমে লাল বর্ণের হলেও রঙ এর গাঢ়ত্ব এখন প্রায় ম্রিয়মাণ। মসজিদের প্রতিটি চৌকাঠ কালো পাথরের তৈরি, ভেতরে রয়েছে চমৎকার তিনটি মেহরাব। ১৬২৭ সালে সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক নির্মিত দুর্গ দিওয়ান ই আমের সাথে জোড়া মসজিদের অল্পবিস্তর সাদৃশ্য পাওয়া যায়। কার্জন হলে বার ভুঁইয়াদের দ্বারা নির্মিত মুসা খান মসজিদও একই স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠেছিল।

Source : Wikimedia commons
যেভাবে যাবেন
হাইকোর্ট এলাকার পশ্চিম পাশে অবস্থিত খাজা শাহবাজ মসজিদের পূর্ব পাশেই দেখা মিলবে তিন নেতার সমাধি কমপ্লেক্স। তিন নেতার মাজার সংশ্লিষ্ট দোয়েল চত্বর মুখী রাস্তার দুই ধারে রয়েছে ঐতিহাসিক ঢাকা গেট বা মীর জুমলা গেট। উৎসুক পর্যটক কিংবা ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব প্রেমীরা চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো এ মসজিদ, সাথে করে উপরি পাওনা হিসেবে সাক্ষী হয়ে যেতে পারবেন টিএসসিতে গ্রিকদের শেষ স্মৃতিচিহ্ন, মীর জুমলা গেট, তিন নেতার মাজার এবং কার্জন হলের মুসা খান মসজিদ। এজন্য আপনাকে প্রথমেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি হয়ে দোয়েল চত্বরগামী রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে হবে। টিএসসির ভেতরে গ্রিক সমাধি দর্শনের পর দোয়েল চত্বর হয়ে হাটলেই চোখে পড়বে তিন নেতার মাজারের আঁকাবাঁকা সমাধি, আর তার পিছনেই পাথুরে হলুদ বর্ণের খাজা শাহবাজ মসজিদ।