চীন,বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি,২০১৩ সালে একটি পরিকল্পনার ঘোষণা দেয়। পরিকল্পনাটির নাম দেওয়া হয় “এক অঞ্চল, এক পথ”। ঘোষণা হওয়ার পরই বিশ্ব রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে বিষয়। শুরু হয় পক্ষে বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা।অন্যান্য পরাশক্তিগুলোও বিষয়টি নিয়ে বিশদ গবেষণা শুরু করে। ইতিমধ্যেই এটিকে শতাব্দীর সেরা পরিকল্পনাও ঘোষণা করা হয়।
পূর্ব ইতিহাসঃ
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকেই চীন থেকে রপ্তাণিযোগ্য পণ্য ইউরোপ ও আফ্রিকাতে প্রেরণ হত। পণ্যগুলোর মধ্যে সিল্ক বা রেশম ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। তাই এটি “সিল্করোড” হিসেবেও পরিচিত। পরবর্তীতে সমুদ্র পথে জাহাজ প্রচলনের পর নৌ-পথেও পণ্য পরিবহন হত।চীন বর্তমানে এই দুটি পথই সম্প্রসারণ করে, অর্থনৈতিক যোগাযোগকে সমৃদ্ধ করতে চাচ্ছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং এই প্রকল্পের মূল নায়ক।

এক অঞ্চল, এক পথ কি?
চীন থেকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক পণ্য যে পথে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আফ্রিকাতে পরিবহন হয় উক্ত রোড সমূহকে একসাথে সংযুক্ত করে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি করার জন্য প্রকল্পটিই এক অঞ্চল, এক পথ প্রকল্প। ইংরেজিতে বলা হয় “One Belt, One Road” সংক্ষেপে OBOR। যার মধ্যে রয়েছে সড়ক ও নৌ-পথ,রেলপথ ইত্যাদি। হাজার ডলারের এই বৃহৎ প্রকল্পটিতে ৫০ টিরও বেশি দেশ সংযুক্ত হবে। প্রকল্পটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে রয়েছে সড়ক পথ, দ্বিতীয়ভাগে রয়েছে নৌ-পথ; সড়ক পথ মূলত রেললাইন প্রকল্প ও হাইওয়ে রোড (গ্যাস লাইন ও তেলের পাইপ লাইন)।
প্রকল্পটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ
গণচীনের বিশাল অর্থনীতির পথকে সুগম করে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখাই প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য। অপরদিকে চীনকে ইউরেশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার সাথে সংযুক্ত করাও প্রকল্পটির প্রধান উদ্দেশ্য। সাংস্কৃতিক বন্ধন দৃঢ় করা, পারস্পারিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, আঞ্চলিক সহযোগিতা সমুন্নত রাখা, উন্নতমানের অবকাঠামো বাস্তবায়ন এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বৃদ্ধিই প্রকল্পটিকে অর্থবহ করে তুলেছে।
যেসকল দেশগুলোতে উন্নতমানের অবকাঠামো নেই, সকল দেশে অবকাঠামো নির্মাণের ঘোষণাও দিয়ে রেখেছে চীন। অন্যদিকে আমেরিকার মত পরাশক্তিগুলো বিভিন্ন অর্থনৈতিক চুক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, সেই জায়গাটি নিতে চাচ্ছে চীন।

চীন বর্তমানে যে সকল দেশে সাশ্রয়ীমূল্যে পণ্য রপ্তানি করছে, একটি সময় সেই চাহিদা কমে আসবে ফলে চীনের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে তাই চীন চাচ্ছে অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোতে সহজে তার পণ্য রপ্তানি করে অর্থনীতিকে শক্ত অবস্থানে দাড় করাতে।
পরিশেষে, চীনের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলকে উন্নত করাও এই প্রকল্পটির বিশেষ লক্ষ্য এবং একই সাথে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রাধান্য গড়ে তুলাই চীনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
প্রাথমিক ধাপঃ
প্রাথমিক ধাপ হিসেবে চীন, দুইটি ইকোনমিক করিডোর সৃষ্ট করেছে। প্রথমত, চীন-পাকিস্তান করিডোর, অপরটি ভারত-চীন-বাংলাদেশ-মায়ানমার-চীন ইকোনমিক করিডোর। বিশ্লেষকরা, এই দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে মহা পরিকল্পনার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে গণ্য করছে।
কীভাবে তৈরি হবে?
চীন দুই ভাবে তার এই পণ্য রপ্তানি করে। সড়ক পথে অপরটি নৌ তথা সমুদ্র পথে। সুতরাং দু’টি মাধ্যমেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। ২১ শতাব্দীর সেরা প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে যৌথভাগে কাজ শুরু করার চুক্তি সম্পন্ন করছে।
সড়ক পথে চীন বিভিন্ন দেশের সাথে গত দশক বা তার আগ থেকেই রেলপথ সৃষ্ট করেছিল। যা এখনো চলমান রয়েছে। যেমন চীনে ঝিয়ানহুয়া শহর থেকে জার্মানি, স্পেন ও ইরানে সরাসরি রেল যোগাযোগ রয়েছে। সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে সেটি হল যেই দেশগুলোর কোন সমুদ্র বন্দর নেই সেই দেশগুলোকে একত্রে সংযুক্ত করা। মধ্যে এশিয়ার দেশগুলো এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সুদূর আফ্রিকার দেশগুলোকেও এর আওতায় রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য চীনের মূল লক্ষই হচ্ছে অনুন্নত অঞ্চলগুলোতে যোগাযোগ স্থাপন করা।এই সাথে গ্যাস লাইন ও তেল লাইনের কাজও সম্পন্ন করা হবে।
একটি বিষয় অত্যন্ত লক্ষণীয় যে, মধ্যেপ্রাচ্যের তেল ও গ্যাস সরবরাহ ছাড়া চীনের দ্রুত ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি সচল রাখা সহজ হবে না। সড়ক প্রকল্পটিকে সিল্করোড ইকোনমিক অঞ্চল বলে অভিহিত করা হয়।
নৌ রোডটি শুরু হবে চীনের দক্ষিণ অঞ্চলে। চীন বৃহৎ প্রকল্পটিকে বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন দেশের সমুদ্র বন্দর গুলোকে ভাড়া নিচ্ছে বা ব্যবহারের জন্য চুক্তি করছে। যেমন চীন শ্রীলংকার কাছ থেকে হাম্বানটোটা বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য ক্রয় করেছে। এছাড়াও চীনের চুক্তিবদ্ধ বন্দর গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুলো হল, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর, মায়ানমারের সিটওয়ে বন্দর, পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর(করাচী), মালদ্বীপের মালে ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সমুদ্র পথে যাতায়াত সুগম হবার ফলে চীন এটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই দক্ষিণ চীন সাগর থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর,লোহিত সাগর দ্বারা বেষ্টিত বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চলকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

অর্থায়ন হবে কীভাবে?
বিশাল এই প্রকল্পটিকে কীভাবে অর্থায়ন করবে চীন সরকার, সেটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-
- এশিয়ান ইনফাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক।
- চায়না ডেভলপমেন্ট ব্যাংক।
- সিল্করোড ফান্ড।
- বিভিন্ন দেশের সাথে চুক্তি।
উপরের সংস্থা ও চুক্তিবদ্ধ দেশগুলোই অর্থায়নে সহযোগিতা করবে। চীন সরকার ইতিমধ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে।
বিশ্বরাজনীতিতে প্রতিক্রিয়া?
চীন কর্তৃক ঘোষিত পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং বিভিন্ন দেশ সফর করে সমঝোতার চেষ্টা করছে। ভারত সরাসরি এটির বিরোধিতা করছে,আমেরিকাও ভারতকে নীরব সমর্থন করছে। সম্প্রতি এশিয়া সফরে ট্রাম্প জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তারা প্রকল্পটিকে চীনের একক কর্তৃত্বের ধাপ বলে মনে করছেন।পরাশক্তি গুলোর মধ্যে রাশিয়া ইতিমধ্যেই চীনকে সমর্থন প্রদান করেছে। সমমনা অন্যান্য দেশগুলোও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। চীন সরকার তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার।
বাধা বিপত্তিগুলো কি কি?
চীন আয়োজিত “ওয়ান রোড, ওয়ান বেল্ট” সম্মেলনে ভারত অংশগ্রহণ করেনি। ভারত সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন তুলে প্রকল্প থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া ভারতের সাথে দীর্ঘকাল ধরে চলা সংঘাতই এর পিছনে মূল কারন। একই সাথে ভারত প্রশ্ন তুলেছে বঙ্গোপসাগর সহ, ভারত মহাসাগর চীন অবৈধভাবে দখল নিচ্ছে। উল্লেখ্য যে ভারত এই মহা প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ।
অপরদিকে, দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের সাথে বিবদমান দেশগুলো মালেয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ব্রুনাই উক্ত প্রকল্পের জন্য বাধা হতে পারে। কারণ চীন সাগরের দখল দায়িত্ব দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক তিক্ত করে তুলছে। একই সাথে চীনের নব্য দ্বীপ সৃষ্টিকে দেশগুলো বিরোধিতা করছে। একই সমস্যা রয়েছে জাপানের মত শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশের সাথে।
তাছাড়া রয়েছে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য; যেখানে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলো চীনের তুলনায় এতই অনুন্নত যে তারা চীনের সাথে কাজ করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
সার্বিক ফলাফল ও সম্ভাবনাঃ
সকল বাধা বিপত্তি দূর করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে তা বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা সংযুক্ত করবে। আঞ্চলিক সহযোগিতা ও পারস্পারিক সম্পর্ক একটি নতুন মাত্রা পাবে। বিশেষ করে অনুন্নত দেশগুলোতে নব দিগন্তের সূচনা হবে। যদিও চীনের একক কর্তৃত্বের সম্ভাবনা থেকেই যায়।
সার্বিক বিবেচনায়, চীন সরকার দাবি করছে ২১ শতাব্দীর সেরা প্রকল্প খ্যাত মহাপরিকল্পনাটি তারা সফল করতে সমর্থ হবে। প্রকল্পটির সময়কাল নিয়ে স্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা দেয়নি সংবাদ সংস্থাগুলো। তবে গবেষকরা মনে করছে ৪০-৭০ বছর বা তা বেশি সময়ও লেগে যেতে পারে প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে।