প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণে রয়েছে ৬৪ বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত একটি অভূতপূর্ব রহস্যে ঘেরা দ্বীপ ‘ইস্টার দ্বীপ’, এই দ্বীপে থাকা মোয়াই মূর্তিগুলো যা আপনাকে একটাবার ভাবতে বাধ্য করবে। এ সম্পর্কে চিন্তা করবেন কারণ কেউই জানে না কিভাবে এই দ্বীপে ওজনে ২০ টন প্রায় মূর্তিগুলো প্রায় ১৮ কিঃমিঃ পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়েছে, তাও কোন ধরণের চাকা চালিত বাহন, ক্রেন বা বৃহদাকার পশুর সাহায্য ব্যতীত…!
ইস্টার আইল্যান্ড বা রাপা নুই নামে পরিচিত এই দ্বীপটির বুকে রয়েছে কিছু স্ট্যাচু যাকে ডাকা হয় মোয়াই নামে। ধারণা করা হয়, ১২৫০ সাল হতে ১৫০০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে রাপা নুই গোষ্ঠী দ্বারা সৃষ্টি হয় মোয়াই স্ট্যাচুগুলো।
চিলির ২০০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত ইস্টার আইল্যান্ডের রহস্যে ঘেরা এই মূর্তিগুলো মাটিতে অবস্থান করছে খুব আশ্চর্য রকমভাবে। মূর্তিগুলোর মাথার অবস্থান মাটির উপরে এবং বাকি অংশটুকু মাটির নিচে। বেশ হতচকিয়ে উঠার মতো ব্যাপার এবং এর কারণ জানতে উৎসাহ বোধ হয় ক্ষণেক্ষণে।

Source: we are out of the office
জেনে নেয়া যাক ইস্টার দ্বীপে থাকা মূর্তিগুলো সম্পর্কে কিছু অবাক করা না জানা তথ্য।
- সময় ২০১১ সাল। বিজ্ঞানীরা হরেকরকমের পরীক্ষা করতে লাগলো কিভাবে কিছু ছাড়াই এই মূর্তিগুলো সফলতার সাথে এতদূর সরিয়ে আনা হয়েছে? হাওয়াই ইউনিভার্সিটির “টেরি হান্ট” এবং ক্যালিফোর্নিয়া স্ট্যাট ইউনিভার্সিটির “কার্ল লিপো” নামের বিশেষজ্ঞ দল ন্যাশনাল জিওগ্রাফির সাথে মিলে দেখলো, ১৮ জন মানুষ একটি ৫ টন ওজনের ১০ ফুট লম্বা মোয়াই ৩ টি শক্ত রশি এবং প্রক্রিয়া দ্বারা মাত্র কয়েকশ মিটার পর্যন্ত সরাতে সক্ষম। এবার চিন্তা কি করা যায় ৩৩ ফিট লম্বা ৮২ টন ওজনের মোয়াই কিভাবে সরাবে? আসলেই অবাক করার বিষয় বটে।
- যদিও প্রথমে ৮৮৭ টি মোয়াই (মূর্তি) সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেলেও বর্তমানে এখানে রয়েছে ৩৯৪ টি। ওজনেও বেশ খানদানী মূর্তিগুলো। প্রায় ২০ ফুট উচ্চতার প্রতিটি মূর্তির ওজন প্রায় ২০ টনের কাছাকাছি। তবে অস্বাভাবিক হিসেবে একটি অসম্পূর্ণ মূর্তি পাওয়া যায় যার উচ্চতা ছিলো প্রায় ৬৯ ফুট এবং ওজন ২৭০ টন। গঠনশৈলী হিসেবে জানা যায় প্রতিটি মূর্তি সংকুচিত আস্ত আগ্নেয় শিলা হতে খোদাই করা হয়েছে তবে কি উদ্দেশ্যে বা কেনো এই মূর্তিগুলো নির্মাণ করা হয়েছিলো তা সম্পর্কে কেউই সঠিক ধারণা দিতে পারে নি।
- সময় ১৯১৪ সাল। এই দ্বীপে শুরু হয় প্রথম পুরাতাত্ত্বিক গবেষণা এবং পুরাতত্ত্ববিদরা জানতে পারেন কিছু অবাক করা তথ্য। প্রথম দেখায় উপরের অংশটুকু দেখা গেলেও গবেষণার পর জানা যায় এর বেশ কিছু অংশ মাটির নিচেও রয়েছে। ২০১২ সালে “ইস্টার আইল্যান্ড স্ট্যাচু প্রোজেক্ট” এর জন্য মূর্তিগুলোর খননকার্যের ছবি প্রকাশিত হয়। সময় ২০০৮ সাল। ২৬ বছর বয়সী মার্কো কুলজো নামের ফিনল্যান্ডীয় টুরিস্ট আনাকেনা বীচ হতে মোয়াইয়ের কান চুরি করে নেয়ার সময়ে এক দ্বীপবাসীর নজরে পড়ে এবং সাথে সাথে পুলিশকে জানায় ব্যাপারটি। পরে কুলজোকে খুঁজতে বেগ পেতে হয় নি। তার শরীরে আঁকা ট্যাটু সনাক্ত করেই তাকে ধরা হয়। পরবর্তীতে তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয় এবং প্রায় ১৭ হাজার ইউএস ডলার জরিমানা করা হয়। পরে সে চিলির একটি সংবাদ পত্রের মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর পর্যটকের গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখা শুরু হয়।

Source: G Adventures
এখানকার মূর্তি বানানোর পিছনে কয়েকটা কাহিনী প্রচলিত আছে। আসুন দেখে নিই,
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সাইক্রিয়াটিক বিভাগের প্রফেসর ডা. এনেলিসে পন্টিয়াস মূর্তিগুলো নির্মাণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু ধারণা দেন। তার মতে তখনকার যুগে কুষ্ঠ রোগ হতে বাঁচতে তারা এসব মূর্তি বানাত। তার এই মতবাদের পিছে যুক্তি হিসেবে বলেন,
“বিদঘুটে আকৃতির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এর বিপরীতে সংশোধিত এই মূর্তিগুলো বানানোর মাধ্যমে দেশ হতে রোগের প্রাদুর্ভাব এড়ানো সম্ভব। এরমধ্যে লক্ষণীয় হলো কুষ্ঠব্যাধির ফলে নাকের তরুণাস্থি ভেঙ্গে যায় এবং দ্বীপবাসীরা মোয়াই মূর্তিতে সেসব কিছুর সংশোধন করে নাকের একটা ভালো আকৃতি দান করে।”
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে কেনো মূর্তিগুলো দেশের অভ্যন্তরে মুখ করে বানানো হয়েছে?
এ সম্পর্কে গবেষকরা বলছেন, তখনকার অধিবাসীরা মনে করতো তারা বাদে এই পুরো জগতে আর কোন মানুষ নেই যার কারণে আক্রমণকারীরা সমুদ্র পথে আসবে না বরং তারা হবে ভেতরে অবস্থানরতদের মধ্যেই কেউ যার কারণে মূর্তিগুলোকে ভেতরে মুখ দিয়ে রাখা হয়েছিলো দ্বীপ রক্ষার জন্যে।
দ্বীপে অবস্থানরত কিছু মূর্তি শোয়ানো অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় এবং এ সম্বন্ধে কিছু কুসংস্কার আছে যা হলো এসব মূর্তি শুইয়ে রাখার পিছে কিছু কারণ আছে তাই এসব মূর্তি দাঁড় করানো চেষ্টা না করাই উত্তম নাহয় অভিশাপ লাগতে পারে। আজ পর্যন্ত এই মূর্তি শোয়ানোই আছে।
উল্লেখযোগ্য হিসেবে বলা চলে, “El Gigante” নামক মোয়াই মূর্তির নাম এবং যদি এই মূর্তিটির কাজ সম্পূর্ণ করা হতো তবে এটিই হতো সবচেয়ে বৃহৎ আকারের মোয়াই মূর্তি যার উচ্চতা হতো ২১ মিটার এবং ওজন প্রায় ১৮০ টন।
এর মধ্যে বেশ কিছু মূর্তি দেখা যাদের মাথায় থাকে হ্যাট বা টুপি আকৃতির কিছু যাকে বলা হয় “পুকাও”। যা পোলেনেসিয়ার চীফদের পরিহিত লাল পালকের আবরণের স্মৃতিচিহ্ন প্রকাশ করে। অনেকেই এটাকে শক্তির বহিঃপ্রকাশ বলে অভিহিত করেছে।
শেষার্ধে জেনে নেয়া যাক দ্বীপটি আবিষ্কারের পিছের কাহিনী।
সময়কাল ৫ এপ্রিল, ১৭২২ সাল আর দিনটি ছিলো “ইস্টার সানডে”। ডাচ আবিষ্কারক জ্যাকব রগেবেনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো “Terra Australias” খুঁজে বের করার যাতে “Spice Island” এ বাণিজ্য পথের রাস্তা খোলা যায়। সফরপথে জুয়ান ফারনান্দেজ দ্বীপে অবস্থান শেষে পৌঁছে ইস্টার দ্বীপে। যেহেতু সেদিন ছিলো ইস্টার সানডে তাই দ্বীপটির নামকরণ করা হয় “ইস্টার আইল্যান্ড”।

তখন প্রায় সন্ধ্যার কালো আধার নেমে এসেছে। তিনি জাহাজ নোঙর করার আগে দেখতে পান চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো বেশ বিশালাকার মূর্তি যারা অপলক নয়নে তাদের দিকে চেয়ে আছে। এমন দানবাকৃতির মূর্তি দেখে সবার চোখ ছানাবড়া তবে ক্যাপ্টেনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। তিনি এখানেই নোঙর করবেন। তবে সংশয় আর কৌতূহল ভাঙতে দেরী হলো না। ভোর হতেই ভেঙ্গে গেলো সব আশংকা। সবাই দেখতে পেল আসলে ওইগুলো ছিলো মূর্তি যা তারা অন্ধকারে মনে করেছিলো দ্বীপের বাসিন্দা। কে বা কারা এই মূর্তি তৈরি করলো। কেই বা তাদের এসব মূর্তি নির্মাণের কৌশল শেখালো তা আজও অজানা।
ইস্টার দ্বীপের নিশ্চুপ মূর্তিগুলো একটি নিদর্শন তৎকালীন সভ্যতার দক্ষ, সুনিপুণ করুকাজের এবং পলেসিয়ান জাতির চমকপ্রদ ঐতিহ্যের। ১৭ হাজার একরের এই দ্বীপটিতে বছরে প্রায় ৫২ হাজার পর্যটক আসে ঘুরতে। ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো এই দ্বীপকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা দেয়।

Source: VOA News
বিশ্ব অত্যাধুনিক হচ্ছে, সাথে বদলাচ্ছে কাজের ধরণ তবে কথায় আছে “ওল্ড ইজ গোল্ড” আর হ্যাঁ, ইস্টার দ্বীপ এদিকে কথাটির স্বকীয়তা বহন করে কারণ আজও এখানকার অবস্থিত মূর্তি নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে, চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ কিন্তু তবুও অজানা থেকে যাচ্ছে সভ্যতার “স” অক্ষর না থাকা ওই জমানায় কেমনে তারা এসব শিলাখন্ড থেকে আস্ত মূর্তিতে রূপ দিলো? কেমনে তারা এর সুক্ষ্ণ নকশা আঁকলো? কেমনেই বা তারা কোন কিছু ছাড়াই মূর্তিগুলো প্রতিস্থাপন করলো বরাবর জায়গায়? অবাক হওয়ার মতো অনেক কিছুই বাকি থেকে যায়। মাঝেমধ্যে প্রকৃতি এবং মননশৈলীর কাছে আমাদের হার মানতে হয়। সভ্যতায় আধুনিকতা থাকলেও ফিরে যেতে হয় অবিশ্বাস্য সব স্মৃতিতে যার মধ্যে থাকে শিক্ষণীয় অনেক কিছুই। তেমনই এক শিক্ষার নিদর্শন হয়ে পৃথিবীতে টিকে থাকবে ইস্টার আইল্যান্ড এবং তার বুকে ঠাঁই করে নেয়া মূর্তিগুলো।