হালদা – নারী ও নদীর গল্প
ভিন্নধর্মী সব গল্প নিয়ে এখন পর্যন্ত সর্বমোট পাঁচটি সিনেমার পরিচালক হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছেন তৌকির আহমেদ । গল্পের ভিন্নতা থাকলেও প্রতিটি সিনেমায় তাঁর কিছু কমন উপাদান আছে । লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তাঁর প্রতিটি সিনেমার শেকড় গিয়ে ঠেকেছে “বঞ্চিত সমাজ”এর উপর । জয় যাত্রায় গ্রামের সহজ সরল মানুষের উপর যুদ্ধের প্রভাব, বেওয়ারিশ লাশ নিয়ে অজ্ঞাতনামা, ছোট্ট একটি শিশুকে নিয়ে রূপকথার গল্প আর সর্বশেষ নির্মান হালদায় তুলে ধরা হয়েছে দারিদ্রের চাকায় পিষ্ঠ একজন নারী এবং নির্যাতিত একটি নদীকে ।
“দেশীয় সিনেমা” শব্দটি শুনলে-ই ঠিক কোন চিত্রটি মাথায় প্রথমে ঘুরপাক খায় ? পরিসংখ্যান যদি করা হয় তাহলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সিংহভাগের উত্তর-ই হয়তো মিলে যাবে , প্রতিটি ক্ষেত্রে-ই সংখ্যাধিক্য উত্তর হবে “তথাকথিক নায়ক (যা এক প্রকারে বিল্ট ইন বলা যেতে পারে, এটি ছাড়া দেশীয় সিনেমার কথা অকল্পনীয়), এরপরের আবশ্যিক শর্তগুলো সহজে-ই অনুমেয়, চিত্তাকর্ষক নায়িকা, এক্ষেত্রে গল্পের গাঁথুনি অতোটা মনোযোগ আকর্ষণ করে না যতোটা মনোযোগ সিনেমার নায়িকা আর এর একশন দৃশ্য করে । সর্বপ্রকারের কমার্শিয়াল উপাদানের প্যাকেজ-ই মূলত “দেশীয় সিনেমার” সংখ্যাগরিষ্ঠ সংজ্ঞা ।
মোটেও এক্ষেত্রে সংখ্যাধিক্য দর্শকের রুচিকে ছোট করে দেখা হচ্ছে না । কমার্শিয়াল এলিমেন্টওয়ালা সিনেমা-ই মূলত যেকোনো দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সঞ্জীবনী । যদিও আমাদের মাঝে এক প্রকারের মতবাদ প্রাচীরের মতন তৈরী হয়ে গেছে যেসব সিনেমায় অতো চাকচিক্য নেই সেটি আর্ট ফিল্ম আর সেসব সিনেমায় চাকচিক্যময় সেটি বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা । হাস্যকর হলেও সত্য যে সিনেমায় উপস্থিত হাতেগোনা কিছু এলিমেন্ট দিয়ে এই মতবাদ প্রবর্তন করে ফেলা হয়েছে । এখন কোনো সিনেমা যদি বাণিজ্যিক ধারার উপাদান ব্যতীত নির্মিত হয়ে ব্যবসা সফল হয়ে যায় তাহলে একে কোন ক্যাটাগরিতে ফেলা হবে ?
আর্ট ফিল্ম বা কমার্শিয়াল ফিল্মের বাহিরেও আরো একটি ক্যাটাগরি আছে “ইন্ডিপেনডেন্ট সিনেমা” । যে সিনেমাগুলো সংখ্যাগুরু দর্শকের চাহিদা মেটাতে প্রায় অপারগ বলা যেতে পারে । “হালদা” তেমনি একটি ইন্ডিপেনডেন্ট সিনেমা যেখানে তথাকথিক নায়ক বা নায়িকা নেই, গল্পে জোর থাকলেও সেখানে কোনো একশন সিকুয়েন্স নেই যা দেখে দর্শক সিট ছেড়ে লাফিয়ে উঠে শিস বাজাবে । সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত তৌকির আহমেদের পরিচালনায় “হালদা” তেমন-ই একটি সিনেমা । যেখানে বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা-ই মুখ ধুবড়ে পড়ছে সেখানে ইন্ডিপেনডেন্ট সিনেমা নির্মাণ চাট্টিখানি কথা নয় ।
হালদা নদী আর এই নদীকে ঘিরে একটি পরিবারের গল্প-ই হচ্ছে “হালদা” সিনেমা । লেখাকে ভারী করার উদ্দেশ্যে সিনেমার পুরো গল্প বলে দিয়ে সিনেমাটি দেখার স্বাদ নষ্ট করবো না । দর্শকের আগ্রহ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কিছু লাইনে গল্পকে হাইলাইট করছি। মোটামুটি চারটি চরিত্রকে ধরে-ই পুরো সিনেমার গল্প বলা হয়েছে । চারটি চরিত্রের রয়েছে আলাদা চারটি গল্প –
মনু মিয়া (ফজলুর রহমান বাবু)- যিনি জলদস্যুর আক্রমণে সব হারিয়ে শুধু জীবন নিয়ে বাড়ি ফিরলেও ঋণের বোঝা তাকে অর্ধমৃত করে ফেলে । এই ঋণ থেকে মুক্তি পেতে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন নাদের চৌধুরীর সাথে ।
বদি (মোশাররফ করিম) – ট্রলারে একের পর এক জেলেকে যখন গুলি করা হচ্ছিলো তখন মনু মিয়াকে এই বদি-ই বাচিয়েছিলো । জীবন বাচনোয় মনু মিয়া বদিকে নিয়ে আসেন নিজের বাসায় । মনু মিয়ার বাসায় কিছুদিন থাকতে থাকতে মনু মিয়ার মেয়ের সাথে ধীরে ধীরে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে বদির।
হাসু (নুসরাত ইমরোজ তিশা)– বাবার ঋণের বোঝা হালকা করতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নাদের চৌধুরীর সাথে বিয়ে করতে হয় তাকে। নাদের চৌধুরীর সাথে বিয়ে হলেও হাসু ভুলতে পারেনি বদিকে । আর এ ভুলতে না পারার কারণ এ চারজনের জীবনকে আরো জটিল করে তোলে ।
নাদের চৌধুরী– হাসুর সাথে এটি তার দ্বিতীয় বিবাহ, প্রথম ঘরে কোনো সন্তান না হওয়ায় দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন । কিন্তু বিবাহের পর-ই যেনো একে একে সব কিছু তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘটতে থাকে ।
হালদা নদীর সাথে এই চারজনকে একটি সুতোয় গেধে পুরো গল্প বেশ সাবলীল ভাবে চিত্রায়ন করেছেন তৌকির আহমেদ ।
নদী নিয়ে এর আগেও আমরা সিনেমা দেখেছি এমন কি এক-ই বিষয়ের উপর ভিত্তি করে-ই নির্মিত হয়েছে “পদ্মানদীর মাঝি”, আর “তিতাস একটি নদীর নাম” সিনেমাটি । গল্পের ধরণ এক হলেও গৌতম ঘোষের পদ্মানদীর মাঝি আর তৌকির আহমেদের হালদায় রয়েছে বিস্তার ফারাক । গল্প বলার ধরণ দুটো সিনেমাকে-ই আলাদা ফ্লেভার দিয়েছে ।
যেখানে আমাদের দেশের এমন বহু টিভিসি আছে যার বাজেট প্রায় ত্রিশ লক্ষ । সেখানে স্বল্প বাজেটে এতো ডিটেইলস জিনিস দেখানোর সাহস আমাদের দেশের খুব কম পরিচালকের-ই আছে । বাজেটের সাথে আউটপুট প্রোডাক্টের সামঞ্জস্য বলে দিচ্ছে কতোটা স্ট্রং ছিলো পরিচালকের প্রি-প্রোডাকশন । হালদা পাড় নিয়ে সিনেমার গল্প হলেও শুধু হালদা নদীর উপর ফোকাস করা হয়নি দেখানো হয়েছে সেই হালদা পাড়ের ঐতিহ্য-কেও, বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ে, জব্বারের বলি খেলা,নৌকাবাইচ, পালা গান, সুফি গান থেকে শুরু করে মোটামুটি সব কিছু-ই দেখানোর চেষ্টা করেছেন ২ঘন্টা ১০মিনিটের সিনেমায় ।
টেকনিক্যাল দিক বিবেচনা করলে তৌকির আহমেদের পূর্ব পরিচালিত চারটি সিনেমা থেকে হালদা অনেক এগিয়ে ।
সিনেমার প্রতিটি ফ্রেম-ই যেনো এক একটি গল্প বয়ান করছে । দারুন সব মেটাফরিক সিকুয়েন্স শুধুমাত্র ক্যামেরার ব্যবহার দিয়ে-ই দেখানো হয়েছে, বিশেষ করে কিছু এরিয়াল শর্ট আর বজ্রপাতের দৃশ্যায়ন এখনো চোখে লেগে আছে, এই পুরো কৃতিত্বের জন্য প্রশংসার দাবিদার চিত্রগ্রাহক এনামুল হক সোহেল । হালদা নদীতে যখন মাছের ডিম পাড়ার সময় হয় তখন এক প্রকারের উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয় হালদা পাড়ে, এই দৃশ্যকে চিত্রগ্রাহক একদম ন্যাচারাল ভাবে চিত্রায়ন করেছেন, তাই মেইন শুটিং শুরু হওয়ার মাস পাচেক আগে-ই এই দৃশ্যের শুট করা হয়েছে । সিনেমায় আমরা যে দৃশ্যটি দেখেছি তা পুরোটা-ই হালদা পাড়ের বাস্তবচিত্র । এ বছরের এখন পর্যন্ত সেরা সিনেমাট্রোগ্রাফী। দৃষ্টিনন্দন সিনেমাট্রোগ্রাফীতে আরো প্রাণ এনে দিয়েছেন সুরকার পিন্টু ঘোষ। ২০১২সালের টেলিভিশন সিনেমার পর আবারো কোনো সিনেমা পেলাম যার প্রতিটি গান আর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর এখনো মাথায় আটকে আছে । অসাধারণ সব গানের এক দারুন কম্বিনেশন করেছেন পিন্টু ঘোষ। সিনেমার মেইন দুটি গান পিন্টু ঘোষ নিজে-ই করেছেন আর ফিমেইল ভার্শন করেছেন তার-ই সহধর্মিণী সুকন্যা মজুমদার ঘোষ ।
সব বড় মাঠের খেলোয়াড়কে কাস্ট করা হয়েছে । সব জাত অভিনেতার সমাহার যেনো হালদা সিনেমা । শুরুর দিকে ফজলুর রহমান বাবুর কথা টোন কিছুটা মেকি মেকি মনে হচ্ছিলো, কিন্তু তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আর এক্সপ্রেশন সব ঢেকে দিয়েছে । বিশেষ করে তিশার সাথে বজ্রপাতের সিকুয়েন্সটি । মোশারফ করিমের সেরা অভিনয় বলবো না কিন্তু সবার সাথে পাল্লা দিয়ে তিনিও অসাধারণ অভিনয় করেছেন । বাবু-জাহিদ হাসান-মোশারফ করিমের মতন অভিনেতাদের টপকে পুরো সিনেমার ফোকাস নিজের দিকে করে নিয়েছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা, তার মুখে চিটাগং-এর আঞ্চলিক ভাষা মোটেও মেকি মনে হয় নি । মনে হচ্ছিলো তিনি এ ভাষাতে-ই অভ্যস্ত । দিলারা জামানের সেই সুরত বানুর সিকুয়েন্স বাংলা সিনেমা ইতিহাসের অন্যতম সেরা মেটাফরিক সিকুয়েন্স । আমাদের সমাজে একজন বিবাহিত নারীকে কিভাবে পরিচয় দেয়া হয় কিভাবে তার প্রকৃত পরিচয় ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায় তা এই সিকুয়েন্সে খুব নিখুত ভাবে প্রেজেন্ট করা হয়েছে । স্পেশালী আরো একটি চরিত্রের কথা বলবো যিনি শক্তিমান অভিনেতাদের ভীড়ে থেকেও নিজের অভিনয় দক্ষতার কথা জানান দিয়েছেন । চরিত্রটির নাম কুলসুম, খুব বেশি ডায়ালগ নেই এই চরিত্রের কিন্তু এমন সব এক্সপ্রেশন যা নজর কাড়বে-ই ।
বর্তমানে দেশীয় সিনেমার ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন সবচে বেশি করা হচ্ছে তা হলো “কেনো দেখবো সিনেমাটি”, এই সিনেমার ক্ষেত্রেও এক-ই প্রশ্ন করবেন যারা দেখননি সিনেমাটি ।
“হালদা দেখবেন কারণ-
এটি এমন একজন পরিচালকের সিনেমা যিনি আজ অবদি এমন কোনো সিনেমা নির্মাণ করেননি যা দেখে মনে হয়েছে এই সিনেমা সময় নষ্ট করেছে । এই পরিচালকের রূপকথার গল্প সিনেমা একটি হলে মুক্তি পেয়েছে, তবুও তিনি সিনেমা নির্মান করা ছেড়ে দেননি যেখান । এমন প্যাশনেট নির্মাতার সিনেমা না দেখলে কার সিনেমা আমরা দেখবো ।
পুরো ২ ঘন্টা ১০ মিনিটের নির্মল বিনোদন । এখনো আমাদের দেশে প্রতিবছর বহু অখাদ্য সিনেমা নির্মিত হচ্ছে যা পরিবার নিয়ে মোটেও দেখার মতন না কিন্তু হালদা আপনি গোটা পরিবার নিয়ে দেখতে পারবেন ।
বিঃদ্র- এই ঘা অনেক পুরোনো হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু হালদা দেখে আবারো সেই ঘা-এ নতুন করে চির ধরছে, সে ঘা-এর নাম মনপুরা । যা এখনো মনে দাগ কেটে আছে সিনেমায় হাসু এবং বদি প্রেম দেখে বারবার মনে হচ্ছিলো মনপুরা গল্পটি যেখান থেকে শেষ হয়েছিলো সিনেমাটি আবার সেখান থেকে শুরু হয়েছে ।
purchase lamisil generic – buy griseofulvin sale griseofulvin cost
buy semaglutide generic – order semaglutide 14mg pill DDAVP cost
zyprexa 30 mg
ambien and zofran interaction