মানুষের মনের মত জটিল কিছু হয়তো নেই আর। সেই গহীন সমুদ্র কখনো একাকী নীরব হয়ে থাকে আবার কখনো তাতে উত্তাল ঝড় আসে। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই হয়তো এরকম একটা সময় আসে। চলচ্চিত্র নির্মাতা জাভেদ হাসান আর তার পরিবারের জীবনে একরকমই কিছু সময় নিয়ে মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর নতুন ছবি “ডুব”।
ছবির শুরু একটি রি-ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে যেখানে অনেকদিন পর দুই বান্ধবীর দেখা হয়। সাদা শাড়ী আর লাল পাড়ে একদিকে যেমন সাদা শুভ্রতে একটা বিষাদ ছিল তেমনি হৃদয়ের রক্তক্ষরণের একটা প্রতীকী দিকও হয়তো উঠে আসে।
একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েই তারপরেই গল্প চলে যায় বান্দরবনের গহীন অরণ্যে। একটি সুখী পরিবারের একগুচ্ছ গল্পের মাঝে। যেখানে থাকে হাসি, কান্না, বেদনা আর নিজের ভেতরের কিছু প্রশ্ন।
পুরো ছবির পুরোটা জুড়েই সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা হয়েছে। যার শুরু হয়েছিল সমুদ্রে আর পাহাড়ে তা কংক্রিটের দেয়ালে দেয়ালে আর নির্জন অরণ্যের নয়নতারাতেও সেই প্রচেষ্টাই চলছিল। সব প্রশ্নের উত্তর হয়তো পাওয়া যায়না। হয়তো জাভেদ হাসান নিজেও তা পারেনি।
জীবনের শুরুতে যারা অনেক চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে একই ছাদের নিচে থাকার অভিপ্রায়ে একসাথে থাকা শুরু করে তাদের মাঝেও একটা সময় অনেকটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। সেই দূরত্বটা হয়তো আজীবনই থেকে যায়। মায়া আর জাভেদ হাসানও হয়তো সেটা কাটাতে পারেনি।
একটা পরিবারের দূরত্ব মানে শুধু দুটো বাবা মার দূরত্ব নয় সেই সাথে তাদের সন্তানদেরও একটা অস্থির সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত সাবেরী আর তার ভাইও একটা গভীর কষ্টের ভেতর দিয়ে যায়।
যখন মানুষ অথৈ সাগরে একাকী কাটাতে থাকে তখন তার জন্য একটুখানি ভালবাসাই তার জীবনধারণের জন্য অবলম্বন হয়ে আসে। নিতু হয়তো সেই কাজটিই করেছিল বলে জাভেদ হাসান এত কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হননি।
জাভেদ হাসানের জবানবন্দিতে উঠে আসে তার বাবার কাছ থেকে পাওয়া একটা উপলব্ধির যা কিনা তাকে জানান দেয়, একটা জীবনের মৃত্যু হয়ে যায় যখন তার কাছের মানুষদের কাছে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। এই তত্ত্বের সাথে সমরেশ মজুমদারের “কালবেলা” উপন্যাসের সেই কথাটাই মনে পড়ে যায়-কাছের মানুষের যোগা-যোগহীনতাই মানুষকে মৃত বলে ঘোষণা করে।
এই অবস্থাগুলোতে হয়তো একটা মানুষ বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুতেই বেশী স্বস্তি-বোধ করে। তবু তাতে শান্তি হয়না তার কাছের মানুষের। তারা তখনো তাদের পৃথিবীর অধিকারটা আদায় করে নিতে চায় নিজেদের মত করে। যাতে কোন লেনদেন থাকেনা মৃত মানুষটির।
নির্বাক দৃশ্যগুলোও মাঝে মাঝে সংলাপের চেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে। হয়তো আমাদের ভাবনার খোরাকের জোগান দিতেই এই প্রয়াস।
যেখানে শুরু সেখানেই শেষ হয়। এখনো কি সেই বান্ধবী দুটির মাঝে আগের মতই সেই দূরত্বটি আছে নাকি তার মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব হয়ে আছে। হয়তো তার প্রশ্ন দর্শক নিজের কাছেই খুঁজতে থাকবে। শেষ হইয়াও তাই শেষ হয়নি অনেক কিছুই।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর শ্রেষ্ঠ সিনেমা বলা যায় এটিকে। শেখ রাজিবুল ইসলাম ক্যামেরায় অসাধারণ কাজ করেছেন। প্রত্যেকটা দৃশ্যের ফ্রেমগুলো এত সুন্দর ছিল।
অভিনয়ের ব্যপারে আসলে প্রথমেই আসে ইরফান খানের কথা। ইরফান খান এই ছবির প্রথম থেকেই আকর্ষণ ছিল। তার অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নেই। অসাধারণ এক্সপ্রেশন দিয়েছেন তিনি। মেথড এক্টিং এ তার সাথে আর কেইবা পারত জাভেদ হাসানকে ফুটিয়ে তুলতে। সাবেরী হিসাবে নুসরাত ইমরোজ তিশাও সমানে পাল্লা দিয়ে গেছেন। মায়া চরিত্রে রোকেয়া প্রাচীর আর নিতুর চরিত্রে পার্ণো মিত্র যথাযথ অভিনয় করেছেন। আর বিশেষ করে আর কারো কথা বলতে হয় সেটি নয়নতারার কেয়ারটেকার চাচার চরিত্রটি বিশেষ দৃষ্টি কেড়েছে।
অর্ণবের আবহসঙ্গীত আর চিরকুটের আহারে জীবন ছবিকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। পুরো ছবিজুড়েই তা মুগ্ধতা ছড়িয়েছে।
ভুল যে ছিলনা তা নয় কিন্তু শুদ্ধতা তাকে ঢাকা দিয়ে ফেলেছে। তাই আত্মতৃপ্তির জায়গাটা ঠিক থাকে।
যে বিতর্ক ছিল যে হুমায়ূন আহমেদের জীবন অবলম্বনে এই ছবি তার সাথে কাহিনী কিছু মিল থাকতেও পারে। তবে এটি মোটেও কারো বায়োপিক নয়। যদি হয়েও থাকত তাতেও কি যায় আসে কিছু কারো। সত্যজিৎ রায়ের একটি ঘটনা নিয়েও তৈরি হয়েছে “আবহমান” চলচ্চিত্র। এই বিশ্বের প্রত্যেকটি গল্পে যেমন জীবনের ছোঁয়া থাকে এটিও শুধুই একটি জীবনের গল্প।
হলে শিষ দেওয়ার মত ছবি এটি নয়, কিছু ভাবনা আর জীবনের কিছু প্রশ্ন খোজার একটি চলচ্চিত্র। আমাদের জীবনকেও হয়তো সেটা প্রভাবিত করবে।
এক সমুদ্র বিষণ্ণতায় তাই একটুখানি ডুব দিতে আপনার কাছের হলেই দেখে আসুন “ডুব”।