আর পাঁচ টা সাধারন বাংলাদেশি মেয়ের মত পুতুল খেলার শৈশব পাড় করে, কোনোরকম পড়াশুনা করে আটপৌরে সংসার শুরু করার মত জীবন মাহমুদা সুলতানারও হতে পারতো। এমন হলে হয়তো সারাজীবন ঘরকন্যা করেই কাটিয়ে দিতেন মাহমুদা। কিন্তু দিনশেষে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কষার জন্য জন্ম হয়নি তাঁর, বরং তিনি জন্মেছেন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে।
এতক্ষণ যে মানুষটির কথা বলছি তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মাহমুদা সুলতানা যিনি ২০১৭ সালে নাসার বর্ষসেরা বিজ্ঞানী নির্বাচিত হয়েছেন। অবশ্যই এটা পুরো বাংলাদেশের জন্য, বাঙ্গালীদের জন্য অত্যন্ত গর্বের ব্যাপার।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এই গবেষণা সংস্থা টি প্রতিবছর ঐ সকল গবেষক দের পুরস্কৃত করে যারা গডার্ড স্পেস ফ্লাইট এর অধীনে অত্যন্ত চমকপ্রদ প্রযুক্তির আবিষ্কার করে থাকে। সুলতানা এই পুরষ্কার টি পেয়েছেন তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য। তিনি ন্যানো ম্যাটেরিয়াল ও পদ্ধতি ব্যবহার করে ক্ষুদ্র ও সম্ভাব্য বৈপ্লবিক ডিটেক্টর ও ডিভাইস আবিষ্কার করেছেন।
এই পুরষ্কার টি মেরিল্যান্ডের গ্রিনবেল্টে নাসার গডার্ড এর প্রধান প্রাযুক্তিক অফিস থেকে দেয়া হয়ে থাকে। আশানুরূপ ও সম্ভাব্য যুগান্তকারী প্রযুক্তি যা এজেন্সির বৈজ্ঞানিক ও অনুসন্ধানমূলক কাজের জন্য লাভজনক সেগুলোর উন্নতির জন্য তহবিলের ব্যবস্থা করে এই সংস্থা।
“মাহমুদা নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা ও বিশেষ ভাবে উপস্থাপন করেছে তাঁর কঠিন, সৃজনশীল চিন্তাধারা দিয়ে। তাঁর সূক্ষ্ম বিচার বুদ্ধি এবং চলন দিয়ে সে সবাইকে মুগ্ধ করেছে” বলেছেন গডার্ড এর প্রধান প্রাযুক্তিক থমাস হিউজ।
তিনি আরও বলেন “ মাহমুদা এখানে আসার অল্প দিনের মধ্যেই আইআরএডি এর অধীনে ১০ টি পুরষ্কারের জন্য প্রতিযোগীতা করে ফেলেছে তাঁর সফল অর্জনের দ্বারা, যার মধ্যে একটি এডভান্সড সেন্সর এর আবিষ্কার রয়েছে যা এখন প্যাটেন্ট পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। সম্ভবত নাসায় তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজগুলো ন্যানো টেকনোলজি সংক্রান্ত। আমি শুধু কল্পনায় করতে পারি সে নিকট ভবিষ্যতে কত ভাল কাজ করতে যাচ্ছে। সে উদ্ভাবনের সারমর্ম টাকে বাস্তবিক রুপ দিতে পারদর্শী”।
২০১০ সালে নাসায় যোগদানের কিছুদিনের মধ্যে সুলতানা গ্রাফেন বেইসড সেন্সর তৈরির প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন, তাঁর এই কাজটি এখন প্যাটেন্ট পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। গ্রাফেন, যে জিনিসটার পুরুত্ব একটা অণুর সমান এবং এটি গঠিত কার্বন অণু দিয়ে। হেক্সাগনাল শক্ত বন্ধনীর সূক্ষ্ম তারের ন্যায় দেখতে এই গ্রাফেন স্ট্রাকচারাল স্টিলের চেয়ে ২০০ গুন বেশি শক্ত এবং অত্যধিক তাপমাত্রা সহনশীল।

সুলতানা বলেন “ আমি যখন নাসায় যোগ দেই তখন গ্রাফেন নিয়ে কেউ তেমন কোন কাজ করছিলোনা, কিন্তু আমি এই ব্যাপারে বেশ উত্তেজিত ছিলাম”, তিনি এর ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, “ অনেক আগে সবকিছু স্থির ছিল, দিন দিন লোকজন গ্রাফেনের নতুন নতুন ব্যবহার করার কৌশল আবিষ্কার করছে। কিন্তু আমি দেখতে চেয়েছিলাম মহাকাশ গবেষণায় গ্রাফেন কে কিভাবে কাজে লাগানো যায়”।
এরপর থেকেই তিনি তাঁর গবেষণার ক্ষেত্রটাকে বাড়াতে থাকেন।
সুলতানা এবং তাঁর দল এমআইটি এর সাথে মিলে একটি প্রোটোটাইপ ইমেজিং স্পেক্ট্রমিটার বানানোর চেষ্টা করছেন। এই যন্ত্র টি মূলত প্রায় সকল বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয় এমআইটি গবেষকদের দ্বারা উদ্ভাবিত উদীয়মান কুয়ান্টাম ডট টেকনোলজির উপর ভিত্তি করে আলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে।
কুয়ান্টাম ডট একধরনের অদানাদার সেমিকন্ডাক্টর যা আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৮০ সালে। খালি চোখে দেখা না যাওয়া এই ডট গুলো বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোক শোষণ করে নিতে পারে তাদের সাইজ, আকার ও রাসায়নিক গঠনের ভিত্তিতে। নিজ তহবিল থেকে সুলতানা চেষ্টা করছেন থার্মাল ভ্যাকুয়াম এবং ভাইব্রেশন পরীক্ষা এবং ২০ বাই ২০ ডটের বিন্যাস দেখানোর, যা সূর্য এবং এর আলোকচ্ছটা এর ইমেজিং এর জন্য দরকার।
আবার বোস্টনের নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সাথে মিলে সুলতানা ও তাঁর দল ইউনিভার্সিটির আবিষ্কৃত ন্যানো স্কেল অফসেট প্রিন্টার নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছেন একটি মালটি ফাংকশনাল সেন্সর তৈরি করা্র যা গঠিত হবে বিভিন্ন ন্যানো ম্যাতেরিয়ালস যেমন গ্রাফেন, কার্বন নন টিউব এবং মলিবডেনাম ডাইসালফাইড।
সুলতানা বলেন এই ৩ ডি প্রিন্টার এর কাজ অফসেট প্রিন্টারের মতই যা টাকা, খবরের কাগজ ছাপার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শুধু এই প্রিন্টারে কালির বদলে বিভিন্ন ন্যানো ম্যাটেরিয়াল একটি ছাঁচের মধ্য দিয়ে ব্যবহার করা হয়, যে পদ্ধতি টি এখানে ব্যবহার করা হয় তাকে বলা হয় ইলেক্ট্রোফেরোসিস। ৩ ডি প্রিন্টিং এ ন্যানো ম্যাটেরিয়ালস গুলোতে তাপ প্রয়োগ করা হলে সেগুলো ছাঁচের গায়ে নির্দিষ্ট অংশে লেগে যায় যা দ্রুত নকশা করতে সহায়তা করে এবং অল্প সময়ে সেন্সরের অনেক গুলো কপি বানানো সম্ভব হয়।

অনবদ্য মাহমুদা সুলতানা এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল ন্যানোটেক কাউন্সিলে নাসার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন, এবং নাসায় ও তাঁর কাজের জন্য অনেক পুরষ্কার ও সম্মান অর্জন করেছেন। তিনি ব্যবস্থাপনায় ও তাঁর সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন যখন তাঁকে গডার্ড ইন্সট্রুমেন্ট শাখার সহযোগী শাখা প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এটি এমন একটি পদ যা তাঁকে সহায়তা করবে তাঁর আবিষ্কারক দক্ষতা কে কাজে লাগিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের যন্ত্রপাতি ও মিশন তৈরি করতে।
গাডর্ড এর সিনিয়র প্রাযুক্তিক টেড সোয়ান্সন বলেন, “ সুলতানা বরাবরই উদ্যমী”। তিনি আরও বলেন, “ সুলতানা সবসময় নতুন প্রযুক্তির ব্যপারে হালনাগাদ থাকে। সে সবসময় তাঁর সহকর্মীদের মেধা আর দক্ষতাকে প্রভাবিত করে এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করে এবং তার জন্য অর্থনৈতিক সমর্থন খুঁজতেও পিছপা হয়না-সে হচ্ছে সফল উদ্ভাবনের হলমার্ক”।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশি বংশোউদ্ভুত এই তরুণী যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সাউথার্ন ইউনিভার্সিটির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ উচ্চতর শিক্ষা নেন। এরপর তিনি ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেন।