হ্যাক!!! শব্দটা শুনলে আমাদের বেশিরভাগের মাথাতেই হয়তো নিজ নিজ ফেসবুক আইডি চেক করার চিন্তাটা আগে আসে। চেক করে দেখতে ইচ্ছা হয় যে, নিজের একাউন্টখানা ঠিক আছে কিনা। কারণ আর কিছুই না, ফেসবুক একাউন্ট হ্যাকের ঘটনা আমাদের চারপাশে এত ঘটে থাকে যে, আমরা এর বাইরে চিন্তাই করতে পারিনা। অথচ বাইরের জগতে হ্যাকিং কিন্তু শুধু ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং ফেসবুক হ্যাকারদের হ্যাকারের কাতারে ফেলতেই অনেকে নারাজ। এর কারণ জানতে চাইলে আমাদের এখন আলোচনা করা লাগবে বিশ্বের বড় বড় কিছু হ্যাকার গ্রুপ এবং তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে। চলুন তবে বিশ্বের শীর্ষ(স্বীকৃত) দশ হ্যাকার গ্রুপ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
১. Tailored Access Operations, NSA
Snowden মুভিটা দেখেছেন? মুভির পুরো ঘটনাই কিন্তু বাস্তব ঘটনার হুবুহু অনুরূপ। Snowden যদি সব ফাঁস করে না দিত, আমরা সম্ভবত কোনোদিন Tailored Access Operations(TAO) সম্পর্কে জানতেই পারতাম না।এটি ইউএস সরকারের একটি সংস্থা। TAO এর ক্ষমতা অকল্পনীয়। স্নোডেন এর দেওয়া তথ্যমতে এখন আমরা জানি যে, এই সংস্থাটির প্রায় ৬০০ এর মত কর্মচারী আছে যারা মেরীল্যান্ডের মেইন NSA বিল্ডিং এ কাজ করে।

Source: LotusNet.org
হাওয়াই,জর্জিয়া,টেক্সাস এবং ডেনভার এও এদের শাখা আছে। তাদের কাছে QuantumSquirrel নামক এমন একটি টেকনোলজি আছে, যার মাধ্যমে তারা ইন্টারনেটে যে কোনো স্থান থেকে, যে কোনো ব্যক্তির পরিচয় চুরি করতে পারে এবং সে অনুযায়ী কার্যসিদ্ধি করতে পারে।শুধু তাই নয়। তারা এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন টেক-কোম্পানির উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের নিজেদের তৈরি প্রোডাক্টের মাঝেই নিরাপত্তার ফাঁকফোকর রাখে, যেন তাদের ভবিষ্যতে ওইসব যন্ত্রের সিকিউরিটি এক্সেস পেতে সুবিধা হয়।তারা চাইলে বিশ্বের যেকোনো মোবাইল/কম্পিউটার ডিভাইসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এক্সেস নিতে পারে এবং সেই ডিভাইসের মাইক্রোফোন/ক্যামেরা অন করে সেই ডিভাইসের আশেপাশের সকল অডিও এবং ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করতে পারে।
২. Elderwood Group and 20 other Chinese APTs
Elderwood Group, Axiom, Unit 61398, Comment Crew, Putter Panda, Hidden Lynx ইত্যাদি বিভিন্ন হ্যাকার গ্রুপের সমন্বয়ে চাইনিজ হ্যাকার সার্কেলটি গঠিত। এদের ফান্ডিং করে স্বয়ং চাইনিজ সরকার। জানামতে এখন পর্যন্ত এদের সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনাটি ঘটে ২০১০ সালে। যেটিকে ‘অপারেশন অরোরা’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে।যে অপারেশনের পর গুগল ঘোষনা করে যে,তারা হ্যাক হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া এই হ্যাকার গ্রুপটি বিভিন্ন ডিফেন্স ফার্ম, ওয়পন ইন্ডাস্ট্রী, বিজন্যাস ফার্ম ইত্যাদির ওয়েবসাইটও হ্যাক করে থাকে।
৩. APT28
এই হ্যাকার গ্রুপটি খুবই এডভান্সড। যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে, তা থেকে জানা যায় যে, এরা রাশিয়ান। এদের ফান্ডিং ও করে খোদ রাশান সরকার। রাশান সরকার তাদেরকে টার্গেট বাছাই করে দেয় এবং তারা সে মোতাবেক কাজ করে।এই গ্রুপটি খুবই কমন হ্যাকিং মেথডস ব্যবহার করে। তারা এপর্যন্ত ন্যাটো, পোলিশ গর্ভনমেন্ট ওয়েবসাইটস, জর্জিয়া মিনিস্ট্রিস এবং OSCE হ্যাক করেছে।

Source: The Hacker News
৪.Dragonfly
এই হ্যাকার গ্রুপটি আরেকটি স্টেট স্পন্সর্ড হ্যাকার গ্রুপ। এটির পেছনেও সম্ভবত আছে রাশান সরকার। এরা সাধারণত ইলেক্ট্রিক গ্রীড, এনার্জি ইন্ডাস্ট্রী এবং ইউরোপের ও আমেরিকার বিভিন্ন কন্ট্রোল সিস্টেম কে টার্গেট করে।তারা তাদের spearphishing এবং watering hole এটাকের জন্য সর্বাধিক পরিচিত।তারা বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রী’র ওয়েবসাইটে সিকিউরিটি ব্রীচ তৈরি করে এবং সময় এলে তা দখল করে নেয়।

Source: Sputnik International
৫. Tarh Andishan/Ajax
নানান প্রতিকুলতার মুখে পড়ে ইরান সরকার সিদ্ধান্ত নিল যে, অনেক হয়েছে! এবার দরকার শক্তিশালী সাইবার ফোর্স। এরই প্রেক্ষিতে তারা দুইটি দল গঠন করে। প্রথমটির নাম ‘Tarh Andishan’। এটির ফান্ডিং পুরোটাই সরকার করে থাকে। আরেকটি হলো ‘Ajax’j। এটি নানান ইরানিয়ান হ্যাকারদের চুক্তিবদ্ধ করে গঠিত হয়। কিন্তু এর সাথে সরকার সরাসরি সংযুক্ত থাকেনা। Ajax এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মিশন হলো ‘Operation Saffron Rose’। এই মিশনে তারা ইউএসএ’র ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রী’র বিভিন্ন ওয়েবসাইট দখল করে এবং বিভিন্ন ক্লাসিফাইড তথ্য সরানোর উদ্যোগ নেয়। সেদিক দিয়ে আবার Tarh Andishan এর কাহিনী সম্পূর্ণ অন্যরকম।এদের কাজ মূলত শত্রু দেশের বিভিন্ন এয়ারপোর্ট,গ্যাস-স্ট্যাশল ইত্যাদির সিকিউরিটি সিস্টেমের ক্ষতিসাধন করা।
৬. Anonymous
এই হ্যাকার গ্রুপটি সম্পর্কে আমরা সবাই হয়তো কমবেশি শুনেছি। ধারণা করা হয় যে, সম্ভবত এরাই হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সংঘবদ্ধ হ্যাকার গ্রুপ। পুরো পৃথিবী জুড়ে এদের সদস্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ২০০৩ সালে এদের উদ্ভব হয়। এদের সংঘবদ্ধতা এমন পর্যায়ে আছে যে, অপারেশন চলাকালে কেউ যদি ধরাও পড়ে, তবুও তাদের অপারেশন চলতে থাকে।বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয়না।

Source: The Hacker News
এখন পর্যন্ত এই গ্রুপটি অত্যন্ত সফলতার সাথে অনলাইন এবং অফলাইনে বিভিন্ন অপারেশন চালিয়েছে। তাদের বেশিরভাগ অপারেশনই হচ্ছে anti child pornography, anti-Church of Scientology ইত্যাদি। এত সংঘবদ্ধতার পরেও মজার ব্যপার হলো যে, তাদের নির্দিষ্ট কোনো নেতা নেই। তার মানে তারা কোনো একজনের নির্দেশে কাজ করেনা।আর এ ব্যপারটাই হয়তো তাদেরকে অন্যান্য গ্রুপ থেকে আলাদা করেছে। যদি কেউ নেতৃ্ত্ব নেওয়ার চেষ্টা করে, তবে তারা অত্যন্ত সুচারুভাবে তাকে দলত্যাগে বাধ্য করে।
৭. Syrian Electronic Army
এই হ্যাকার গ্রুপটি সিরিয়ান হ্যাকার দের নিয়ে গঠিত এবং সেইসাথে ইরান ও হিজবুল্লাহ’র সাথেও এদের ভাল যোগাযোগ আছে।বিভিন্ন কর্মকান্ড দ্বারা তারা এরই মধ্যে নিজেদের ক্ষমতা প্রকাশ করেছে।তাদের মূল টার্গেট হলো বিভিন্ন পশ্চিমা গণমাধ্যম।তারা বিভিন্ন মেলওয়ার ব্যবহার করে যে কারও অবস্থান বের করতে সক্ষম।
৮. Morpho
এই হ্যাকার গ্রুপটি ২০১১ সাল থেকে এপর্যন্ত অনেক হাই প্রোফাইল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, ইনভ্যাস্টম্যান্ট কোম্পানির ওয়েবসাইট সফল ভাবে হ্যাক করেছে।অন্যান্য হ্যাকিং গ্রুপের মত এদের পেছনে কোনো রাষ্ট্রের সহায়তা না থাকলেও প্রযুক্তির দিক দিয়ে এরা অন্যদের থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।এদের হিট লিষ্ট থেকে এমনকি মাইক্রোসফট,এপল,ফেসবুক এবং টুইটারও বাদ পড়েনি।

Source: www.esmis.government.bg
এই গ্রুপটি অন্য সবগুলো গ্রুপ থেকে আকারে ছোট কিন্তু সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং। তাদের বিভিন্ন সিগন্যাচারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মাল্টিপ্লাটফর্ম ম্যালওয়্যার, ডকুমেন্টেড কোড, বিটকয়েনস ইত্যাদি। তারা সবাই ইংলিশ স্পীকার এবং নিজেদের ট্রেক লুকাতে সিদ্ধহস্ত।
৯. Chaos Computer Club
এই গ্রুপটি হয়তো লিস্টে একমাত্র গ্রুপ, যারা কোনো নীতি মেনে চলে এবং হ্যাকার গ্রুপের মাঝে এরাই হয়তো সবচেয়ে পুরাতন। ১৯৮১ সালের দিকে একদল জার্মান হ্যাকার এই গ্রুপটি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এই গ্রুপটি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে বিশাল রুপ ধারণ করেছে। এর সদস্যের বেশিরভাগই হলো জার্মানভাষী।তাদের বিভিন্ন নীতিসম্বলিত কাজের জন্য তারা মাঝে মাঝেই সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়। যেখানে তাদের গুণগানই করা হয়ে থাকে।

Source: CNN.com
১০. Bureau 121
আউট-ডেটেড টেকনোলোজিন নিয়েও উত্তর কোরিয়ার সরকার হ্যাকিং এর প্রতি যে পরিমাণ আগ্রহ দেখাচ্ছে, তা রীতিমত কৌতুহলদ্দীপক।স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি থেকে সরকার প্রতিবছর মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের রিক্রুট করে নতুন নতুন গ্রুপ গঠন করে। মিলিটারি একাডেমী থেকেও সেই সাথে হ্যাকার নিয়োগ করা হয়ে থাকে।এদের মূল টার্গেটে থাকে মূলত দক্ষিণ কোরিয়া।কিন্তু অন্যান্য দেশের উপরও এরা সুযোগ পেলে আক্রমণ করে।উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় যে,কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে যে টাকা চুরি হয়ে গিয়েছিল, তাদের পেছনেও এইসব কোরিয়ান গ্রুপের হাত আছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।