“হারানো রাজ্য” কথাটি শুনলেই মনে প্রশ্ন জাগে, আস্ত একটা রাজ্য কিভাবে হারিয়ে যেতে পারে? এও কি সম্ভব? কথাটি আর্থারিয়ান লেজেন্ড এ, বিশেষভাবে বীর ট্রিস্টান এবং ইসেউল্ট এর গল্পে উল্লিখিত একটি দেশ লায়োনেস এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে দেশটিকে ধরা হত কর্নওয়াল এর সীমানা হিসেবে। বীর ট্রিস্টান এর জন্মভূমি লায়োনেস আদর্শ এবং সুন্দর এক রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল যেখানে বাস করত উচ্চবংশীয় সুদর্শন বীর যোদ্ধারা। ঈশ্বরের প্রতি লায়োনেস এর জনগণ এতটাই অনুগত ছিল যে, তারা ১৪০টি চার্চ স্থাপন করেছিল । অনেকের মতে তারা বিশাল এক ক্যাথেড্রালও স্থাপন করেছিল। তাহলে এমন কি ঘটেছিল যার কারণে লায়োনেসকে “হারানো রাজ্য” হিসেবে আখ্যায়িত করতে হচ্ছে? তাহলে চলুন, জেনে আসি।
হারানো রাজ্য লায়োনেস
বলা হয়, কর্নওয়ালের পশ্চিম প্রান্ত থেকে স্কিলি(Scilly) পর্যন্ত ৩০ মাইল বিস্তৃত সুন্দর এক রাজ্য ছিল যার নাম ছিল লায়োনেস। এই রাজ্যে বসবাস করত শক্তিশালী এবং সুদর্শন সব মানুষ যারা সেখানকার উর্বর জমিতে ফসল ফলাতো। ১৪০টি চার্চ এবং একটি নয়নাভিরাম বিশাল ক্যাথেড্রাল ছিল রাজ্যের রাজমুকুট। তবে লেজেন্ড বলে, এই রাজ্যকে এক রাতের মধ্যেই গ্রাস করে ফেলে উত্তাল সমুদ্র।সাগরের অতলে হারিয়ে যাওয়া এই রাজ্যকে নিয়ে বহু লোককাহিনী প্রচলিত আছে এবং প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, প্রশান্ত কোন একদিনে পশ্চিন কর্নিশ উপকূল ছাড়িয়ে সমুদ্র থেকে এখন ভেসে আসে চার্চ এর ঘণ্টাগুলির মধুর আওয়াজ। অনেকের মতে, শান্ত দিনে নয়, বরং প্রচণ্ড ঝড়ের সময় ভেসে আসে চার্চের ঘণ্টাগুলির শিহরণ জাগানো আওয়াজ।
লায়োনেস এর অবস্থান
যদিও লায়োনেসকে কর্নওয়ালের সীমানা বলা হয়, তারপরও এর সঠিক অবস্থান নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক রয়েছে। প্রথমত, লেজেন্ড অনুযায়ী ধারণা করা হয়, বর্তমানে স্কিলি এর যে স্থানে সাত প্রস্তরের প্রবাল প্রাচীর(Seven stones reef) রয়েছে, সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিল লায়োনেস এর বিশাল ক্যাথেড্রালটি। দ্বিতীয়ত, প্রথমদিকের রোমান্সারগণ যারা ট্রিস্টান এবং ইসেউল্ট(Tristan and Iseult) এর কাহিনীর নায়ক ট্রিস্টান এর কথা উল্লেখ করেছেন, তাদের মতে লায়োনেস হতে পারে বর্তমান স্কটল্যান্ড যাকে প্রাচীন ফ্রেঞ্চ ভাষায় লোইনোয়(Loinois) বলা হত, অথবা ব্রিটানিতে অবস্থিত লিওন(Leonais)। তৃতীয়ত, যদি ব্রিটানি এর লিওন লায়োনেস এক নাও হয়ে থাকে, তবুও এই দুই জায়গার মধ্যে কোন না কোন যোগসূত্র আছে। বলা হয়, ট্রিস্টান এর কাহিনীগুলো যে সময়ে ঘটে, তার কিছু পরেই লায়োনেস সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়। কর্নওয়ালের ঐতিহ্যের সাথে লায়োনেস ওতপ্রোত ভাবে জড়িত আর সেই কারণে যদি বলা হয় যে স্কিলি দ্বীপপুঞ্জে লায়োনেস অবস্থিত ছিল, খুব একটা ভুল হবে না।
নিওলিথিক মানুষেরা সেই সময়ে স্কিলিতে বসবাস করত যে সময়ে দ্বীপগুলো একটির সাথে আরেকটি সংযুক্ত ছিল। তারা অনেকগুলো সমাধিস্তম্ভ তৈরি করেছিল, সাথে তৈরি করেছিল অনেকগুলো প্রাচীর এবং কুঁড়েঘর যেগুলোর বর্তমান ঠিকানা জলসীমার নিচে। তবে ধরে নেয়া যায়, অতীত থেকেই দ্বীপপুঞ্জের সংযোগস্থল বন্যা প্রবণ এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। রোমানরা সেই এলাকার নাম দিয়েছিল স্কিলোনিয়া ইনসুলা(Scillonia insula) যা দিয়ে একটি মাত্র দ্বীপ অথবা একটি মূল দ্বীপকে বোঝানো হত। ৫ম এবং ৬ষ্ঠ শতকের দিকে দ্বীপগুলি বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করলেও এখনকার মত পানিতে নিমজ্জিত ছিল না, আর ছোট একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার মত যথেষ্ট পরিমানে ভূমি সেখানে বিদ্যমান ছিল। সেই সময়েই কেন্দ্রীয় সমতল ভূমি প্লাবিত হয়েছিল এবং আজ পর্যন্ত প্লাবিত হয়েই চলেছে। গত দুইহাজার বছরের মধ্যে স্কিলি দ্বীপপুঞ্জের চারপাশের জলসীমা ৫ মিটার পর্যন্ত উন্নীত হয়েছে।
স্কিলিতে জেলেপাড়ায় লায়োনেস নিয়ে বেশ কিছু লোককাহিনী প্রচলিত আছে। জেলেদের মতে, সেভেন স্টোনস রিফ নির্দেশ করে সেই জায়গার, যেখানে আগে বিদ্যমান ছিল হারিয়ে যাওয়া লায়োনেস রাজ্যের একটি শহর যাকে বলা হত “দ্য সিটি অফ লায়ন্স” এবং মূল স্থলভূমি ও স্কিলি এর মাঝখানে যে স্থানটি পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে হারিয়ে গেছে সেই জায়গাকে বলা হয় লেথেসো(Lethesow) অথবা লেথোসো (Lethowsow)। জেলেদের জালে উঠে আসত চুম্বকের টুকরো সহ আরও অনেক কিছু। ঝড়ের সময় পানির নিচ থেকে ভেসে আসত চার্চ এর ঘন্টার শব্দ। মূল ভূখণ্ডের চারপাশে সেইন্ট মাইকেলস মাউন্ট( St. Michel’s mount) এর কাছের এলাকাগুলো হল ডুবে যাওয়া ফসিলাইজড বনের অংশাবশেষ, যা স্কিলি অঞ্চলের অংশ ছিল।
আর্থারিয়ান লিজেন্ড এ লায়োনেস
মধ্যযুগীয় আর্থারিয়ান লিজেন্ড এ লায়োনেস এর ডুবে যাওয়ার কোন উল্লেখ নেই কারণ নামটি এমন এক জায়গাকে নির্দেশ করে যা এখনো বিদ্যমান। লায়োনেস লিজেন্ড এর উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য এখন পাওয়া যায় নি। তবে আর্থারিয়ান লিজেন্ড এর সাথে লায়োনেস রাজ্যের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায়। আর্থারিয়ান লিজেন্ডের এক বীর ট্রিস্টান এর বাবার রাজ্য ছিল এই লায়োনেস। তবে লায়োনেস এর ঐতিহ্যবাহী কিছু রাজার অস্তিত্ব এবং কিছু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানা গেলেও তার সত্যতা এখনো প্রমাণিত হয় নি। ধরে নেয়া হয় যে, লায়োনেস রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল করনুবিয়ার রাজা মারশিয়ন আব কাস্তেনিন(Merchion ab Custennyn) এর সময়ে।
কেলটিক মিথলজিতেও লায়োনেস এর উল্লেখ আছে। এর সম্ভাব্য উৎস হিসেবে ধরে নেয়া যায় ব্রোঞ্জ যুগে জলসীমা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে স্কিলি দ্বীপপুঞ্জ এবং মাউন্ট বে এর কাছে অবস্থিত পেন্সেন্স এর বন্যা। এই ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায় সেইন্ট মাইকেলস মাউন্ট এর কর্নিশ নাম থেকে (Karrek Loos y’n Koos ) থেকে যার অনুবাদিত অর্থ দাঁড়ায় ‘বনের ভেতরে সাদা পাথর’ যা নির্দেশ করে যে, মাউন্ট বে এক সময় বন ছিল। স্কিলি দ্বীপপুঞ্জের আশেপাশের এলাকায় ব্রোঞ্জ যুগের বেশ কিছু আলামত খুঁজে পাওয়া গেছে যে সময় এলাকা গুলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উপরে ছিল। পেন্সেন্স এর নিকটে অবস্থানরত কর্নিশ জনগণ এখন মাউন্ট বে এর জঙ্গলের ফসিলে পরিণত হওয়া গাছের গুড়ি দেখতে পায় যখন সমুদ্রের পানির উচ্চতা কমে আসে।
লায়োনেস রাজ্য সমুদ্রে তলিয়ে গেলেও একে নিয়ে জড়িত বিভিন্ন কাহিনী এবং গল্পের প্রচলনের ফলে মানুষের মন থেকে হারিয়ে যায়নি এখনও। সমুদ্রে তলিয়ে যাবার পূর্বে মানুষ যেমন চার্চ এর ঘন্টার ঢং ঢং শব্দ শুনতে পেত, এখনও যেন সেই জায়গা হঠাৎ হঠাৎ ঘণ্টার ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। এ যেন শেষ হয়েও হইলনা শেষ…………।
তথ্যসুত্রঃ
১. http://www.historyfiles.co.uk/KingListsBritain/BritainLyonesse.htm
২. https://www.cornwalls.co.uk/myths-legends/lyonnesse.htm
৩. https://maryanneyarde.blogspot.com/2016/03/lyonesse-lost-city-in-arthurian
৪. https://en.wikipedia.org/wiki/Lyonesse