গঙ্গা নদীতে স্নান করছেন এক বৃদ্ধ দম্পতি। নিয়মিত তারা ধর্মকর্ম করে দিন কাটান। এদিন তাদের চোখে পড়ল একটি সোনার পেটিকা নদীর জলে ভেসে যাচ্ছে। রথচালক অধিরথ স্ত্রী রাধার অনুরোধে পেটিকাটি তীরে তুলে আনেন। কিন্তু ভিতরে তাকিয়েই তারা চমকে উঠেন। ভেতরে যে সদ্য জন্মপ্রাপ্ত এক মানব শিশু! দেহের বর্ণ আর কবচ-কুন্তল দেখে তাদের বুঝতে বাকি থাকে না, এ ছেলে সাধারণ কোন বংশের নয়। কিন্ত যে কারণেই হোক বাচ্চাটি স্বীকৃতি আর মাতৃস্নেহ থেকে শুধু বঞ্চিতই নয়, তাকে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে মারা যাবার সম্ভাবনা আছে জেনেও। কে জানে, হয়তোবা মৃত্যুর মুখেই তাকে সঁপে দেয়া হয়েছিল। কিন্ত বাচ্চাটি তো এখনই মরতে পারে না! নিয়তি যেন তাকে আরো বড় কোন খেলায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। কুরুক্ষেত্রের যে খেলায় মারা যাবে লাখ লাখ মানুষ, মুখোমুখি হবে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা। আজকে মহাভারতের আরেক হতভাগ্য চরিত্রের সম্পর্কে জানা যাক, যিনি সারাটা জীবন যেন নিয়তির পরিহাসের শিকার হয়েছেন। তিনি প্রথম কুন্তীপুত্র , কর্ণ।
নিঃসন্তান রাধা-অধিরথ দম্পতি বাচ্চাটিকে নিজের সন্তানের মত করেই মানুষ করতে থাকেন। তাদের কাছে বাচ্চাটি ছিল ভগবানের আশীর্বাদ। ক্রমে ছেলেটি বড় হল, সমাজে পরিচিতি হল সূতপুত্র কর্ণ হিসেবে, কেননা অধিরথ ছিলেন রথচালক। তৎকালীন সমাজে রথচালক গোষ্ঠী সূত নামে পরিচিত ছিল। তিনি সবসময়ই দেখে এসেছেন, মানুষের কাছে তার সূতপুত্র পরিচয়ই যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার মেধার থেকে। এজন্যই হয়তোবা তার মধ্যে নিজেকে সবার সামনে প্রমাণ করার একটা ব্যগ্রতা ছিল। তিনি যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হবার ইচ্ছা পোষণ করতেন। তাই ভারতবর্ষের অন্যতম সেরা যোদ্ধা পরশুরামের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কিন্ত পরশুরাম ব্রাহ্মণ বংশীয় ছাড়া কাউকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করতেন না। কর্ণ নিজেকে ব্রাহ্মণ বংশের পরিচয় দিয়ে । কিন্ত তার এই ছোট্ট মিথ্যা কথাটিও একসময় প্রকাশ পেয়ে যায় গুরুর সেবা করতে গিয়েই।
কর্ণের একাগ্রতা, অধ্যবসায়, সাধনা ছিল যে কোন শিক্ষককে মুগ্ধ করার মতই। তিনি গুরু পরশুরামের কাছ থেকে বিভিন্ন কঠিন অস্ত্রকৌশল রপ্ত করেন। একসময় তার গুরুভক্তি ও সাধনায় খুশি হয়ে পরশুরাম তাকে ব্রহ্মাস্ত্র দান করেন। এই বিধ্বংসী অস্ত্র কেবল অল্প কয়েকজনের কাছেই ছিল। এদের মধ্যে আছেন তার প্রাক্তন ছাত্র দ্রোণ আর দ্রোণাচার্যের ছাত্র অর্জুন। পরশুরাম বিশ্বাস করতেন যে, কোন ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারো হাতে ব্রহ্মাস্ত্র নিরাপদ নয়। আর কেবল ব্রাহ্মণ হলেই হবে না তার মধ্যে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রভাব থাকতে হবে, কেননা ব্রহ্মাস্ত্র হাজার হাজার মানুষ ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। কর্ণ কেবল শস্ত্রবিদ্যায় নয়, শাস্ত্রবিদ্যাতেও দক্ষ ছিলেন। তাই তাকে ব্রহ্মাস্ত্র প্রদানে কোন বাধা আছে বলে পরশুরাম মনে করেন নি।

একদিন পরশুরাম উপবাসে ক্লান্ত বোধ করছিলেন। পাশে কর্ণ থাকায় তার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। এমন সময় একটা ব্রহ্মকীট, যাকে খাঁটি বাংলায় কাঁকড়া বিছে বলা যায় কর্ণের ঊরুতে কামড় দেয়। পাছে গুরুর ঘুমের ব্যাঘাত হবে ভেবে কর্ণ চুপ করে বসে থাকেন কষ্ট সহ্য করে। কিন্ত বিধি বাম! রক্তের কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে পরশুরামের গায়ে পড়লে চকিতে তার ঘুম ভেঙে যায়। তিনি সবকিছু দেখে কেমন হকচকিয়ে যান। তার অভিজ্ঞতা বলে, কোন ব্রাহ্মণ কাঁকড়া বিছের অসহ্য কামড় সহ্য করা ক্ষমতা কোন ব্রাহ্মনের নেই। কিন্ত কর্ণ গুরুর ঘুম ভাঙার ভয়ে চুপ করে কষ্ট সহ্য করেছেন। তিনি অতি অবশ্যই ব্রাহ্মণ নন।
এবার কর্ণও আর নিজের পরিচয় লুকান না। সাথে এও যোগ করেন শুধুমাত্র নীচ বংশের ছেলে বলে কেন তিনি বড় কোন স্বপ্ন দেখতে পারবেন না? এতদিন কি তিনি প্রমাণ করেননি যে মেধা আর অধ্যবসায়ের দিক থেকে তিনি কোন ব্রাহ্মণের চেয়ে কম না? হ্যাঁ, তিনি মিথ্যা বলেছেন, কিন্ত তিনি চেয়েছিলেন কেবল বিদ্যার্জন করতে আর কিছু নয়। তার বংশপরিচয় যদি তার শিক্ষার পথে বাধা হয় তিনি আর কিই বা করতে পারতেন। কিন্ত এতে তেমন লাভ হয় না। পরশুরাম যদিও কোন যৌক্তিক উত্তর দিতে পারেন না, কিন্ত এত দিনের সংস্কার ভুলতেও পারেন না। শিষ্যত্ব তো কর্ণ হারানই, সাথে পরশুরামের কাছে এই অভিশাপ পান যে চরম প্রয়োজনের মুহূর্তে তিনি ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপণ কৌশল ভুলে যাবেন। তবে তার গুরুভক্তির জন্য কিছুটা হলেও মমতা তখনো রয়ে গেছে বিধায় এই আশীর্বাদও করেন যে কোন সাধারণ ক্ষত্রিয় তার সাথে যুদ্ধে পেরে উঠবে না।

হস্তিনাপুর ফিরে আসেন কর্ণ। এসে দেখেন রাজা ধৃতরাষ্ট্রের একশ ছেলে আর পঞ্চপাণ্ডবের অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। গুরু দ্রোণাচার্য তাদের জন্য এক সমরবিদ্যা প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। কর্ণ দেখলেন এই তার সুযোগ নিজেকে প্রমাণ করার। তিনি ঠিক করলেন অর্জুনকে আমন্ত্রণ জানাবেন একটি দ্বৈরথের জন্য। কিন্ত এবারও নিজের বংশপরিচয়ের জন্য সুযোগ পেলেন না। রাজপুত্র অর্জুন কোন সাধারণ সূতপুত্রের সাথে দ্বৈরথে নামবেন না। এ কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র দুর্যোধন কর্ণকে অঙ্গরাজ্যের অধিপতি নিযুক্ত করেন। দুর্যোধন সর্বদা পঞ্চপাণ্ডবকে অপদস্থ করার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকতেন। কর্ণ যেন সে সুযোগ এনে দিলেন। কিন্ত পাণ্ডব জননী কুন্তি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সংবাদ পাওয়ায় প্রদর্শনী তখনই বন্ধ করে দেয়া হয় আর কর্ণ তার সুযোগ হারান। যা ছিল শুধুই নিজেকে প্রমাণ করার প্রতিযোগিতা, সুযোগ না পেয়ে তা যেন রূপ নিতে লাগল তিক্ত শত্রুতায়।
এরপর অনেকদিন কেটে যায়। রাজা ধৃতরাষ্ট্র আর দুর্যোধনের ষড়যন্ত্রে পঞ্চপাণ্ডব আর তাদের মা কুন্তি দেবী যাযাবরের মত ব্রাহ্মণ বেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পরিচয় লুকিয়ে। রাজসিংহাসনের প্রতিদ্বন্দ্বী সরানোর জন্য দুর্যোধন তাদের লাক্ষাগৃহে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করেছিলেন। কুন্তি দেবী তার পাঁচ ছেলেকে নিয়ে পালাতে সক্ষম হন, কিন্তু যে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের মৃত্যুর, তা ভুল প্রমাণ করতে তারা কোন প্রয়াস তখনো নেননি। এরমধ্যে তারা একদিন জানতে পারলেন যে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ তার কন্যা, দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করেছেন। দ্রুপদের কন্যাকে নিয়ে জনশ্রুতি আছে যে, দ্রৌপদী জন্ম নিয়েছেন তার ভাই ধৃষ্টদ্যুম এর সাথে এক যজ্ঞের মাধ্যমে, তার বাবার অপমানের প্রতিশোধ নিতে, দ্রোণাচার্য আর কুরুরাজ্যের ধ্বংস সাধনে। তারা নিতান্ত কৌতূহলের বশেই স্বয়ম্বর সভায় যান। গিয়ে দেখেন সেখানে যেন একটি মেলা বসেছে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেমন দর্শনার্থী এসেছে তেমনি এসেছেন বিভিন্ন রাজ্যের রাজন্যবর্গ। আর স্বয়ম্বরের শর্তও প্রায় অসম্ভব। একটি লক্ষ্য ভেদ করতে হবে তীর ছুঁড়ে । কিন্তু সে জন্য যে ধনুক রাখা হয়েছে তার জ্যাতে তীর লাগাতেই সবাই অসমর্থ হচ্ছেন। আর যদি কেউ প্রাথমিক কাজটা করতে পারেনও পরের অংশের তুলনায় আগের অংশ তুচ্ছ। লক্ষ্যভেদ করতে হবে নিচে রাখা পানির পাত্রের মধ্যে প্রতিফলন দেখে উপরে থাকা লক্ষ্যবস্তুতে যার সামনে একটি বস্তু চরকির মত ঘূর্ণায়মান। একে একে অনেক রাজা-রাজপুত্র চেষ্টা করলেন, ব্যর্থ হলেন সবাই। এসেছিলেন দুর্যোধন, তার সাথে কর্ণ। দুর্যোধন গদাযুদ্ধে দক্ষ, তীর চালনায় অতটা নয়। কর্ণ শর্ত দেখেই বুঝেছিলেন এটি তিনি সহজেই পারবেন, তারপরও কৃতজ্ঞতা আর সৌজন্যতা বশত দুর্যোধন ব্যর্থ হবার পরই তিনি এগিয়ে যান। কিন্ত আবার যেন নিয়তি তার সাথে রসিকতা করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। যেইমাত্র তিনি ধনুক হাতে নিয়ে তাতে তীর রোপণ করলেন, দ্রৌপদী বলে উঠলেন, ‘সামান্য সূতপুত্রকে মালা প্রদান করার বদলে আমি বরং আত্মহত্যা করব’।

Source: Pinterest
এ কথা শোনার পর থেমে গেলেন কর্ণ, হয়তোবা ভাগ্যের রসিকতায় তিক্ত হাসিও হাসলেন! তিনি দ্রৌপদীকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘আমার জন্য আপনার আত্মহত্যা করতে হবে না, আপনি দীর্ঘজীবী হোন’। অথচ স্বয়ম্বরের শর্তে কোথাও জাতপাতের কথা বলা নেই, শুধু বলা হয়েছিল যে লক্ষ্যভেদ করতে পারবে, দ্রৌপদী তাকেই মালা পরাবেন। কিন্ত তারপরও কর্ণ এসব শর্তের কথা না তুলে চুপ করে ফিরে আসেন। এতক্ষণ সব কিছু দেখেশুনে উঠে দাঁড়ালেন এক ব্রাহ্মণ তরুণ।
ব্রাহ্মণ তরুণ সামনে যাওয়ার সাথে সাথেই চারদিকে হাসির রোল উঠল। এত বড় বড় যোদ্ধারাই যেখানে ব্যর্থ, সেখানে সাধারণ এক ব্রাহ্মণের চেষ্টা করার দৃশ্য সাধারণের জন্য হাস্যকর বৈকি! কিন্ত এটি ছিলেন অর্জুন, ব্রাহ্মণবেশে। তিনিও কর্ণের মত তার মেধার তুলনায় এত সাধারণ পরীক্ষা দেখে আর স্থির থাকতে পারছিলেন না। পাশ থেকে তার ভাই ভীমও তাকে উৎসাহ দিলে সব দ্বিধা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ান। খুব সহজেই ধনুকে তীর রোপণ করেন তিনি, সেই সাথে হয়তোবা রোপণ করলেন পুরনো একটি তিক্ততা নতুন করে জাগিয়ে তোলার বীজ। তিনি একটির পর একটি তীর অনায়াসে লক্ষ্যবস্তু ভেদ করান। দ্রৌপদীও তাকে মালা পরান। আর ওদিকে কর্ণ কোন যথাযোগ্য কারণ ছাড়াই নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগই পান না। এভাবে নিয়তি যেন তাদের সবাইকে নিয়ে যাচ্ছে এক বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের দ্বারপ্রান্তে, কিন্ত নিয়তির সে খেলা মানুষ কতটুকুই বা বুঝে।
এ ঘটনার অনেকদিন পর ছয় ভাই, হ্যাঁ, ছয় ভাই আবার মিলিত হবেন। যেখানে একটি পাতানো খেলা, কয়েকটি ভুল সিদ্ধান্ত আর কিছু কথা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে সবাইকে। যেখানে কর্ণ আবার ভাগ্যের নির্মম রসিকতার শিকার হবেন। জানতে পারবেন নিজের আসল বংশপরিচয়।
তথ্যসূত্রঃ
১. পাঞ্চ্যজন্য – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
২. মহাভারত – আর কে নারায়ণ
buy levofloxacin 500mg generic cheap levaquin 250mg
2008 Mar 10; 26 8 1386 7 cialis buy online usa