পাইতিতি: ইনকা বীরের হাতে গড়ে ওঠা স্বর্ণের শহর

2

কখনও কি ভেবে দেখেছেন এমন এক শহরে বাস করার কথা যেখানে সবাই ধনী? যেখানে দারিদ্র্যের ছিটে ফোটাও নেই? সব কিছু স্বর্ণে  মোড়ানো? এল ডোরাডো এর কথা আমরা সকলেই কম বেশি শুনেছি। আমাদের ইতিবৃত্তেও এল ডোরাডো নিয়ে লেখা হয়েছে। কিন্তু আমরা পাইতিতি র কথা শুনেছি কি? কয়েক শতাব্দী ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও সম্প্রতি এই শহরের আবিষ্কার আবার নতুন করে এই প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটিয়েছে, সত্যিই কি স্বর্ণের তৈরি কোন শহরের অস্তিত্ব ছিল পৃথিবীর বুকে?

পাইতিতি কি?

হারিয়ে যাওয়া লিজেন্ডারি ইনকা শহর। এই শহরকে কাল্পনিক ধনী শহর বললেও ভুল হবে না। ইনকা মিথলজির অনেক  আকর্ষণীয় গল্পকাহিনীর মধ্যে অন্যতম হল পাইতিতির গল্প। বর্তমানে দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে জটিল প্রত্নতাত্ত্বিক ধাঁধা পাইতিতি। বছরের পর বছর বহু অনুসন্ধানকারী, গুপ্তধন শিকারি এবং প্রত্নতত্ত্ববিদেরা পাইতিতির সন্ধানে হন্যে হয়ে খুঁজলেও লিজেন্ডারি শহর খুঁজে পাওয়া এত সহজ নয়।  লিজেন্ড বলে, পাইতিতি ছিল বিশাল এক শহর যা অবস্থিত ছিল অ্যামাজন জঙ্গলের পেরু অংশে। কিন্তু ৫০ বছর আগে থেকে পাইতিতি নিয়ে গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় পেরুভিয়ান আমাজনিয়া।

পাইতিতির অবস্থান এখনও এক রহস্য
পাইতিতির অবস্থান এখনও এক রহস্য

স্বর্ণের শহর পাইতিতির সন্ধানে বহু অভিযাত্রী দিন রাত এক করে ফেলেছেন এবং অনেকে দৃঢ় ভাবে বিশ্বাসও করেন যে এই শহর লুকায়িত ছিল আমাজনের সর্বশেষ আবিষ্কৃত অঞ্চলে। পাইতিতির সন্ধানে অখ্যাত অভিযান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল “দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড” রচনা করেছিলেন।

পাইতিতির ইতিহাস

রহস্যময় এই পাইতিতি খোঁজার অভিযান নিয়ে  অনেক ধরণের ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়েছে। লিজেন্ড মতে, সোনার শহর পাইতিতি প্রতিষ্ঠিা করেছিল ইনকা বীর ইনকারি, যিনি স্প্যানিশ আক্রমণের পরে জংগলে আশ্রয় নেবার পূর্বে কুস্কো শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যখন স্প্যানিশরা কুস্কোতে প্রবেশ করে, সেখানে তারা লুটপাট চালায়। কিন্তু লুটপাট চালিয়ে ইনকাদের পুরনো রাজধানীতে অবশিষ্ট খুব সামান্যই খুঁজে পায় তারা। আসল সম্পদের খোঁজ কখনও পাওয়া যায় নি। স্প্যানিশদের আসার পূর্বেই ইনকারা তাদের স্বর্ণময় সম্পদ কোথাও লুকিয়ে ফেলেছিল।

ইনকা সংস্কৃতি একটি শহরের কথা বলে যার অবস্থান কুস্কো শহরের আন্দিজ অংশের পূর্ব দিকে এক জঙ্গলের গভীরে। স্প্যানিশদের আক্রমণের সময় ইনকারা সেখানেই আশ্রয় নিয়েছিল বলে ধরে নেয়া হয় এবং ধরে নেয়া হয়, এই জংগলই ছিল তাদের শেষ আশ্রয় স্থল।

পাইতিতি আবিষ্কারের প্রয়াস

২০০১ সালে ইটালিয়ান প্রত্নতত্ত্ববিদ মারিও পোলিয়া ভ্যাটিকান আর্কাইভ থেকে আন্দ্রেস লোপেজ নামের এক মিশনারির করা রিপোর্ট আবিষ্কার করেন যা ১৬০০ সালে তৈরি করা হয়েছিল। লোপেজের করা ডকুমেন্ট থেকে সোনা, রূপা এবং মহামুল্যবান রত্নে পরিপূর্ণ একটি শহরের কথা জানা যায় যার অবস্থান ছিল গ্রীষ্মপ্রধান জঙ্গলের মাঝখানে। সেখানকার লোকেরা শহরটির নাম দিয়েছিল পাইতিতি। লোপেজ তার এই আবিষ্কারের ব্যাপারে পোপকে জানান এবং কয়েক যুগ পর্যন্ত পাইতিতির অবস্থান গোপন করে রেখেছে ভ্যাটিকান নগরী।   

 গ্রেগ ডেয়ারমেঞ্জিয়ান
গ্রেগ ডেয়ারমেঞ্জিয়ান

২০০১ থেকে শুরু করে পরবর্তী দুই বছর একটি ফিনিশ/ বলিভিয়ান দল পাইতিতির খোঁজে দুর্গম জঙ্গল চষে বেরিয়েছিল। তারা বলিভিয়ার কাছে রিবেরালতা অঞ্চলে কিছু ধ্বংসস্তূপ খুঁজে পায় যেখানে ইনকা মৃৎশিল্পের চিহ্ন পাওয়া গেলেও কোন সোনা বা রূপা বা মুল্যবান কোন পাথর পাওয়া যায়নি।

২০০৮ সালে পেরুর জাতীয় সংবাদ সংস্থার করা একটি রিপোর্টে জানা যায় যে, কিম্বিরি জেলায় একটি “প্রত্নতাত্ত্বিক দুর্গের” সন্ধান পাওয়া গেছে এবং সেখানকার মেয়রের প্রস্তাব অনুযায়ী, সেখানেই ছিল ইনকাদের লিজেন্ডারি শহর পাইতিতি।  

বিখ্যাত অভিযাত্রী গ্রেগ ডেয়ারমেঞ্জিয়ান পাইতিতির আবিষ্কারের ব্যাপারে তার বিশেষ একনিষ্ঠতা সম্পর্কে  বলেন, “ইনকাদের সর্বশেষ আশ্রয়, পাইতিতির খোঁজে আমার অভিযান শুরু হয় ১৯৮১ সালে ভিলকাবাম্বার মানকো ইনকার দুর্গ দেখার পর- যিনি প্রায় ৩ বছর স্প্যানিশদের কঠোর শাসনের অবসান ঘটিয়ে  বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন- যা অবস্থিত ছিল মাচুপিচুর উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত লা কনভেনসিয়ন প্রদেশে বনভুমিতে ঘেরা এসপিরিটু পাম্পা নামের সমতল অঞ্চলে। তখনই আমি জানতে পারি তার পূর্বদিক ছাড়িয়ে একটি গোপন অঞ্চলের কথা; যেখানে আন্দিজ এবং আমাজনিয়া জঙ্গল মিলিত হয়েছে পাহাড়, গিরিখাত এবং বিচ্ছিন্ন পর্বত শৃঙ্গে, যার সমস্তই ছিল জঙ্গল এবং পাথুরে দুর্গম নদী ও নদী প্রবাহ দ্বারা আবৃত। এবং ১৯৮৪ সালে আমি সেখানে যাত্রা শুরু করলাম, কুস্কো শহরের উত্তরে এবং উত্তর পূর্ব দিকে; প্রথমে কুস্কিনো শিকারিদের সাথে যারা পাউকার্টাম্বোতে নিজেদের সম্পদের খোঁজ করছিল এবং পরবর্তীতে চালাবাম্বা উচ্চভুমি ও ক্যালকা এর বাসিন্দা কেচুয়া-ভাষাভাষীদের সাথে, আর কুস্কিনোদের মাধ্যমেই তাদের সাথে আমার দেখা হয়েছিল।“

 গ্রেগ ডেয়ারমেঞ্জিয়ান ( সর্ব বামে ) এবং তার অভিযাত্রী দল
গ্রেগ ডেয়ারমেঞ্জিয়ান ( সর্ব বামে ) এবং তার অভিযাত্রী দল

১৯৯৪ সালের শুরুর দিকে গ্রেগ এবং তাঁর অভিযাত্রী দল পেরুর বিখ্যাত অভিযাত্রী ড. কার্লোস নিউএনশওয়ান্ডার এর সাথে একসাথে পাইতিতির সন্ধানে কাজ করা শুরু করেন। ড. কার্লোস নিজেও ১৯৫০ সাল থেকে পাইতিতি এবং পান্তিয়াকোলা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। কিন্তু পাইতিতির সন্ধানে এই অভিযানের জন্য একটি হেলিকপ্টার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায় যা সেই সময় ফান্ডের অভাবে তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সে কারণে তাঁরা বিকল্প পন্থায় তাদের অভিযান চালাতে থাকেন। ১৯৯৯ সালের মধ্যে তাঁরা কুস্কো থেকে পান্তিয়াকোলা তে হেলিকপ্টার নিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরবর্তী এক সপ্তাহ তাঁরা দুর্গম পথ বেয়ে নীচে নামতে নামতে তিম্পা উপত্যকায় এসে পৌঁছান।

তারপর আরও অনেক পথ বন নদী পেরিয়ে পুনরায় উঁচু ভুমিতে এসে উপস্থিত হন। ১৯৯৫ সালে চালাঙ্গা থেকে পশ্চিমের পার্বতীয় অঞ্চলে যাত্রা করার সময় আন্দিজের পূর্ব সীমানা থেকে তারা বিশাল এক পর্বত প্রাচীর দেখতে পান যে পর্বত প্রাচীর কোন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় পর্বতের ক্ষেত্রে বিরল। আর আশেপাশের এলাকায় কিছু ধ্বংসস্তূপ ছিল যা পাদ্রে হুয়ান কার্লোস পলেন্তিনির বর্ণনা অনুযায়ী, হতে পারে লিজেন্ডারি পাইতিতি শহরের ধ্বংসাবশেষ। পরবর্তী কয়েক বছরে ডেয়ারমেঞ্জিয়ান এবং তার দল অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক ইনকা সাইট, দুর্গ, কৃষিক্ষেত্র, শত শত বাড়ির কিছু মহল্লা এবং শহর আবিষ্কার করেন কিন্তু পাইতিতির অবস্থান এখনও খুঁজে পাননি।

হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণের শহর পাইতিতি এখনও পৌরাণিক কাহিনী হিসেবে রয়ে গেলেও গ্রেগ  ডেয়ারমেঞ্জিয়ান দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন যে তিনি এবং তার দল শীঘ্রই পাইতিতি আবিষ্কার করতে সফল হবেন। আর পাইতিতির আবিষ্কার  মানব জগতের খাপ খাইয়ে নেয়ার অসামান্য প্রবণতার প্রমাণ সকলের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হবে।

Source Feature Image
Leave A Reply

Your email address will not be published.

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More