গত চব্বিশ ঘণ্টায় সারা পৃথিবী জুড়ে কত গুলো বই প্রকাশ হয়েছে? এই প্রশ্নে – গড়ে কাগজের বই ছাপিয়ে প্রকাশ হয়ে গেছে ছয় হাজারের অধিক । এমন পরিসংখ্যানে একজন পাঠক হিসেবে মিশ্র অনুভূতির জন্ম হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক । আদি যুগ থেকে উত্তরাধুনিক যুগে এসে দিনকে দিন ছাপানো বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে বৈকি কমে নি । তবে অন্যদিক দিয়ে কিছুটা হলেও আশঙ্কার বিষয় হলো এই শতকের শুরু থেকে কর্পোরেট দুনিয়া পেপার-লেস বা কাগজীয় বিষয়াদি থেকে বেড়িয়ে আসছে ক্রমেই । প্রায়ই তাই কাগজের ছাপানোর ইতি হবে কিনা সে প্রশ্ন উঠেই যায়।
সে দিকে আর অগ্রসর না হয়ে ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দেওয়াই শ্রেয় । প্রথম ছাপাখানার আবিষ্কার চীনে এবং আধুনিক ছাপাখানা যা আমরা আজকাল ব্যবহার করছি সেই ধারার যন্ত্রের যাত্রা শুরু হয় বর্তমান জার্মানিতে গুটেনবার্গের হাত ধরে ১৪৪০ সালে ।
তার মানে কি ছাপাখানার জন্মই কি প্রকাশনার জন্ম ? না ! হাতে লিখে রাখার প্রচলন খৃষ্টপূর্ব দুই – আড়াই হাজার বছর আগেই হয়েছিলো । তাছাড়া পৃথিবীতে বর্তমান যে সমস্ত ধর্ম গ্রন্থ – পুরাণ আছে তার সবগুলোই শুরুতে সংরক্ষণ হয়েছে হাতে লিখার মধ্য দিয়ে ।
গিলগামেশ কি?
মানব সভ্যতার সর্বপ্রথম লিখা গ্রন্থ কি ? গিলগামেশ মহাকাব্য ( Epic of Gilgamesh )
মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরান, ইরাক, সিরিয়া এবং সৌদি আরব অঞ্চল) প্রাচীন সুমেরিয়ান সভ্যতার থেকেই লিপির আবিষ্কার হয়েছে বলে ধরা হয়। আর মানব সভ্যতার প্রথম সাহিত্য কর্ম ‘গিলগামেশ মহাকাব্য’ তাঁদেরই রচনা ।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪০০ সালে মেসোপটেমিয়ার সুমেরিয়ান সভ্যতার মধ্যে লিপির আবিষ্কার ঘটে তাঁদের সেই লিখিত ভাষাকে ‘Archaic Cuneiform’ বলা হয় । সভ্যতার প্রমাণ তৈরিতে এই লেখ্য-ভাষা শক্ত হাতিয়ার হয়ে উঠেছে দিনকে দিন । প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক এই দুইয়ের সম্পর্ক স্থাপনের পিছনে সাহিত্যই হল প্রধানতম প্রভাবক, সেদিক দিয়েও গিলগামেশ মহাকাব্য একটি নির্দেশক হিসেবে কাজ করছে।
গিলগামেশ এর বিষয়বস্তুঃ
গিলগামেশ মহাকাব্যে সুমেরিয়ানদের শহর ‘উরুক’ (বর্তমান ইরাকের আল-ওয়ারকা) এর জীবন যাপন এবং অধিক ভাবে উঠে এসেছে তাঁদের ধর্ম বিশ্বাস, প্রকৃতির সাথে তাঁদের সম্পর্কের উত্থান পতনের কথা । গিলগামেশ মহাকাব্যের প্রধান চরিত্র হচ্ছে গিলগামেশ নিজে, উরুক শহরের রাজা ছিলেন যিনি তার ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে শহরকে রক্ষা করেন । খোদাইকৃত পাথরে গিলগামেশের কাহিনীর শুরু মূলত পাঁচটি কবিতা দিয়ে যাতে রাজা গিলগামেশের রাজ্য পরিচালনা এবং তার পরিচিতির সন্ধান মিলে । মুল মহাকাব্য তার পর থেকে শুরু হয় পরের ৫ টি কবিতা দিয়ে।
গিলগামেশ মহাকাব্যের প্রধান চরিত্র গিলগামেশ (প্রথম সংস্করণে বিলগামেশ) উরুকের ৪র্থ রাজা লোগালবান্দা ও ঈশ্বরী রিমাত নিনসানের পুত্র । তার ক্ষমতা বিভক্ত ছিল দুই ভাগ ঐশ্বরিক এবং এক ভাগ মনুষ্যে যা তকে এক অতিমানবীয় রাজাতে রূপান্তর করে । মহাকাব্যে মহা প্লাবনের কথা বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে যার সাথে খ্রিস্টান ধর্মের অবতার নূহ এর প্লাবনের সাথে সাদৃশ্য লক্ষণীয় । গ্রিক মহাকাব্য অডিসি’র কাহিনীর আবর্তনের সাথেও গিলগামেশ মহাকাব্যের মিল পাওয়া যায়।

Source : bbc
গ্রিক পুরানের প্রাচীনতম লেখক হোমারের (750 – 700 BC) অনন্য সৃষ্টি “The Iliad” and “The Odyssey” তে অতিমানবীয় চরিত্রের যে বৈশিষ্ট পাওয়া যায় তার সাথেও গিলগামেশের চারিত্রিক মিল বিদ্যমান ।
কাহিনী সংক্ষেপঃ
কমিকসের মুগলী বা টারজানের সাথে আমাদের পরিচয় সেই শৈশবে। ঠিক এমনই এক একটি চরিত্রের সাথে গিলগামেশ মহাকাব্যে সাক্ষাত হবে যার নাম এনকিডু । দেবতা আ-রুরু আবির্ভাব ঘটান এনকিডুর, যে কিনা সমাজ বিচ্ছিন্ন প্রতিপালিত হয়েছে জঙ্গলে পশুদের দ্বারা, ঘটনা ক্রমে এনকিডু গিলগামেশের বন্ধু হয় । দেবমাতা নিনসন এনকিডুকে তার ২য় পুত্র হিসেবে গ্রহণ করে। দেবমাতা নিনসনের আদেশে গিলগামেশ ও এনকিডু একসাথে বিভিন্ন অভিযানে যায়, যার উত্থান পতনের বর্ণনা মহাকাব্যে রয়েছে ।
ঘটনা ক্রমে স্বর্গের ষাঁড় হত্যা ও অপদেবতা হুম্বাবাবা হত্যার জন্য এনকিডুর শাস্তি স্বরূপ মৃত্যু হলে গিলগামেশ মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরে এবং মৃত্যুকে পরাজিত করার অতিমানবীয় ইচ্ছার জন্ম নেয় তার মনে, সেই সূত্রেই পরবর্তীতে মহা প্লাবনের পরে একমাত্র জীবিত দম্পতি উথনাপিশটিম ও তার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করতে যায় গিলগামেশ । গিলগামেশ চিরঞ্জীব হয়ে উঠার ব্রত স্থির করে অনুসন্ধানে নেমে পরে , শুরু হয় তার একক অভিযান ।

পৃথিবীর অন্য-প্রান্তে থাকা উথনাপিশটিম এর সাথে দেখা করতে তাকে সমুদ্র, পর্বত পাড়ি দিতে হয় । পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এসে কিছুদিন অপেক্ষার পরে সে ডিলমুনে আসে যেখানে উথনাপিশটিম থাকেন । চিরজীবী হয়ে উঠার উপায় জানতে চায় গিলগামেশ, উত্তরে উথনাপিশটিম তাকে অনিদ্রায় ৬ দিন ৭ রাত কাটাতে বলে কিন্তু ক্লান্ত গিলগামেশ তা পালন করতে ব্যর্থ হয়। এতে করে তাকে উরুকে ফিরে যেতে হবে এমন শর্ত জুড়ে দেয় উথনাপিশটিম ।
উথানপিশটিমের দেওয়া শর্ত প্রথম দিনই ভঙ্গ করে গিলগামেশ, এর পরো দ্বিতীয় বার তাকে সুযোগ দেওয়া হয়, তাকে গভীর সমুদ্রের এক উদ্ভিদের কথা বলা হয় যার সন্ধান করতে বলা হয় যা তাকে দিতে পারে অমরত্ব কিন্তু গিলগামেশ এই কাজেও ব্যর্থ হয় ফলশ্রুতিতে উরুকে ফিরে আসতে হয় তাকে । গিলগামেশের আর অমরত্ব লাভ করা হয়ে উঠে নি ।
‘মহাকাব্য গিলগামেশ’ এর প্রধান চরিত্র অবশ্যই গিলগামেশ নিজে, যে কিনা একজন অত্যাচারী রাজা, বদমেজাজি এবং দেবতাদের চোখেও মহাকাব্যে একজন নেতিবাচক ব্যক্তিত্বের অধিকারী তার পরও গিলগামেশই এই মহাকাব্যে সেই অর্থে ‘নায়ক’। মানুষ কখনই সম্পূর্ণ ভুল ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে হতে পারে না বলেই সে মানুষ, তেমনি গিলগামেশও মানুষ থেকেছে। এনকিডু ও গিলগামেশ এর মধ্যকার বন্ধুত্ব মনুষ্য সম্পর্কের এক অনন্য নজির । গিলগামেশ তার এই বিচিত্র অভিযাত্রী জীবন ও ব্যর্থতা নিয়েই সে এক অনন্য যোদ্ধা, আদ্যোপান্ত একজন অধিবক্তা! কেন ? এতো কিছুর পরেও গিলগামেশ অতিমানবীয় কেউ হয়ে উঠতে পারে নি। মনুষ্য ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা উরুকের রাজা হওয়াতেই তাকে শান্তি ও উপভোগ্য জীবন যাপনের পথ দেখিয়েছে। গিলগামেশ ও গিলগামেশ মহাকাব্য ঠিক এখানেই সার্থক ও পরিপূর্ণ চরিত্র বা সাহিত্য হয়ে উঠেছে।
Gary Kawesh in San Jose generic propecia no perscription