জনমনে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকতে খুব বেশি উত্তম হওয়াটাও মাঝে মাঝে যথেষ্ট নয়। আমাদের মত ফুটবল ভক্ত প্রত্যেকের মনে সর্বসেরাদের একটি তালিকা করা আছে। সেই তালিকায় কোন ফুটবলারের জায়গা পেতে অবশ্যই তাদের অসাধারণ কিছু অর্জন করতে হয়। একটি সাধারণ জাতীয় দলকে বিশ্ব ফুটবলের শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার মত কিছু একটা। এমন একজন ফুটবলারের নামই হচ্ছে ইয়োহান ক্রুইফ। ফুটবল ময়দানে পা রাখা ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ও বলা হয় তাকে।
জন্ম ডাচ রাজধানী আমস্টারডামে, ১৯৪৭ সালে। ক্ষুদে ক্রুইফ মাত্র ১০ বছর বয়সে ডাচ খ্যাতনামা ক্লাব আয়াক্স আমস্টারডামে যোগদান করেন। মাত্র ১২ বছর বয়সেই নিজের বাবাকে হারান। তবে জীবনে এত বড় ধাক্কার সম্মুখীন হয়েও কখনও নিজের আত্মবিশ্বাস হারাননি। আয়াক্স মূল দলে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই প্রথম খেলার সুযোগ পান। মূল দলে খেলার শুরু থেকেই তিনি নিজের জায়গাটি পাকাপোক্ত করেন এবং দর্শকদের মাঝে সাড়া ফেলেন। আয়াক্স ক্লাবের ফুটবলে নতুন খেলার ধরণের আবির্ভাব ঘটে এবং ক্রুইফ এটির সাথে খুব ভালভাবে খাপ খাইয়ে নেন। প্রতি সপ্তাহের ম্যাচেই তিনি এই ডাচ ক্লাবের হয়ে অসামান্য নৈপুণ্য দেখাতে থাকেন। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৬৭ সালে আয়াক্স জিতে নেয় ডাচ লীগ এবং কাপ শিরোপা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে তত দিনে ক্রুইফ মাত্র ২০ বছর বয়সে পদার্পণ করেছিলেন।

আয়াক্স ও নেদারল্যান্ডস দুই দলই ক্রুইফকে কেন্দ্র করে মাঠে পাসিং চালনা করত। ১৯৬৫ সালে রিনাস মিকেলস্ আয়াক্সের কোচ হওয়ার পর থেকেই ফুটবলে এক নতুন ধারার আবির্ভাব হয় যেটিকে সবাই ‘টোটাল ফুটবল’ নামে চিনতো। কোচ রিনাস মিকেলস্ ক্রুইফকে টোটাল ফুটবলের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। যদিও ক্রুইফ খেলতেন একজন সেন্টার ফরওয়ার্ড হিসেবে কিন্তু কোচ রিনাস তাকে মাঠের যেখানে খুশি পদচারণের স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করেছিলেন। অসাধারণ কৌশলগত সামর্থ্য ও অসামান্য বুদ্ধিমত্তার উপস্থিতির দরুণ ক্রুইফ প্রতিপক্ষের দুর্বলতাগুলো খুব সহজেই আয়ত্ত করতে পারতেন। ক্রুইফের সতীর্থরাও তার খেলার সাথে নিজেদের সহজে মানিয়ে নিত। ফলে তারা মাঠে সর্বসেরা খেলাটি দর্শকদের উপহার দিতে পারত।
টোটাল ফুটবলের শক্তির প্রবলতা ১৯৭২ সালের ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালেই টের পাওয়া গিয়েছিল। দুর্দান্ত সেই ফাইনালে আয়াক্স আমস্টারডাম ২-০ গোলে হারায় ইটালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানকে। জোড়া গোল করে সেই ম্যাচেই নিজের জাত চেনান ইয়ুহান ক্রুইফ। ১৯৭৩ সালে বার্সেলোনা দলে খেলার সুযোগ আসে ক্রুইফের হাতে। সেই মৌসুমেই তৎকালীন রেকর্ড ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে কাতালান ক্লাবে পাড়ি দেন তিনি। স্পেনে এই ডাচ তারকা বার্সেলোনা দলের হয়ে আরও জোরালভাবে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে থাকেন। তিনি নিজে আক্রমণভাগে গিয়ে গোল করার চেয়ে সতীর্থদের পাস বাড়িয়ে দিয়ে গোল করানোকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন। ডান অথবা বাম প্রান্ত থেকে ক্রস শানিয়ে অথবা ডি-বক্সের বাইরে থেকে চূড়ান্ত পাস খেলাটাই তার প্রধান কাজ ছিল। শেষ পর্যন্ত বার্সেলোনা তার নৈপুণ্যে লা লিগা শিরোপা খড়া ঘুচাতে সক্ষম হয় এবং প্রায় ১৪ বছর পর এই শিরোপা নিজের করে নেয়। অতুলনীয় বিচক্ষণতা ও অসামান্য ফুটবল কৌশলের যে উদাহরণ তিনি ফুটবল মাঠে উপস্থাপন করেছিলেন তা সহজেই বার্সা দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিল।

ক্লাব ক্যারিয়ারের শেষের দিকে এসে ক্রুইফ উত্তর আমেরিকায় খেলার সিদ্ধান্ত নেন। লস এঞ্জেলেস উইজার্ডস এবং ওয়াশিংটন ডিপ্লোমেটসদের হয়ে তিনি একটি করে মৌসুম পার করেন। তারপর আবার ফিরে যান স্পেনে লেভান্তের হয়ে খেলার উদ্দেশ্যে। যদিও ঘরের ক্লাব আয়াক্সে ফিরে আসতে বেশি দেরি করেননি। আয়াক্স আমস্টারডাম তার নেতৃত্বে পরপর দুইটি ডাচ লীগ শিরোপা জয় করে। অবশেষে ১৯৮৪ সালে ফেইনুর্দ ক্লাবের হয়ে নিজের ক্লাব ক্যারিয়ারের ইতি টানেন এই ডাচ ফুটবল কিংবদন্তি।
ক্রুইফের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে ১৯৭৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপের কথা। আর্জেন্টিনা(৪-০) , পূর্ব জার্মানি(২-০) এবং ব্রাজিলকে(২-০) প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে পিছে ফেলে ডাচ দল পৌঁছে ফাইনালে। এর মধ্যে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ম্যাচটিকে সবচেয়ে কর্তৃত্বপূর্ণ ম্যাচ হিসেবে বিবেচনা করা হয় যেটিতে ক্রুইফ ২ টি গোল করেন। এরপর ’৭০ এর চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের বিপক্ষেও তিনি ২য় গোলটি করেন। তবে ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের প্রতিপক্ষ হিসেবে ধরা দেয় জার্মানি। টোটাল ফুটবলের কাছে বাকি দলগুলো ধরা দিলেও জার্মানরা ছিল হার মানতে নারাজ। দুর্ভাগ্যবশত তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সেই ম্যাচে ০-১ গোলে এগিয়ে থেকেও ২-১ গোলে পরাজয় মানতে হয় ক্রুইফের দল নেদারল্যান্ডসকে। তবে ডাচ মহাকুশলীর অনবদ্য ক্রীড়াকৌশল চোখ এড়ায়নি কারও! সেই বিশ্বকাপে ইয়ুহান ক্রুইফ ‘প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট’ নির্বাচিত হন।

ইয়ুহান ক্রুইফের কিছু অনন্য সাফল্যগাঁথা নিম্নে বর্ণিত হল-
আয়াক্সের হয়ে সাফল্য
- ৩৬৭ ম্যাচে গোল করেন ২৬৮ টি।
- ৮ টি ডাচ এরেডিভিজে (ডাচ লীগ) জিতেন।
- ৫ বার জিতেন ডাচ কাপ (কেএনভিবি কাপ)।
- ৩ বার ইউরোপিয়ান কাপ এবং ২ বার ব্যালন ডি’অর জিতেন।
- ২ বার ইউরোপিয়ান প্লেয়ার অফ দ্য সিজন খেতাব পান।
বার্সেলোনার হয়ে সাফল্য
- ৮৪ ম্যাচে গোল করেন ৬১ টি।
- একবার স্প্যানিশ লীগ (লা লিগা) জিতেন।
- একবার স্প্যানিশ কাপ (কোপা ডেল রে) জিতেন।
- ব্যালন ডি’অর খেতাব পান একবার।
নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলের হয়ে সাফল্য
- ৪৮ আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল করেন ৩৩ টি (ইয়ুহান ক্রুইফ যে ম্যাচে গোল করেছেন সে ম্যাচে নেদারল্যান্ডস কখনও হারেনি)।
- ১৯৭৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপে তাকে সেরা খেলোয়াড় ঘোষণা করা হয়।
- ১৯৭৪ সালের ‘বিশ্বকাপ সেরা একাদশে’ তার নাম অন্তর্ভুক্তি হয়।
ক্রুইফের অভূতপূর্ব গল্প মাঠের ভিতরেই থেমে থাকেনি। ম্যানেজার হিসেবেও তিনি নিত্য নতুন ফুটবল কৌশল আবিষ্কার করতেন এবং খেলোয়াড়দের উন্নতির পিছনে সময় ব্যয় করতেন। আয়াক্স এবং বার্সেলোনায় নিজের ম্যানেজিং ক্যারিয়ারের মধ্যে দিয়ে ক্রুইফ শেষ পর্যন্ত ভক্তদের কাছে ঈশ্বরস্বরূপ মর্যাদা পান। স্প্যানিশ জায়ান্টরা তার পরিচালনায় পরপর ৪ বার লা লিগা শিরোপা জয় করে যা ছিল এক অবিস্মরণীয় সাফল্য। এছাড়া তার নেতৃত্বে একটি ইউরোপিয়ান কাপও জিতে নেয় কাতালানরা। কাতালোনিয়াতে তিনি ফুটবলের একটি সুগঠিত ও সুসংহত গঠন তৈরি করে দিয়ে যান যার মূলে ছিল বল আয়ত্তকরণ এবং শক্ত প্রেসিং কৌশল। যার ফলে খেলোয়াড়দের পাসিংয়ের মধ্যে গভীর নিবিড়তা এবং সমন্বয়তা সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীতে তার মডেলকে অনুসরণ করেই বার্সেলোনা তাদের কৌশল প্রতিষ্ঠা করে।

শুধুমাত্র ফুটবলার হিসেবেই যে ক্রুইফ বিশ্বজুড়ে খ্যাতি ছড়িয়েছেন এমনটি নয়। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি ফুটবলকে নিয়ে গবেষণা করতে ভালবাসতেন। তার বিভিন্ন অনুশীলনের চিত্র এখনকার দিনে পৃথিবীর বিভিন্ন ট্রেনিং মাঠে এবং ইয়ুথ একাডেমীতে প্রায়ই ফুটে ওঠে। ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ এই ডাচ কিংবদন্তি ফুটবল এবং তার ভক্তদের ছেড়ে ইহলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ফুটবলে তার অপরিমেয় অবদানের জন্য বিশ্ব তাকে সর্বদা স্মরণ করবে।