রন্ধনশিল্প এবং দেশভেদে তার ভিন্নতা – ফ্রান্স

0

 

আজকাল প্রায়ই ঘরে কিংবা রেস্টুরেন্টগুলোতে বিভিন্ন ধরনের স্যুপ ভীষণ জনপ্রিয়। আপনি কি জানেন খাবারের সাথে সম্পৃক্ত বহুল ব্যবহৃত রেস্টুরেন্ট ও স্যুপ-এই শব্দ দুটি এসেছে ফ্রেঞ্চ ভাষা থেকে অর্থ্যাৎ এমন এক দেশ থেকে, যে দেশ রন্ধনশিল্পে এক কথায় বিশ্বখ্যাত। ফ্যাশন, শিল্পকলা, সাহিত্য সংস্কৃতি, জ্ঞান, দর্শন বা রন্ধন এই সবকিছু একসাথে বিবেচনা করলে যে দেশকে সবার উপরে রাখা যায় তা হলো –ফ্রান্স। চলুন জেনে নিই, ফ্রান্সের রন্ধনশিল্প এবং এর কিছু ইতিহাস সম্পর্কে।

চতুর্দশ শতাব্দীতে মধ্যযুগীয় ফ্রেঞ্চ রন্ধনপ্রণালী খুব গাঢ়ভাবে ইতালিয়ান রন্ধনশিল্প দ্বারা প্রভাবিত ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে এসে এই শিল্পকে বৈদেশিক প্রভাবমুক্ত করা হয় এবং ফ্রান্সের নিজস্ব দেশীয় প্রণালী ব্যবহার করে এই শিল্পের উন্নয়ন সাধন করা হয়। বিংশ শতাব্দীতে ফ্রেঞ্চ রন্ধনশিল্পে আসে বৈপ্লবিক পরির্বতন। এই সময়ে এদের রন্ধনশালাগুলোতে ‘অট কুইজিন’  সিস্টেমের প্রচলন শুরু হয়, যার মাধ্যমে এদের পূর্বসুরীদের রেসিপিগুলোকে আরো সহজতর এবং আধুনিকতর করে দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করা হয়।

অট কুইজিনকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য ব্রিগেড সিস্টেম ব্যবহার করা হয় অর্থ্যাৎ কোন রেস্টুরেন্টের রন্ধনশালাকে পাঁচটি প্রিপারেশান সেকশানে ভাগ করা হয়। যেমনঃ- garde manger-এই গ্রুপটির কাজ হলো কোল্ড ডিশ নিয়ে কাজ করা,  entremettier- স্টার্চ এবং ভেজিটেবল নিয়ে এদের কাজ rôtisseur- এই সেকশান রোস্ট, গ্রিলড্ এবং ফ্রাইড্ ডিশগুলো নিয়ে কাজ করে থাকে  saucier- এরা তৈরী করে নানান রকম সস্ এবং স্যুপ এবং  pâtissier-  সবধরনরে প্রেস্টি এবং ডেজার্ট এই সেকশানেই বানানো হয়। এভাবে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে বিশুদ্ধ এবং আলাদাভাবে তৈরী খাবারগুলোর কম্বিনেশন তাদের লাঞ্চ ডিনারকে করে তুলে অতুলনীয়। এই পদ্ধতিতে খুব কম সময়ে দক্ষতা এবং শৈল্পিকভাবে খাবার পরিবেশন করতে পারার কারণে রেস্টুরেন্টগুলোতে এই সিস্টেম জনপ্রিয়তা লাভ করেএবং তখন থেকেই কমার্শিয়ালভাবে রেস্টুরেন্টগুলোতে দক্ষ শেফ নিয়োগ শুরু হয়।

১৯৬০ সালে ফ্রান্সের রন্ধনশিল্পে আরেকটি নতুন ধারা আসে যেখানে খাবারের সজীবতা, হালকাভাব এবং স্বাদের বিশুদ্ধতার ‍উপর জোর দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিটি ‘ন্যুভেল কুইজিন’ নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে রন্ধনপ্রণালীর অপ্রয়োজনীয় ও জটিল ধাপগুলোকে বাদ দেওয়া হয় এবং খাবারের প্রাকৃতিক গুণাগুণ ও স্বাদ অপরিবর্তিত রাখার চেষ্টা করা হয়। সবচেয়ে ফ্রেশ খাবারের উপাদানগুলো নিয়ে স্টীমে রান্না করাটা এসময় জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই সময় ফ্যাট ময়দা মিশ্রিত ভারী সস্ বাদ দিয়ে বাটার, লেবু, নানা রকমের ফ্রেশ হার্বস ব্যবহার করা হয় এবং গ্রামীণ ও আঞ্চলিক খাবারগুলোর ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে পরিচ্ছন্নভাবে নতুন খাবার পরিবেশন করা হয়।

১৯৮০ সালের মধ্যদিকে ,যখন ন্যুভেল কুইজিনের জনপ্রিয়তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে তখনই আবার বেশিরভাগ শেফ অট কুইজিন পদ্ধতিতে ফিরে যায়, যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ন্যুভেল কুইজিনের হালকা পরিবেশন এবং নতুন পদ্ধতিগুলো বর্তমান থেকে গিয়েছিল।অর্থ্যাৎ আধুনিক ফ্রেঞ্চ রন্ধনশিল্প অট কুইজিন এবং ন্যুভেল কুইজিন , এই দুই সিস্টেমের উপরই নির্ভরশীল।

ফ্রান্সের সর্বত্র রয়েছে অসংখ্য বিস্ত্রো এবং ক্যাফে, যেগুলো তাদের কাছে আসা সব শ্রেণীর প্রত্যেক কাস্টমারকে সমানভাবে গুরুত্ব দেয়, তাদের আয় বা স্ট্যাটাসের উপর নির্ভর করে নয়। খাবারের গুণাগুণ, স্বাদ এবং পরিবেশনের উপর সতর্ক থাকা এসব রেস্টুরেন্টের শেফগুলো সুপরিচিত, খাবারের সৃষ্টিশীল উদ্ভাবনের জন্য এবং সিজনাল ফ্রেশ সঠিক খাদ্য উপকরণ ব্যবহার করার জন্য।

ফরাসীদের যদিও নিজস্ব রন্ধনশিল্প আয়ত্তে আনতে কয়েক যুগ চলে গিয়েছিল,তবে বর্তমানে এটি সারাবিশ্বের সাথে পরিচয় করে দিয়েছে এর অপূর্ব শৈল্পিক রন্ধনবিদ্যার সাথে।পাশ্চাত্যের রন্ধনশিল্পে এর রয়েছে অসামান্য অবদান।২০১০ সালে নভেম্বর মাসে ইউনেস্কো ফ্রেঞ্চ গ্যাস্ট্রোনমিকে ‘world’s intangible cultural heritage’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।

ফরাসীরা সাধারণত তিনটি ধাপে তাদের মিল গ্রহণ করে থাকে (  ইন্ট্রুডাক্টরি কোর্স, মেইন কোর্স, চীজ কোর্স অথবা ডেজার্ট)। ঐতিহ্য অনুসারে সাধারণত অঞ্চলভেদে এসবে রয়েছে বৈচিত্র্যতা, নিজস্ব ধরন।

স্যুপ আল্যোনিয়োঁ (Soupe à l’oignon) :-

এটি একটি ঐতিহ্যবাহী স্যুপ যা বানাতে ব্যবহার করা হয় বীফ স্টক এবং পিঁয়াজ। এটি সাধারণত পরিবেশন করা হয় ক্রুটন অথবা মেল্টেড চীজের টপিং ব্যবহার করে।ধারণা করা হয় এর অরিজিন রোমান সময়কার।স্লো-কুক-প্রসেসে রান্না করা এই স্যুপটির অসাধারণ টেস্ট আসে মূলত পিয়াঁজের ক্যারামালাইজেশনের কারণে।এছাড়াও এতে পানি,দুধ,ডিম অথবা ময়দা মিশিয়ে ঘনত্ব বাড়ানো কমানো হয়।

রন্ধনশিল্প এবং দেশভেদে তার ভিন্নতা - ফ্রান্স
স্যুপ আল্যোনিয়োঁ

কোকোয়্যাভা (coq au vin):-

বিশুদ্ধ এই ফ্রেঞ্চ খাবারটি জনপ্রিয়তা লাভ করে জুলিয়া চাইল্ডের টিভি শো এর মাধ্যমে। অল্প আঁচে ওয়াইন দিয়ে রান্না করা চিকেন, মাশরুম,সল্ট পর্ক, পিয়াঁজ, মাঝে মাঝে রসুন অথবা ব্র্যান্ডি ব্যবহার করে এই স্যুপটি তৈরী করা হয়।সাধারণত রেড বারগুন্ডি ওয়াইন ব্যবহার করা হলেও অঞ্চলভেদে নানা রকম লোকাল ওয়াইন ব্যবহার করে এই স্যুপটিতে ভেরিয়েশন আনা হয়। 

রন্ধনশিল্প এবং দেশভেদে তার ভিন্নতা - ফ্রান্স
কোকোয়্যাভা

ক্যাজিউলে (Cassoulet ):-

ক্যাজিউলে একটি আরামদায়ক খাবার। সাদা বীনকে বিভিন্ন ধরনের মাংসের সাথে ধীরে ধীরে সিদ্ধ করে এটি তৈরী করা হয়। এক্ষেত্রে সাধারণত পর্ক অথবা হাসের মাংস ব্যবহার করা হয়, তবে কখনো কখনো সসেজ, মাটনও ব্যবহার করা হয়।এই আঞ্চলিক খাবারটি এসেছে মূলত ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চল থেকে এবং তুলুজ,ক্যারকাজোঁ ও ক্যাস্তেলন্যুদারি অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয়। ঐতিহ্যগতভাবে এটি তৈরীর সময় যে পাত্র ব্যবহার করা হয়, তার আকৃতি থেকেই এর নামকরণ করা হয়।শীতকালে এই খাবারের প্রচলন বেশি। 

রন্ধনশিল্প এবং দেশভেদে তার ভিন্নতা - ফ্রান্স
ক্যাজিউলে

বীফ বারগ্যুনোন ( Beef bourguignon ):-

বীফ বারগ্যুনোন ফ্রান্সের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার যা এখন আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত।এটি ফ্রান্সের পূর্বাঞ্চল বারগুন্ডি থেকে এসেছে। রেড ওয়াইন দিয়ে অল্প আঁচে রান্না করা বীফ, বীফ ব্রোথ, রসুন, পিয়াঁজ,মাশরুম, ফ্রেশ হার্বস ব্যবহার করে বারগ্যুনোন প্রস্তত করা হয়।অট কুইজিনে পরিবেশন করা ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক খাবারের উদাহরণ হলো বারগ্যুনোন। 

রন্ধনশিল্প এবং দেশভেদে তার ভিন্নতা - ফ্রান্স
বীফ বারগ্যুনোন

চকোলেট স্যুফলে ( Chocolate soufflé ) :-

চকোলেট স্যুফলে একটি হালকা, বেকিং করা ডিমের ডিশ, ফ্রান্সে  যার প্রচলন মূলত অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকে। মসলাদার অথবা মিষ্টি দুই স্বাদেই একে প্রস্তুত করা হয় এবং বিশ্বজুড়ে একে ডেজার্টের তালিকাতেই রাখা হয়। ক্রিস্পি চকোলেটের আবরণের ভিতরে চুয়েঁ পড়া লোভনীয় ক্রিমি চকোলেটেই এই ডেজার্টের অন্যতম আকর্ষণ। 

রন্ধনশিল্প এবং দেশভেদে তার ভিন্নতা - ফ্রান্স
চকোলেট স্যুফলে

ক্যুনফিদ্যুক্যানা ( Confit de canard ):-

ক্যুনফিদ্যুক্যানা ফ্রান্সের একটি সুস্বাদু হাঁসের তৈরী ডিশ। এটি ফ্রান্সের অন্যতম একটি চমৎকার খাবারও বলা যায়। হাঁস দিয়ে তৈরী হলেও কখনো কখনো হাঁসের পরিবর্তে রাজহাঁস অথবা পর্ক ও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।কয়েক শতাব্দীর পুরনো পদ্ধতিতে অল্প আঁচে রান্না করে খাবারটি প্রস্তুত করা হয়।এক্ষেত্রে হাঁসের মাংসগুলোকে লবণ, রসুন, সুগন্ধযুক্ত হার্বস দিয়ে প্রায় দুদিনের মতো ম্যারিনেট করে রান্নার জন্য প্রস্তুত করা হয়।এটি সাধারণত ভাজা আলু অথবা রসুনের সাথে পরবেশন করা হয়। যদিও ক্যুনফিদ্যুক্যানা গ্যাসকনির অঞ্চলের একটি বিশেষ খাবার তবে বর্তমানে এটি পুরো ফ্রান্সেই জনপ্রিয়তা লাভ করে। 

রন্ধনশিল্প এবং দেশভেদে তার ভিন্নতা - ফ্রান্স
ক্যুনফিদ্যুক্যানা

রাটাট্যুয়ি (Ratatouille ):-

বিশ্বপরিচিত এই র‌্যাটাটুয়ি খাবারটি মূলত ফ্রান্সের প্রোভেন্সের দক্ষিণপূর্বাঞ্চল থেকে এসেছে। এটি একটি ভেজিটেবল রেসিপি, যা সাইড ডিশ বা মিল হিসেবে অথবা অন্যান্য ডিশের স্টাফ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

রন্ধনশিল্প এবং দেশভেদে তার ভিন্নতা - ফ্রান্স
রাটাট্যুয়ি

এই ডিশ তৈরী করার সময় প্রথমেই ভেজিটেবলগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে বেশি তাপমাত্রায় হালকভাবে ভাজা হয়, পরে এগুলোকে ওভেনে বেক্ করা হয়। এক্ষেত্রে ভেজিটেবল হিসেবে টমেটো, রসুন, পিয়াঁজ, জুকিনি, এগপ্ল্যান্ট, গাজর, বেল পিপারস্, বেসিল, মারযোর‌্যাম এবং বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধয়ুক্ত সবুজ হার্বস ব্রবহার করা হয়।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More