সচরাচর ম্যাকডোনাল্ডস বলতে আমরা বুঝি ব্যক্তির নাম, তবে এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রেস্টুরেন্ট। এর স্রষ্টা যিনি তাঁর নাম রে ক্রক (Ray Kroc) । তিনি একটি ছোট বার্গারের দোকানকে রূপান্তর করেছেন বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ খাদ্য ভাণ্ডারে।
‘দ্যা ফাউন্ডার’ (The Founder) নামের একটি সীমিত পরিসরের প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে ম্যাকডোনাল্ডসের পিছনে এর প্রতিষ্ঠাতার অক্লান্ত পরিশ্রম, কিভাবে তিনি ছোট একটি ফুড কর্নারের ইতিহাস বদলে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ম্যাকডোনাল্ডসে পরিণত করেছেন।

Source: Pinterest
ম্যাকডোনাল্ডসের সৃষ্টি:
ম্যাকডোনাল্ডস সৃষ্টির ইতিহাস জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রায় ৭৭ বছর আগে।
সময়কাল ১৯৪০ সাল। রিচার্ড এবং মরীচ দুই ভাই ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান বারনারদিনো’তে ম্যাকডোনাল্ডস রেস্টুরেন্ট চালু করেন। দীর্ঘ আট বছর বারবিকিউ জয়েন্ট চালানোর পর তাঁরা বার্গার, পানীয়, আলুর চিপস (ফ্রেঞ্চ ফাই বিশেষ), পাই (পেস্ট্রি বিশেষ) বানানোর দিকে মনোনিবেশ করেন, যার কারণ ছিলো তাঁদের মতে হ্যামবার্গার এর পাশাপাশি এসব খাদ্য তালিকা আরো বেশি লাভজনক হবে।
তাঁরা নিজেদের কাজের সুবিধার্থে বেশ কিছু মাল্টি মিক্সার মেশিন ক্রয় করেন। মজার ব্যাপার হলো মাল্টি মিক্সারগুলো সরবরাহ করতো ‘রে ক্রক’। প্রথম দেখাতেই দুই ভাই রিচার্ড এবং মরীচের ফাস্ট ফুড ব্যবসার সফলতা ‘রে ক্রক’কে প্রভাবিত করে। দুই ভাই একটি রেস্টুরেন্টের জন্য আটটি মিক্সার মেশিনের অর্ডার করে। তিনি অর্ডার নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিরে যান এবং চিন্তা করতে থাকেন, ব্যবসা কতটুকু লাভজনক হলে একসাথে এতো মেশিন অর্ডার করে?

Source: Foodable Network
তাঁর বিস্ময় আরো বৃদ্ধি পায় যখন তিনি দেখেন মিলিটারি বেইজের পাশে অবস্থিত রেস্টুরেন্টে এতো মানুষের ভিড়!
তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
‘যখন আমি সেখানে যাই তখন মানুষের দীর্ঘ সারি যা কখনোই ড্রাইভ-ইন রোডের পাশে দেখা যায় নি। অবশ্যই এই দুই ভাই কিছু একটা আবিষ্কার করেছে। কেমন হবে যদি আমি এই রেস্টুরেন্ট বেশ কিছু জায়গায় খুলে বসি?’
যেই চিন্তা সেই কাজ, সময়কাল ১৯৫৫ সাল। রে রোচ পরক্ষণেই দুই ভাই হতে অন্যত্র রেস্টুরেন্টের শাখা খোলার স্বত্ব কিনে নেন এবং ইল্লিনয়েসের ‘ডেস প্লেইনসে’ প্রথম শাখা স্থাপন করেন।

Source: Medium
রে ক্রকের সফলতার শুরু:
জীবনের অনেক কষ্টের দিন পার করে এবার রে’র সফলতার দিন দেখার শুরু হতে লাগলো। দুই ভাইয়ের সাথে চুক্তি হলো যতো বিক্রি হবে তা হতে ০.৫% তাঁদের দিয়ে দিবে।
এরপর আগামী পাঁচ বছর যেতে না যেতেই তিনি ম্যাকডোনাল্ডসের ২২৮ টি চেইন শাখা খুলে ফেললেন। বাচ্চাদের আকৃষ্ট করতে তিনি টিভিতে বিজ্ঞাপন চালানো শুরু করলেন আর এরই মাধ্যমে ‘রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ডস’ নামক চরিত্রের সৃষ্টি।
১৯৬০ সালের দিকে ম্যাকডোনাল্ডস কোম্পানির বাৎসরিক নীট লাভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৬ মিলিয়ন ডলারে।
কারো সৌভাগ্য আবার কারোও দুর্ভাগ্য (ক্রকের ‘ম্যাকডোনাল্ডস’র মালিকানা গ্রহণ):
বাৎসরিক ৫৬ মিলিয়ন ডলার আয়ে রে মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না কারণ তাঁর লক্ষ্য আকাশ ছোঁয়া। তিনি স্থির করলেন ফ্রেঞ্চাইজি বাদ দিয়ে ম্যাকডোনাল্ডসের পুরো মালিকানা কিনে নেয়ার।
তিনি গেলেন ম্যাক ভ্রাতাদের কাছে এবং জানতে চাইলেন পুরো ম্যাকডোনাল্ডোস স্বত্ব তাঁরা কতো দামে বিক্রি করতে চান এবং সাথে ‘ম্যাকডোনাল্ডস’ নামটাসহ। তাঁরা ২.৭ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব রাখেন এবং সাথে শর্ত জুড়ে দেন যে স্বত্ব বিক্রি করলেও যেনো তাঁদের মুল পুরনো রেস্টুরেন্ট এর মালিকানা বিষয়ে কোনো আইনত বাধার সৃষ্টি না হয়।

রে ক্রক এবার নেমে পড়লেন অর্থ সংগ্রহের কাজে। তিনি বিভিন্ন খাত হতে অর্থ ধার নিলেন।
‘আমার করার কিছুই ছিলো না। আমার ম্যাকডোনাল্ড নাম এবং স্বর্ণালী M খচিত ব্যানারটির দরকার ছিলো। ‘ক্রক’ নামটি দিয়ে কি আর করতে পারতাম?’ –সাক্ষাৎকারে ক্রক।
তবে দুই ভাইয়ের ম্যাকডোনাল্ড নামে মূল রেস্টুরেন্টের মালিকানা ধরে রাখার প্রস্তাবটি ক্রকের মনঃপুত হলো না। তাঁদের ব্যবসায় নিরুৎসাহিত করতে তিনি সেই রেস্টুরেন্টের পাশেই তাঁর ম্যাকডোনাল্ডসের একটি শাখা স্থাপন করেন। দিনশেষে দুই ভাই ব্যবসায় টিকতে পারে নি।
তবে ম্যাকডোনাল্ডস ভাইয়েরা এই কথাটি মানতে নারাজ যে ক্রক তাঁদের ব্যবসা হতে বিতাড়িত করেছে বরং তাঁরা নিজেরাই ক্রকের কাছে মালিকানা বিক্রির পর বিল্ডিং হতে ম্যাকডোনাল্ডসের নাম এবং সামনে হতে ‘M’ ফলকটি সরিয়ে ফেলেন। বলে রাখা ভালো, স্বর্ণালী রঙের ‘M’ ফলকটির নকশা করেছিলেন রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ড নিজেই।

Source: Empresa-Journal
ম্যাকডোনাল্ডসের সম্পর্কিত অবাক করা তথ্য:
– সারাবিশ্বে ম্যাকডোনাল্ডসের প্রায় ৩৫ হাজার শাখা আছে যা বার্গার কিং (১৪ হাজার), ওয়েন্ডিস (সাড়ে ৬ হাজার) এর চেয়ে বহু গুণ বেশি।
– এক বছরের ভেতর নতুন করে প্রায় ১৩০০ শাখা খোলার রেকর্ড রয়েছে ম্যাকডোনাল্ডসের।
– ম্যাকডোনাল্ডসে কর্মরত কর্মী সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ যা ফিলেডেলফিয়া দেশের জনসংখ্যা হতেও বেশি (১৫ লাখ)।
– ২০১৩ এর এক তথ্যমতে, ম্যাকডোনাল্ডস প্রায় বছরে ৮০৮ মিলিয়ন ডলার বিজ্ঞাপনের পিছে ব্যয় করে।
– ম্যাকডোনাল্ডসের দৈনিক ক্রেতার সংখ্যা প্রায় ৭০ মিলিয়ন যা ফ্রান্সের (৬৬ মিলিয়ন) জনসংখ্যা হতেই বেশি।
– ম্যাকডোনাল্ডস প্রতি সেকেন্ডে ৭৫ টি হ্যাম বার্গার বিক্রি করে।
– কোম্পানির তথ্যমতে, আমেরিকার ৮ জন কর্মীর মধ্যে ১ জন কর্মী ম্যাকডোনাল্ডস কর্তৃক নিয়োগ হয়। এ থেকেই বুঝা যায় নিয়োগের মাধ্যমে ম্যাকডোনাল্ডস কতোটা ভূমিকা রাখে।
– বারমুডা, মন্টেনার্গো, কাযাহস্থান এবং মেসিডোনিয়ায় ম্যাকডোনাল্ডসের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

Source: Atlas Obscura
– ম্যাকডোনাল্ডসের সর্বোচ্চ বিক্রিত অন্যতম পছন্দের আইটেম হলো ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস।
– উইলার্ড স্কট প্রথম হলুদ এবং লাল ডোরাকাটা পোশাকের ‘রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ডস’ চরিত্রে টিভির পর্দায় হাজির হোন। পরে তিনি চাকরীচ্যুত হোন মোটা হয়ে যাওয়ার কারণে চরিত্রের সাথে বেমানান হওয়ায়।
– ১৯৭৩ সালে টিভি প্রোগ্রাম পরিচালক সিড এবং মার্টির করা মামলায় এক মিলিয়ন ডলার জরিমানা প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয় ম্যাকডোনাল্ডসকে। অভিযোগ ছিলো, ম্যাকডোনাল্ডস তাঁদের টিভি শো ‘কনসেপ্ট এন্ড ফিল’ এর।
– ২০১৪ সালে এক ক্রেতা ম্যাকডোনাল্ডসের বিরুদ্ধে দেড় মিলিয়ন ডলারের মামলা ঠুকে দেয় শুধুমাত্র তাঁর অর্ডার করা খাবারের সাথে একটি হাত মুছার ন্যাপকিন দেয়ার কারণে। মামলায় উল্লেখ ছিলো এই কাজের কারণে উক্ত ক্রেতা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগে ছিল।
– ম্যাকডোনাল্ডস বিশ্বের বৃহত্তম খেলনা জিনিস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। প্রতি বছর প্রায় ১.৫ বিলিয়ন খেলনা দেয়া হয় হ্যাপি মিলের সাথে।

Source: 3D Printer World
– বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া ২০০৮ অলিম্পিকে প্রতিযোগী ছিলেন বিশ্বের সেরা দৌড়বিদ উসাইন বোল্ট। অনুষ্ঠান ক্যাম্পের পাশেই ছিলো ম্যাকডোনাল্ডসের আউটলেট। সেখান হতে জামাইকান দৌড়বিদ উসাইন বোল্ট এর প্রায় ১৫০০ চিকেন নাগেটস খাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। তবে এতে কোন সমস্যাই তাঁর হয় নি বরং সেই প্রতিযোগিতায় তিনি স্বর্ণপদক জিতে নেন এবং তিনটি বিশ্বরেকর্ড গড়েন।
– ম্যাকডোনাল্ডস কোম্পানি নিজ উদ্যোগে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠা করে ‘হ্যামবার্গার ইউনিভার্সিটি যেখানে কার্যনির্বাহী কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হত। আজ অবধি ওই ইউনিভার্সিটি হতে প্রায় ২৭ লক্ষ ৫০ হাজার শিক্ষার্থী গ্রাজুয়েট হয়েছে।
– ‘আমেরিকান আইডল’ সঙ্গীতানুষ্ঠানের মতোই ম্যাকডোনাল্ডস নিজস্ব উদ্যোগে আয়োজন করে ‘ভয়েজ অফ ম্যাকডোনলাডস’ যেখানে কর্মরত বিভিন্ন স্থানের ১৮ লক্ষ ম্যাক-কর্মীরা অংশগ্রহণ করে। সম্প্রতি এক আয়োজনে প্রায় ৬৩টি দেশে কর্মরত ৫৮ হাজার ম্যাক-কর্মী এতে অংশগ্রহণ করে। প্রথম পুরষ্কার হিসেবে কলম্বিয়ার লুচি ওস্পিথিয়া নামের একজন কর্মী জিতে নেন ২৫ হাজার ডলার, দ্বিতীয় পুরষ্কার হিসেবে ১৭ হাজার ৫০০ ডলার জিতেন ফিলিপাইনের রকি রোজাবেল, তৃতীয় পুরষ্কার হিসেবে ১২ হাজার ৫০০ ডলার জিতেন ইলিনিয়স নিবাসী এশলে নেলমস।
– ম্যাকডোনাল্ডসের ‘I’m Loving It’ জিঙ্গেলটির লেখক ছিলেন প্যারেল এবং রেকর্ডিং করেন জাস্টিন টিম্বারলেক। যার জন্য টিম্বারলেক পারিশ্রমিক হিসেবে পান ৬ মিলিয়ন ডলার।
– হংকং এবং জাপানে ম্যাকডোনাল্ডসের একটি নিয়ম আছে যা ‘ডোরস আর অলওয়েজ ওপেন’ হিসেবে খ্যাত। এই নিয়মের অধীনে যারা গৃহহীন তাঁরা ম্যাকরিফিউজি হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে।

Source: 3D Printer World
– বিল গেটসের ‘ম্যাকডোনাল্ডস গোল্ড কার্ড’ রয়েছে যা দিয়ে তিনি আনলিমিটেড ফাস্ট ফুড খেতে পারবে তাও একদম বিনামূল্যে।
– ‘Chipotle Mexican Grill’ আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্ট যার ৯০% শেয়ারের মালিক ছিলো ম্যাকডোনাল্ডস। তবে ২০০৮ সালের দিকে ম্যাকডোনাল্ডস তাঁদের শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কারণ ম্যাকডোনাল্ডস এককভাবে নিজেদের ব্যবসায় মনোনিবেশ করতে আগ্রহী ছিলো।
ইতিহাস মনে রাখলেও ক্রক পরবর্তীতে ম্যাকডোনাল্ডসের স্রষ্টা হিসেবে নিজেকেই দাবী করেন। এ ব্যাপারে ম্যাকডোনাল্ডসের আদি প্রতিষ্ঠাতা ডিক ম্যাকডোনাল্ডস এক সাক্ষাৎকারে জানান,
‘যখন আমাদের ব্যবসা স্বত্ব বিক্রি করে দিচ্ছিলাম তখন ক্রক যে এর প্রতিষ্ঠাতা এমন কোন কথা শোনা যায় নি। তবে যদি আমরা শুনতে পেতাম তবে সে হয়তো মিল্কশেক মেশিনই বেচতো।’
যেমনই হবে হোক, রে ক্রক পুরো বিশ্বের বুকে একজন সফল উদ্যোক্তা যার হাত ধরে বিশ্ব পেয়েছে তাঁদের বুকের মধ্যে অবস্থিত এক দৈত্যাকার ফাস্ট ফুড চেইন শপ, যার মাধ্যমেই ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে একের পর এক – যুগ যুগান্তর ধরে।
cheap dutasteride ondansetron 8mg for sale zofran without prescription
purchase levaquin online buy levofloxacin 250mg pill