Cold War বা স্নায়ুযুদ্ধের ইতিবৃত্ত ও বিশ্বব্যাপী এর প্রভাব (প্রথম পর্ব)

1

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আমরা বিশ্বের পরাশক্তিদের মাঝে চলমান স্নায়ুযুদ্ধের কথা শুনে থাকি। আমাদের মনে স্বভাবতই তাই প্রশ্ন জাগে স্নায়ুযুদ্ধ কি বা স্নায়ুযুদ্ধ কাকে বলে?
Cold War বা স্নায়ুযুদ্ধ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী নিজেদের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে সৃষ্ট দুই পরাশক্তি – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার রাজনৈতিক অস্থিরতা। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই দুই দেশ একসাথে মিত্র হয়ে জার্মানি, জাপান তথা অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই এই পরাশক্তিদ্বয় জড়িয়ে পরে স্নায়ুযুদ্ধে।

এটাকে স্নায়ুযুদ্ধ বলার কারণ এই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি বড় ধরণের কোন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেনি, বরং অন্যান্য দেশে বেশ কয়েকটি “পরোক্ষ বা প্রক্সি যুদ্ধ” হয়েছিল, যেখানে এই দুই দেশ দুটি ভিন্ন পক্ষ সমর্থন করেছিল। Cold War বা স্নায়ুযুদ্ধ শুরু বা শেষ হওয়ার আনুষ্ঠানিক কোন তারিখ নেই। তবে সাধারণভাবে এর বিস্তৃতি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত মনে করা হয়।

স্নায়ুযুদ্ধের কারণ হিসেবে যে কয়টি বিষয়কে মূল কারণ বিবেচনা করা যায় তা হচ্ছে –

  • রাজনৈতিক মতানৈক্য
  • বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার
  • পারস্পরিক অবিশ্বাস
  • ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা

স্নায়ুযুদ্ধের ইতিহাসঃ 

রাজনৈতিক মতানৈক্যের ব্যাপারে যে বিষয়টি প্রথমেই সামনে আসে তা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশসমূহ, যেমন- যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, জাপান ও কানাডা ইত্যাদি ছিলো “গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদ”-এর পক্ষে, যা ‘ওয়েস্টার্ন ব্লক’ নামে পরিচিত ছিলো।

অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রবর্তিত “সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্র”-এর পক্ষে ছিল পূর্ব ইউরোপের অনেক রাষ্ট্র, যেমন বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি ও রোমানিয়া ইত্যাদি, যা ‘ইস্টার্ন ব্লক’ হিসেবে পরিচিত ছিলো।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরোপে এবং আংশিক এশিয়াতে (প্রধানত চীন এবং অন্যান্য দেশে)  যেভাবে সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে তাতে ধীরে ধীরে অধিকাংশ দেশেই সমাজতন্ত্রবাদ গ্রহণ করবে এবং বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংখ্যালঘু ও দুর্বল হয়ে যাবে। তাই এই সমাজতন্ত্রের এই বিস্তৃতি থামাতে যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলো।

স্নায়ুযুদ্ধের শুরুর দিকে এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চরমে উঠে ১৯৪৮ সালে বার্লিন অবরোধের মাধ্যমে। বার্লিন শহরটি সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে থাকা পূর্ব জার্মানির অন্তর্গত হলেও সেটিও পশ্চিম বার্লিন ও পূর্ব বার্লিন এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিলো। পূর্ব বার্লিন ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে আর পশ্চিম বার্লিন ছিলো যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পুরো বার্লিন শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিলো। যেহেতু বার্লিন শহরের চারদিক সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রিত তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিম বার্লিনের চারদিক অবরোধ করে অংশে যোগাযোগের (রেলপথ, রাস্তা,খাল) সকল পথ অবরোধ করে ফেলে। এটি Berlin Blockade” বা “বার্লিন অবরোধ” নামে পরিচিত।

এর ফলশ্রুতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো বিমান দিয়ে পশ্চিম বার্লিনে সব ধরণের প্রয়োজনীয় (খাদ্য, বস্ত্র, জ্বালানী ইত্যাদি) সরবরাহ করা চালিয়ে যায়। যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনভাবেই পশ্চিম বার্লিনের নিয়ন্ত্রন নিতে পারছিলো না এবং অবরোধ করে কোন লাভ হচ্ছিলো না, তাই একপর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন বার্লিন অবরোধ তুলে নেয়। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম জার্মানি ও পূর্ব জার্মানি – দুই দেশে বিভক্ত হয়।

বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার জোরদার করা ও ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে দেয়া রোধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৯ সালে কানাডা ও ইউরোপের মিত্র দেশসমূহ নিয়ে North Atlantic Treaty Organization বা  ন্যাটো নামক একটি সামরিক সহযোগিতার জোট গঠন করে। অপরদিকে একই বছর ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে চীনে সমাজতান্ত্রিক শাসনের সূচনা হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরি করে এবং সফলভাবে পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য নষ্ট হয়। স্নায়ুযুদ্ধের সময়টাতে দুই পক্ষের পারমাণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, ব্যালিস্টিক মিসাইল তৈরি ও সামরিক শক্তি প্রদর্শনের এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে বছরের পর বছর। কিন্তু এই স্নায়ুযুদ্ধ কখনও সরাসরি যুদ্ধে রুপ নেয়নি কারণ পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশেই একে অপরকে ধ্বংস (Mutually Assured Destruction) করতে সক্ষম ছিলো।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় প্রথম প্রক্সি যুদ্ধের সূচনা হয়েছিলো ১৯৫০-৫৩ সালের কোরীয় যুদ্ধ এর মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে কোরীয় উপদ্বীপটি জাপানের নিয়ন্ত্রণে ছিলো, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর মার্কিন প্রশাসন কোরীয় উপদ্বীপটিকে “৩৮তম সমান্তরাল” (38’th parallel) রেখায় ভাগ করে, এর দক্ষিণ অর্ধেক অংশ নিজেদের দখলে আনে এবং উত্তর অর্ধেকাংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। কোরীয় উপদ্বীপের উত্তরে প্রতিষ্ঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক সরকার আর অন্যদিকে দক্ষিণে যুক্তরাষ্ট্রের সহয়তায় প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী সরকার। ১৯৫০ সালে উত্তর কোরীয়া দক্ষিণ কোরীয়া আক্রমণ করে এবং অবশেষে ১৯৫৩ সালে কোরীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার মাধ্যমে এই যুদ্ধ সমাপ্ত হয়।

এর পর ১৯৫৩ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইরানের রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্য দিয়ে পরিকল্পিতভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ মোসাদ্দেককে। পরিকল্পনা মাফিক ক্ষমতায় বসানো হয় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নির্ধারিত সরকারপ্রধান রেজা শাহ পাহলভীকে।

এবার আসি ভিয়েতনাম যুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাব প্রসঙ্গে। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে প্রথম ইন্দোচীন যুদ্ধে ভিয়েতনামের মুক্তিকামী বাহিনী ফরাসিদের পরাজিত করে এবং প্রথম  ইন্দোচীন যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু ভিয়েতনামের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ তখনো থামেনি। ১৯৫৪ সালে জেনেভায় সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘সেভেনটিন্থ প্যারালাল’ (17’th parallel) নামক সীমানা দিয়ে ভিয়েতনামকে উত্তর আর দক্ষিণ দুই ভাগ করা হয়েছিল। ভিয়েতনামের সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক সমর্থকরা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সমর্থনে উত্তর ভিয়েতনামের নিয়ন্ত্রণ পায়। অন্যদিকে দক্ষিণ ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে সাম্যবাদ-বিরোধী ভিয়েতনামিরা শাসন শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাস ছিলো যদি সমগ্র ভিয়েতনাম সাম্যবাদী শাসনের অধীনে চলে আসে, তবে “ডমিনো তত্ত্ব” অনুসারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বত্র সাম্যবাদ ছড়িয়ে পড়বে। তাই তারা দক্ষিণ ভিয়েতনামে সাম্যবাদ বিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।

১৯৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামি সরকারের পতন ঠেকাতে সেখানে সৈন্য পাঠায়, কিন্তু এর ফলে যে এক রক্তক্ষয়ী ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় যা “দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ” বা ভিয়েতনাম যুদ্ধ বলে পরিচিত। এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরাজিত হয়। ১৯৭৫ সালে সাম্যবাদী শাসনের অধীনে দুই ভিয়েতনাম একত্রিত হয়। ১৯৭৬ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নাম ধারণ করে।

১৯৬১ সালে “বার্লিন প্রাচীর” নির্মাণ শুরু হওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় বার্লিন সংকট। মূলত ১৯৪৯ সালের জার্মানি বিভাগের পর পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে গড়া পশ্চিম জার্মানির ব্যাপক উন্নতি হয়। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যাবস্থায় গড়া পূর্ব জার্মানির অর্থনৈতিক উন্নয়ন অপেক্ষাকৃত কম থাকায় পশ্চিম জার্মানির অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধায় আকৃষ্ট হয়ে ব্যাপক পরিমাণ পূর্ব জার্মান নাগরিক পশ্চিম জার্মানিতে চলে যেতে শুরু করে। বিপুল পরিমাণ অভিবাসন ঠেকাতে পূর্ব জার্মান সরকার সিদ্ধান্ত নেয় বার্লিনের পশ্চিমাংশ ও পূর্বাংশের মাঝে একটি দেয়াল তুলে দেয়া হবে। এই দেয়াল ১৯৬১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২৮ বছর পশ্চিম বার্লিন থেকে পূর্ব বার্লিন এবং পূর্ব জার্মানির অন্যান্য অংশকে পৃথক করে রেখেছিল।

আজ এ পর্যন্তই। এর পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ের ঘটনাসমূহ ও সমাপ্তি দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করা হবে।

Cold War বা স্নায়ুযুদ্ধের ইতিবৃত্ত ও বিশ্বব্যাপী এর প্রভাব (শেষ পর্ব)

 

Leave A Reply
1 Comment
  1. LarryTig says

    PBN sites
    We will build a structure of PBN sites!

    Merits of our privately-owned blog network:

    WE DO everything so Google doesn’t realize THAT THIS IS A privately-owned blog network!!!

    1- We purchase web domains from separate registrars

    2- The main site is hosted on a VPS hosting (VPS is high-speed hosting)

    3- Other sites are on different hostings

    4- We designate a distinct Google profile to each site with confirmation in Google Search Console.

    5- We create websites on WP, we do not employ plugins with the help of which Trojans penetrate and through which pages on your websites are created.

    6- We never reproduce templates and utilize only distinct text and pictures

    We don’t work with website design; the client, if desired, can then edit the websites to suit his wishes

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More