জর্জ ওয়াশিংটন কি পেরেছিলেন মাউন্ট ভারননের ক্রীতদাসদের মুক্তি দিতে?

জর্জ ওয়াশিংটন, বিশ্ব দরবারে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিতে আর কোন বিশেষণের প্রয়োজন নেই। ১৭৯৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রেসিডেন্ট সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। আমেরিকার জাতির জনকের শেষকৃত্যে কালো ব্যাজ ধারণ করে হাজির হয়েছিল অসংখ্য গুণগ্রাহী। মাউন্ট ভারননের সেই অনুষ্ঠানে উপস্হিত হওয়া অতিথীবৃন্দের মধ্য থেকে জনৈক ব্যক্তি কোন এক বইয়ে লিখেছিলেন, “তাঁর মৃত্যুতে প্রত্যেকেই কমবেশি প্রভাবিত হয়েছে কিন্তু তাঁর গৃহকর্মীদের সামনে সেগুলো কিছুই না।”

ওয়াশিংটনের গৃহকর্মীরা মূলত ছিল ক্রীতদাস। জর্জ ওয়াশিংটন যদিও তাঁর উইলে তাঁর মৃত্যুর পর  ক্রীতদাসদের মুক্তি দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন কিন্তু আদতে অধিকাংশ ক্রীতদাসই মাউন্ট ভারননের শৃঙ্খলিত জীবন থেকে মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করতে পারেনি কয়েক দশক পর্যন্ত ৷ কেবল একজন সৌভাগ্যবান বাদে

কিভাবে এই ক্রীতদাসরা মাউন্ট ভারননে তাঁদের বন্দী জীবন শুরু করেছিল, জর্জ ওয়াশিংটনই বা কেন দাসপ্রথার সাথে যুক্ত ছিলেন একটু পেছন ফিরে দেখা যাক-

জর্জ ওয়াশিংটনের পরিবার  মুলত জমি চাষ এবং দাস ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিল ৷ ১৭৪৩ সালে তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর উত্তরাধিকার সূত্রে মাত্র ১১ বছর বয়সেই দশজন ক্রীতদাসের মালিক হন তিনি ৷ পরবর্তীতে ১৭৫৯ সালে মার্থা কাস্টিসকে বিয়ে করার পর তিনি আরো ৮জন ক্রীতদাস ক্রয় করেন ৷

মার্থার ব্যক্তিগত জীবনের উপর আলোকপাত করলে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।

মার্থা ছিলেন ২৫ বছর বয়সী বিধবা যিনি নিজেও ব্যাক্তিগত দাস নিয়ে এসেছিলেন জর্জকে বিয়ে করার পর ৷ ঐ সময়ে পাত্র পক্ষকে বিয়ের উপঢৌকন হিসেবে ভূসম্পত্তি, নগদ অর্থসহ বিভিন্ন কিছু প্রদানের রেওয়াজ ছিল ৷ যদিও স্ত্রীর পূর্বেই স্বামীর মৃত্যু হলে আইন অনুযায়ী এক তৃতীয়াংশ সম্পত্তি স্ত্রী ভোগ করার সুযোগ পেতো পুরো জীবদ্দশায়। এই প্রথাকে বলা হয় “উইডো’স থার্ড” বা “ডাউয়ার শেয়ার”(যাবজ্জীবন ভরণপোষণের জন্য বিধবাকে প্রদত্ত স্বামীর সম্পত্তি) ৷ স্ত্রীর মৃত্যুর পর পুনরায় সেই সম্পত্তি স্বামীর উত্তরাধিকারদের কাছে চলে যায়।

ক্রীতদাস

ডাউয়ার শেয়ার নীতিমালা মূলত বিধবা মহিলাদের দারিদ্র বিমোচনের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছিল। মার্থার প্রাক্তন স্বামী ড্যানিয়েল পার্ক কাস্টিসের মৃত্যুর পর মার্থার ডাউয়ার শেয়ারের পরিমাণ এত বেশি হয়েছিল যে তিনি ভার্জিনিয়ার বিত্তশালী মহিলাদের একজনে পরিণত হন। কার্যত এই সম্পত্তির মালিক স্ত্রী হলেও পুনর্বিবাহের পর এটা স্বামীর তত্ত্বাবধানে চলে যেত। সেই হিসেবে ওয়াশিংটন সবকিছু দেখাশুনার দায়িত্ব পান।

উল্লেখ্য, ডাউয়ার শেয়ারে ভূসম্পত্তির পাশাপাশি ক্রীতদাসরাও অন্তর্ভূক্ত থাকতো। তাঁরই ধারাবাহিকতায় মার্থা বিয়ের পর ৮৪ জন ক্রীতদাস সাথে নিয়ে আসেন ৷

ওয়াশিংটন যদিও তাঁর ক্রীতদাসদের সুযোগ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করতেন তবুও বিভিন্ন সময় অনেকেই তাঁর ব্যক্তিগত আক্রোশের স্বীকার হয়েছে ৷ কারণ তিনি উর্বর জমিতে চাষাবাদের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন৷ আর এই কৃষি সম্প্রসারণের কাজে ক্রীতদাসরাই মূখ্য ভূমিকা পালন করতো ৷

আমেরিকার বিপ্লবী যুদ্ধের সময় মানুষ কেনা-বেচার বিষয়টা তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করল৷ যদিও তিনি দাসপ্রথা বিলুপ্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেও ব্যক্তিগতভাবে এর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি৷ বরং একসময় তিনি এটাকে আরো বর্ধিত করার কথাও চিন্তা করেছিলেন। হয়তো তাঁর চাষাবাদ, ভূসম্পত্তি, সামাজিক অবস্হান সবকিছুই ক্রীতদাসদের উপর নির্ভরশীল ছিল বলেই৷

এরিকা আর্মস্ট্রং ডানবার নামে একজন লেখক তাঁর বই, ” Never Caught: The Washington’s Relentless Pursuit of Their Runaway Slave, Ona Judge”, তে উল্লেখ করেন , ১৭৯৬ সালে মার্থার কোন এক ক্রীতদাস পালিয়ে গেলে ওয়াশিংটন তাঁর জীবনের শেষ তিনটি বছর ব্যয় করেন তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায়৷

ধারণা করা হয়, তাঁর এই অন্তদ্বন্দতা থেকেই হয়তো তিনি দাসমুক্তির উইল করেছিলেন ৷

তাঁর মনে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, দাসমুক্তির বিষয়টা খুব সহজ হবে না তারচেয়ে বরং মার্থা যতদিন চায় তাঁর অধীনস্হ থাকাটাই তাদের জন্য ভালো ৷ এমনকি তাঁর উইলেও মুক্তির কথা উল্লেখ থাকলেও শর্ত হিসেবে বলা ছিল মার্থা যতদিন চাইবে তাঁর সাথে থাকতে হবে।

যেহেতু মার্থার দাসদের উপর তাঁর কোন অধিকার ছিল না তাই  তাদের মুক্তির ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি। বরং তাদেরকে ব্যবহার করে চলমান দাসপ্রথাকে সমর্থন করেছিলেন।

ওয়াশিংটন মারা যাওয়ার মূহূর্তে সর্বসাকুল্যে তাঁর অধিনস্হ ক্রীতদাসের সংখ্যা ছিল প্রায় ১২৩ ৷  অথচ মার্থা স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী কেবলমাত্র উইলিয়াম লি নামে একজন ক্রীতদাসকে মুক্তি দিয়েছিল ৷ এই হচ্ছে পূর্বোল্লেখিত সেই সৌভাগ্যবান ক্রীতদাস। লি বিপ্লবী যুদ্ধে ওয়াশিংটনের সাথে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ৷

অবশেষে, মার্থাকে কোন এক ক্রীতদাস বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে চেয়েছিল, এমন গুজবের ভিত্তিতে তিনি জর্জের বাকি ক্রীতদাসদের তাঁর মৃত্যুর প্রায় বছর খানেক পর মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে শুধুমাত্র এটাই কি ছিল মূল কারণ ?

ক্রীতদাস

ধারণা করা হয়,মার্থার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল তাঁর স্বামীর ক্রীতদাসদের দেখাশুনা করার অজুহাতে ছেলেমেয়েদের সম্পত্তি থেকে টাকা পয়সা আদায় করার একটা কৌশল। নতুবা জর্জের শঙ্কা অনুযায়ী তাঁর ক্রীতদাসদের মুক্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া আদৌতে মোটেও জটিল ছিল না ৷

অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ,  ১৮০১ সালের জানুযারি মাসে মাউন্ট ভারননে তাদের বন্দী জীবনের অবসান ঘটে ৷ জর্জের ক্রীতদাসদের মত মার্থার ১৫৩ ব্যক্তিগত ক্রীতদাসের দিকে ভাগ্যদেবী মুখ তুলে তাকায়নি।

১৮০২ সালে মার্থার মৃত্যুর পর তাঁর ক্রীতদাসদের অধীনস্হ করে নেয় তাঁর ছেলে মেয়েরা ৷ তাঁরা জীবদ্দশায় গুটিকয়েক দাস বাদে কাউকেই মুক্তি দেয়নি ৷

এমনকি মার্থা নিজেও মালিকাধিন থাকা অবস্থায়  একজনকেও মুক্তি দেয়নি ৷

প্রকৃতপক্ষে জর্জ ওয়াশিংটনের দাসমুক্তির ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী চিন্তা ভাবনা থাকলেও আপাতদৃষ্টিতে তাঁর পরিবার কখনোই দাসমুক্তির বিষয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেনি ৷

 

তথ্যসুত্রঃ Mount Vernon

Source
Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More