চাইনিজ মিথলজি সিরিজ (১ম পর্ব ) – মহাবিশ্ব কোথা থেকে কেমন করে এল?

2

না ছিল কোনও স্বর্গ, না ছিল কোনও পৃথিবী। ছিল কেবল মাতৃজঠরের অন্ধকার। মহাবিশ্বের সমস্ত শক্তিই বন্দী হয়ে ছিল একটা ছোট্ট ডিমের ভেতর, অনিয়মের উচ্ছৃঙ্খলায়, প্রতিনিয়ত হইহট্টগোলের উল্লাসে।

এই ডিমের ভেতরেই ছিল আরেকটা ছোট্ট জীব, নাম পাঙ্গু। চারিপাশের এই গোলমাল, হৈচৈ কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যে কি না আরামসে ঘুমাত সারাবেলা। এই ঘুমের মধ্যেই সে বড় হতো, আর তার সাথে সাথে ডিমটাও বাড়তে থাকত। প্রায় আঠার হাজার বছর ধরে ঘুমাচ্ছিল সে শান্তিতেই, সেই সাথে আস্তে আস্তে তার ছোট্ট শরীরটাও বাড়তে বাড়তে ভয়ানক শক্তিশালী দৈত্যের মত হয়ে গেল। প্রায় নব্বুই হাজার লি (প্রায় তিরিশ হাজার মাইল) লম্বা। সেই ডিমের ভেতরে যেমন পাঙ্গু ছিল তেমনি সেই মস্ত ধুন্ধুমার শক্তি সদলবলেই ছিল। সকলেই বাড়ছিল।

চাইনিজ মিথলজি

একদিন, যখন একেবাইরেই অস্থিতিশীল অবস্থা শুরু হয়ে গেল, পাঙ্গুর ঘুম ভাঙল। চারিদিকে অন্ধকার, দ্বিধার পাহাড় ছাড়া তো কিছু নেই। প্রথম প্রথম তো মজাই লাগে, পাঙ্গুও অবাক বিস্ময়ে উপভোগ করছিল চারিপাশে ছোটছোট করে অনিয়মিত বিস্ফোরন। অবশ্য, খানিক বাদেই কর্কশ শব্দে আর অদ্ভুত এই অবস্থার প্রতি বিরক্তি ধরে গেল। নিয়ত এই তোলপাড় যেন মাথায় উঠে গেল। যতই সে এইসব দেখতে থাকল ততই তার সেই পুরনো শান্তির ঘুমের জন্যে মন কেমন করতে শুরু করল। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, সে টের পেতে শুরু করল, এরকম চলতে থাকলে যেকোন সময়ে এই পুরো ব্যবস্থা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। আর কেউ তো নেই, পাঙ্গু জানত, তাকেই কিছু একটা করতে হবে। তাই সে একটু অপেক্ষা করল ভেতরটার একটু কিছুক্ষণের জন্যে শান্ত হবার। তারপর সে একটা উল্কা পেল, ওটাকেই কুড়ালের মতন করে সমস্ত শক্তি দিয়ে ডিমের একদম মধ্যিখানে আঘাত করল। ভয়ঙ্কর গর্জন করে ফেটে গেল। সেই শব্দ আরো জোরদার হয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল আর সেই সাথে ভেতরকার সকল কণা, শক্তি আর যা কিছু আছে – দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল। আবিষ্কৃত হল, ভালো এবং মন্দ। আলো, শক্তির বিশুদ্ধ রূপ উপরে ভেসে চলে গেল আর জন্ম নিল স্বর্গ। আর, ডার্ক যে শক্তি, তাই নিচে জড় হতে হতে মৃত্তিকা, পৃথিবী। চাইনিজ মিথলজি পাঙ্গু আনন্দ নিয়ে দেখল তার হাতের থেকে তৈরী এই রঙ্গশালা। এতে সৌন্দর্য রইল, নিয়ম থাকল আর শান্তির শীতলতাও ধরা দিল। এই অসামান্য সৃষ্টি নষ্ট হতে দেয়া যায় না, চুলোয় যাক ঘুম, পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখতে হবে। পাঙ্গু দুই হাতে আলিঙ্গন করল আকাশের বিশালতা, পৃথিবী আর স্বর্গের মধ্যেকার গোঁজ হয়ে দাঁড়াল মহাশক্তিধর একেশ্বর- পাঙ্গু। প্রতিনিয়ত সে আকাশকে ঠেলতে লাগল পৃথিবী থেকে আরও দূরে। যুগের পর যুগ সে আকাশকে ধরে রাখল নিজ হাতে কোনওরকম অভিযোগ নেই। একটাই চিন্তা- আবার যেন সব হারিয়ে না যায়। দিন যায়, দিনের পর দিন যায়… ঈশ্বরেরও ক্লান্ত লাগে। জগতের ভার তার পেশীকে ক্রমেই দুর্বলতর করে তুলছিল। শতাব্দী কেটে যায়, পাঙ্গুর শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরায় অসহ্য যন্ত্রণা, চেঁচিয়ে সাহায্যের জন্যে কেঁদে মরল সে, কোথাও কেউ নেই- কখনোই ছিল না। প্রতিধ্বনিত কান্না অসম্ভব শূন্যতা নিয়ে ওর কানেই রসিকতার মত বাজতে লাগল। প্রতিটি মুহূর্ত মুক্তির জন্যে প্রার্থনা করে যেতে যেতে সে টের পেল, কেউ আসবে না। তার এই একলা সংগ্রামের ফাঁকে স্বর্গ আর পৃথিবী ভুলে গেল একে অপরকে। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা শক্তি ইন (অন্ধকার), ইয়াং (আলো) অবয়ব পেল।

চাইনিজ মিথলজি

শেষমেশ, যখন আকাশকে টেনে নিল স্বর্গ আর নিচে গেঁথে গেল পৃথিবী- পাঙ্গু রেহাই পেল তার এই একান্ত যন্ত্রণার যাত্রা থেকে। ততদিনে কি অবস্থা হয়েছে তার! শরীরে শক্তি নেই, দেহে বয়সের নিষ্ঠুর ছাপ। প্রখর নিঃশ্বাস হয়েছে দীর্ঘশ্বাস। শয়ে শয়ে বছরের ক্লান্তি এই একলা জায়ান্টকে নিয়ে ফেলে দিন ধুলোমাটির পৃথিবীতে। সকলই ফুরিয়েছে তার, ততদিনে।

তার বিশাল, বিষণ্ণ দেহটাকে ধরণী আঁকড়ে নিল ভালবাসার শ্রদ্ধাবোধে, সবুজ ঘাসে ঢেকে দিল তাঁকে। ঘুমাও। এই ঘুম চেয়েছিলে না? পৃথিবীতে জেগে উঠল পাহাড়। পাঙ্গুর নিঃশ্বাসকে আজ আমরা বাতাস বলে চিনি, ওঁর চোখের জলকে নাম দিয়েছি বৃষ্টি। মাথার চুল-দাঁড়ি দিন গেলে হয়েছে নানান গাছগাছালি। আর যা কিছু দামী- সোনা, রুপো আর হীরে, সেও পাঙ্গুরই অবদান, ওরই হাড়, দাঁত এইসব। ওঁর গলার স্বরকে মানুষেরা আজও বজ্র বলে ভুল করে। ওঁর রক্তেই আমাদের এত নদী। আর, মরবার সময়ে পাঙ্গুর যে চোখের জল, সেই পবিত্র অশ্রু হয়েছে সমুদ্র। তাই এখনও সাগরের পাশে দাঁড়ালে আমাদের মন উচাটন।

তো, পাঙ্গু, সব কাজ শেষ করে মরে গেলেন এই পৃথিবীতেই। রেখে গেলেন ঝলমলে একটি রঙিন পৃথিবী যাতে এখন রাজত্ব করছি আমরা! আমরা, মানুষেরা, শোনা যায় আমরা এসেছিলাম পাঙ্গুর শরীরের রক্তখেকো এক পরজীবী কীট থেকে- সত্যিমিথ্যে জানি না, আজকের দিনে চারপাশে তাকালে অবিশ্বাস করিই বা কী করে!

Leave A Reply

Your email address will not be published.

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More