একবার ভাবুন তো, আপনি দাড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের একেবারে শেষ প্রান্তের মাটি স্পর্শ করে,চার পাশে পানি আর পানি তাঁর মাঝে একটুকরো দ্বীপ এ আপনি একা একলা, সঙ্গী শুধু রূপসী এক চাঁদ।বাধ ভাঙ্গা সেই চাঁদের আলোয় পুরো সমুদ্র জ্যোৎস্না গোসল করছেন। চারিদিকে শো শো বাতাস,সমুদ্রের গর্জন।যতসব ক্লান্তি দুঃখ একপাশে আর অন্যদিকে আকাশপানে চেয়ে দেখায় সমুদ্র অবগাহন।
ছেঁড়া দ্বীপ হলো বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণের সর্বশেষ বিন্দু। দক্ষিণ দিকে এর পরে বাংলাদেশের আর কোনও ভূখণ্ড নেই।সেন্ট মার্টিন থেকে বিচ্ছিন্ন ১০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটার আয়তনবিশিষ্ট কয়েকটি দ্বীপ রয়েছে, যেগুলোকে স্থানীয়ভাবে ‘ছেঁড়াদিয়া’ বা ‘সিরাদিয়া’ বলা হয়ে থাকে। ছেঁড়া অর্থ বিচ্ছিন্ন বা আলাদা, আর মূল দ্বীপ-ভূখণ্ড থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন বলেই এ দ্বীপপুঞ্জের নাম ছেঁড়া দ্বীপ।
ছেঁড়া দ্বীপ এ যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর ১ টা।ছেঁড়া দ্বীপ এ আসলে আসার উদ্দেশ্যও ছিল না, সেন্টমারটিন এ যে হোটেল এ উঠেছিলাম সকাল এ সেখান থেকে বেরিয়েছিলাম পুরো বীচ চক্কর দেয়ার উদ্দেশ্যে।টিম এ আমরা ৮ জন।হাটতে হাটতে বীচ এর সর্ব দক্ষিণের প্রান্তে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর ১২ টা।বীচ এর কোনের প্রান্তে এসে অবাক আমরা সবাই।জানতাম যে ছেঁড়া দ্বীপ এ যেতে হয় ট্রলার কিংবা স্পীড-বোট এ,কিন্তু এখন দেখছি সামনে ছেঁড়া দ্বীপ আর আমাদের মাঝে দূরত্ব বেশী হলে দেড় কিলো।সেন্টমারটিন এর মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন অংশে পানি থাকার কথা জানতাম,কিন্তু এখন পানি নেই।কারণ টা ভাটা চলছে।আর কিছু ভেবে না ভেবে সবাই চিন্তা করলাম যাই ঘুরে আসি ছেঁড়া দ্বীপ থেকে। তো যেই ভাবা সেই কাজ,হাটা শুরু।

দ্বীপ এ পৌঁছে পেলাম গোটা বিশেক টুরিস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছেন।বাড়ি ঘর বলতে এই ছেরা দ্বীপ এ থাকে ইউনুস আলী ও তার পরিবার।আলাপ করে জানতে পারলাম দ্বীপটা সবচেয়ে প্রথমে আবিষ্কার করেন এই ইউনুস আলী ই।দ্বীপ এ তিনটে দোকান,একটা ইউনুস আলীর,চালায় ইউনুস আলীর ছেলে সাদ্দাম ও তার মা।বাকিরা সন্ধ্যায় ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেলেও এখানে স্থায়ীভাবে থাকে সাদ্দামরা।আমরা প্রথমে সাদ্দাম এর দোকান এই গিয়ে থেমেছিলাম,এতক্ষণ হাটার ক্লান্তি দূর হল কচি ডাব এর পানি খেয়ে।দ্বীপ এর দোকানগুলোতে চিপস,বিস্কিট,ডাব আর কোমল পানীয় ব্যতীত কিছুই পাওয়া যায়না,শুধু সাদ্দামদের দোকান এই শুধুমাত্র দুপুরের খাবার রান্না করা হয়,মাছ,মুরগি,ভর্তা আর ডাল।সাদ্দাম আমাদের বয়েসীই ছিল তাই অল্পতেই বন্ধু বানায়ে ফেললাম।ও হ্যাঁ একটা কথা বলাই হয়নি।আগে ভাবতাম ছেঁড়া দ্বীপ এ থাকা যায়না,গিয়ে ধারনা বদলাল অবশ্য।আপনি থাকতে পারবেন সাদ্দাম এর দোকান এর সাথে ওদের ই একটা তাঁবু আছে তাতে,তবে সেক্ষেত্রে ওরা লোক বুঝে থাকার কথা বলে।

সাদ্দাম কে বলেছিলাম যাতে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে।ও হ্যাঁ এখানে রান্না করা থাকেনা,আপনি বললে রান্না শুরু হবে। খাবার রান্না হতে হতে পুরো দ্বীপ টা ঘুরে দেখতে থাকলাম।পুরো দ্বীপ এ কেয়া গাছের বাগান,চতুর্দিকে প্রবাল আর প্রবাল।একটু পর জানতে পারলাম খাবার রেডি।খাবার আলু ভর্তা,ডাল,মুরগি।খেতে খেতে সাদ্দাম এর কাছ থেকে শুনতে পেলাম এই জায়গাতে একটা প্রবাল প্রাচীর এর নাম মৌসুমি পাথর।ওমা মৌসুমি পাথর? কাহিনী কি? ও বলল কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবিতে সালমান শাহ আর মৌসুমি নাকি এর উপরে নেচেছিল,তখন থেকেই এর নাম মৌসুমি পাথর।খাবার শেষে মাছ শিকারি আমাদের কয়েকজন প্রবাল এর খাড়ি তে ছোট ছোট পোনা মাছ ধরাধরিতে মত্ত।তখন বিকেল পাঁচ টা।একে একে দ্বীপ এ আশা দুইটা ট্রলার তাদের টুরিস্ট দের নিয়ে সেন্টমারটিন ফিরে যাবার অপেক্ষায়,ততোক্ষণে জোয়ার চলছে।একেবারে শেষ পাথরটায় গিয়ে দাঁড়ালাম,সন্ধ্যা মিলিয়ে আসছে।একে কে ট্রলার গুলো ছেড়ে দিল।
মনে হচ্ছিল একলা আমি পড়ে আছি এই দ্বীপ এ,সবাই ছেড়ে চলে যাচ্ছে আমাকে।যতদূর ট্রলার দেখা যায় তাকিয়েই রইলাম দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত।দ্বীপ এ আমরা কয়েকজন আর সাদ্দাম,তার মা আর এক বোন।ও হ্যাঁ এর মাঝে আমাদের চারজন জোয়ারের আগেই হেটে চলে গিয়েছিল সেন্টমারটিন এ আমাদের হোটেল এ,মোবাইল ক্যামেরা চার্জ,টাকা পয়সা আর আমাদের কাপড়চোপড় আনতে।একমাত্র আমরা এই কয়েকজন থাকব এই দ্বীপ এ আর কেউ নেই।জানিনা কতটা ডুবে যায় এই দ্বীপ জোয়ার এ অথবা রাতে ঝড় শুরু হলেই বা কোথায় যাব কিভাবে যাব।নেই মোবাইল এ চার্জ,নেই বিদ্যুৎ,আশে পাশে নেই কোন বাড়িঘর।ভাবতেই শিহরন খেয়ে গেল শিরদাঁড়ায়। সন্ধ্যা নামল,রাত বাড়ল।রাত যখন ১১ টা তখন ফিরে এলে আমাদের বাকিরা সাথে সাদ্দাম হাতে মাছ।ওরা নাকি প্ল্যান করেছিল রাতে বারবিকিউ করবে মাছের।তো শুরু হল বারবিকিউ এর জন্যে রান্নার যোগাড়যন্ত্র,এর মাঝে সাদ্দাম এর সাথে এমনি বন্ধুত্ব হয়েছে যে ও বারবিকিউ করে আমাদের খাওয়ানোর জন্য রাতেই বোন থেকে কাঠ জোগাড় থেকে শুরু করে চুলা বানানো বারবিকিউ এর যোগাড়যন্ত্র শুরু করল নো এক্সকিউজ এ আর নো পেমেন্ট এ।
এই একলা একটা দ্বীপ এ নিজেরা কয়েকজন,আর কেউ নেই, বারবিকিউ সাথে ক্যাম্প-ফায়ার,ভাবতে পারছেন আমাদের মনের অবস্থা টা। সবাই খুশিতে বকবাকুম।বারবিকিউ হতে হতে চতুর্দিকে গোল হয়ে বসে চলল পিঙ্ক ফ্লয়েড,মেটালিকা আর গান্স অব রোজেজ আর সেই সাথে হেমন্ত আর অঞ্জন দত্ত তো আছেই।এর মাঝে রূপচাঁদা মাছের বারবিকিউ রেডি রাত তখন ১ টা।খেতে খেতে শুনলাম আসল কাহিনী।১০ টার দিকে আমার বন্ধুরা আর সাদ্দাম যখন ফিরে তখন নাকি ভরা জোয়ার আমরা তো জানিনা জোয়ার এ দ্বীপ এর সাথে সেন্টমারটিন এর যে চ্যানেল আছে তার কি অবস্থা হয়।ওরা এসে নাকি দেখে পানি উঠে গেছে ততক্ষণে।একটা ভাঙ্গা নৌকা অবশ্য খোঁজে বের করা হয়েছে দ্বীপ এর কোনায় বালির খাড়ি তে ভেতরে ঢোকানো।এমনিতে দিনের বেলায় একজন মাঝি লোকজনকে পার করে দেয়,কিন্তু রাতে কেউ থাকেনা ছেঁড়াদ্বীপ এ,চলাচল নেই তাই কোন নৌকাও নাই।সেই নৌকাটাকেই ঠেলে ঠুলে নাকি পানিতে নামানো হল।নাই কোন বৈঠা।বড়ই গাছের ডাল দিয়ে বানানো হল বৈঠা।নৌকায় সবাই উঠার চেষ্টা করে দেখা গেল নৌকা ডুবে ডুবে।আমার টিমের ওরা আবার কেউ ই সাতার পারেনা।অগত্যা সাদ্দাম ওদের নৌকায় উঠিয়ে নিজে পানিতে নেমে সাতার কেটে কেটে নৌকা টেনে নিচ্ছিল। মাঝ চ্যানেলে ঘটল বিপত্তি,নৌকা নাকি ছিদ্র ছিল।পানি উঠা শুরু আস্তে আস্তে।সাদ্দাম এই অবস্থা দেখে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সাঁতরে টেনে পাড়ে আনে।এই ঘটনা শুনে শিরদাঁড়ায় আবার ঘাম ছুটে গেল আমাদের ই।যাই হোক আল্লাহর রহমতে সবাই তো ঝক্কি ঝামেলা ছাড়াই এসেছে এতেই শান্তি।ক্যাম্প-ফায়ার এর আগুন যতক্ষণ ছিল ততোক্ষণ চলল আড্ডা।রাত তখন ২ টা,শীত বাড়তে শুরু করেছে।সাদ্দাম এর মা আগে থেকেই তাবুতে থাকার বন্দোবস্ত করে রেখেছিল আমাদের জন্য।তাবুতে ঢুকে দেখি একটা ত্রিপল নিচে বিছানো,বাসের লম্বা একটা সীট দিয়েছিল সাদ্দামের মা বালিশ বানিয়ে থাকার জন্য আর দিয়েছিল একটা পাতলা কম্বল।সারাদিনের ক্লান্তিতে কয়েকজন ঘুমিয়ে গেল।বাকিরা গল্প,গুজব চলতে থাকল, সাথে সমুদ্রের গর্জন। রাত বাজে তিনটে।হঠাৎ মনে হল বাইরে বেরিয়ে আসি একলা।
তাঁবুর বাইরে বেড়িয়ে যা পেলাম কল্পনাতীত।এ যেন স্বর্গসুখ।পূর্ণিমা রাতের পূর্ণযৌবনা চাঁদ টা ঠিক মাথার উপর।সামনে হেটে গেলাম,তখন পুরো জোয়ার চলছে,আশে পাশে কেউ নেই কিছু নেই।আমি,আমার পৃথিবী,এই চাঁদ আর চারপাশে পানি আর পানি।জীবনের মানে খোঁজতে থাকলাম। কেন এই পৃথিবীতে এসেছি,কি করছি,কতটা করলাম এই সুন্দর পৃথিবীর জন্য,আবার কোথায় হারিয়ে যাব,সকল প্রশ্নের উত্তর খোঁজতে থাকলাম আপনমনে। এমন পরিবেশে দার্শনিক হয়ে যাওয়া যায় অনেকটাই।সমুদ্রের গর্জন আর চাঁদের আলোর সৌন্দর্যে মনে হল আহ সারাজীবন যদি এইখান টায় থেকে যেতে পারতাম।খালি চোখেই মিল্কিওয়ে দেখার সৌভাগ্য হল।সৌন্দর্য শিকারিদের কাছে মিল্কিওয়ে আর আকাশের ছবি এর চেয়ে ভাল বোধহয় বাংলাদেশের কোথায় পাওয়া যাবেনা আশা করি।হঠাৎ খেয়াল করলাম যেই জায়গায় দাড়িয়ে সকল কিছু ভাবছি সেই খানে পানি অনেক কাছে চলে এসেছে দুই পাশেই।চতুর্দিকে তিন হাত দূরেই পানি চলে এসেছে।জোয়ার এর পানি আরও বাড়বে।ঘড়িতে রাত ৪ টা।হালকা পানি পেরিয়ে আসলাম তাবুতে।ততোক্ষণে সবাই ঘুমিয়ে গেছে।কষ্ট করে একটু জায়গা বের করে শুয়ে পড়লাম।সমুদ্রের গর্জন যে কতটা ভয়ানক হতে পারে শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।সকালে উঠে তাঁবুর বাইরে বেড়িয়ে দেখলাম ভাটা চলছে।পানির রেখা স্পষ্ট বালিতে ছাপ,দেখে বুঝলাম কাল রাতে তাঁবু থেকে চার হাত দূরত্বেই জোয়ারের পানি চলে এসেছিল।খানিক বাদে সাদ্দাম আর তার মাকে বিদায় জানিয়ে সেন্টমারটিন এর পথে হাটা শুরু।চ্যানেল পার হয়ে বীচ এর যেদিকটা গতকাল দেখা হয়নি সেই দিক দিয়ে হেটে পৌঁছলাম হোটেল এ।ভাবছিলাম জীবনের সেরা রাত টা বুঝি গতরাতেই কাটিয়েছি।
order avodart sale buy generic avodart buy ondansetron pills
levaquin 250mg generic levofloxacin 500mg us