ইরাকের একসময়ের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী , প্রবল প্রতাপশালী শাসক, যিনি শক্ত হাতে দেশ শাসন করছেন পুরো চার দশক ধরে, যার নামের সাথে ইরাকের সমৃদ্ধি ও ধ্বংস দুটো ইতিহাসই মিশে আছে তিনি হচ্ছেন সাদ্দাম হোসেন। পুরো নাম সাদ্দাম হোসেন আব্দুল মজিদ আল তিকরিতি। ১৯৭৯ সালের ১৬ জুলাই ইরাকের পঞ্চম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। চার দশক কঠোর হাতে দেশ শাসনের পর ২০০৩ সালের ৯ এপ্রিল। ক্ষমতাচ্যুত হন।
জন্ম ও পরিবারঃ
১৯৩৭ সালের ২৮ এপ্রিল আল- আওজা নামক শহরের একটি মেষপালক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই বিখ্যাত স্বৈরশাসককে তার মাতা ‘সাদ্দাম’ নাম রেখেছিলো। তিনি যখন মাত্র ছয় মাস বয়সী ছিলেন তখন তার পিতা পরিবার পরিত্যাগ করেছিলেন। পরিবারে দুর্বিপাক যোগ হবার কারণে দশ বছর বয়সে সাদ্দাম তার চাচার সাথে থাকার জন্য বাগদাদে চলে যান।
রাজনৈতিক জীবন ও ক্ষমতায় আরোহণঃ
স্কুলজীবনের গন্ডি পেরোতেই তিনি বাথ পার্টির সাথে পরিচিত হন। সেখানে যুক্ত হওয়ার পর তিনি বাথিজম মতাদর্শের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন এবং ১৯৫৭ সালে দলের সক্রিয় সদস্য হন। বাথিজম হচ্ছে আরব জাতীয়তাবাদী ও সমাজতন্ত্রবাদী একটি মিশ্র চেতনা।যার প্রধান লক্ষ্য ছিল বিপ্লবী সরকারের অধীনে একটি অবিভক্ত আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
১৯৫৮ সালে ইরাককে একটি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হলে কাসিম তার প্রধানমন্ত্রী হন। বাথিজম প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বাথ আন্দোলনের অনুসারীরা প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে এবং সাদ্দামকে এই অপারেশন পরিচালনার নেতৃত্ব দেওয়া হয়। অপারেশন ব্যর্থ হলে সাদ্দাম সিরিয়ায় পালিয়ে যান এবং সেখানে তাকে আশ্রয় দেয় মিশেল আফ্লাক, বাথিজমের সহ-প্রতিষ্ঠাতার একজন। ১৯৬৩ সালে, কাশেমকে ইরাকের ফ্রি অফিসারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, যা ছিলো একটি গুপ্তঘাতক জঙ্গি সংগঠন।পরবর্তীতে ইরাকের ফ্রি অফিসারদের সদস্য আবদুল সালাম আরিফ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
এমতাবস্থায় সাদ্দাম হোসেন অন্যান্য কিছু নির্বাসিত নেতাদের সঙ্গে একটি ভাল ভবিষ্যতের জন্য আশা করে ইরাকে ফিরে। কিন্তু আশ্চর্য হয়! আরিফ তার মন্ত্রিসভা থেকে অনেক বাথিজম নেতাদের গুম এবং তাদের গ্রেফতারের জন্য আদেশ দেন। ১৯৬৬ সালে কারাগারে থাকা সাদ্দামকে বাথ পার্টির আঞ্চলিক কমান্ডের উপ-সচিব নিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি ১৯৬৭ সালে কারাগারে থেকে পালিয়ে যান এবং তার দল পুনর্গঠন এবং পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ইরাকে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করেন করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।সাদ্দাম ১৯৬৮ সালে সংগঠিত অভ্যুত্থানে নেতৃত্ত দেন যা বাথ পার্টিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে।
বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসার পর আহমেদ হাসান আল বকর প্রেসিডেন্ট হন। সাদ্দাম তখন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন।
১৯৭৯ সালে, ইরাক ও সিরিয়াকে একত্রিত করার জন্য একটি উদ্যোগ গ্রহীত হলে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল আসাদ নতুন সরকারের উপনেতা হন। এই পদক্ষেপ সাদ্দামের হুমকি হিসেবে রূপ নেয় এবং আসাদ এর জনপ্রিয়তা তাকে ছাড়িয়ে যাবে এমন আশংকায় তিনি রাষ্ট্রপতি আল-বাকরকে পদত্যাগ করতে চাপ দেন এবং নিজেকে নতুন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন।
জনপ্রিয়তা অর্জনঃ
সাদ্দামের নতুন ব্যবস্থার অধীনে ইরাক বিকাশ লাভ করে।তিনি নতুন একটি বাহিনী গঠন করেছিলেন যা সরকারের জন্য হুমকি স্বরুপ বিভিন্ন ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যাবহার করা হতো। তার এক বড় সংস্কার ছিলো ১৯৭৩ সালের জ্বালানি সংকটের আগেই ইরাকের তেল শিল্পের জাতীয়করণ। যার ফলে দেশটির বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হয়েছিল এবং ব্যাপক সমৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছিল।এই সময় তিনি ইরাকের জন্য প্রথম রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবস্থার উন্নয়নে সহায়তা করেন এবং আরো কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর জন্য অত্যাধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্থাপন করেন।এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি সেসময় বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন যা ইরাকে তার ক্ষমতাকে আরও সুসংহত ও দীর্ঘায়িত করে।
বিরোধীদের প্রতি ব্যাপক দমননীতি,ক্ষমতার আগ্রাসন
বিরোধীদের প্রতি তিনি ছিলেন প্রবল বিদ্বেষপরায়ন ও কঠোরহস্ত।তার রাজনৈতিক বিরোধীরা সটকে পড়ার আগেই সকলের বিচার করা হয় এবং সবাইকে দেশদ্রোহের দায়ে দোষী প্রমাণিত হয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে একটি ইসলামী বিপ্লব ইরাকে প্রবেশ করতে শুরু করে।সাদ্দাম সেগুলো কঠোরহস্তে দমন করেন ও বিদ্রোহীদের প্রায় সবাইকেই কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করেন।
ইরান আক্রমণঃ
ইরানের সাথে যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে । অন্যায়ভাবে এই যুদ্ধ তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।সাদ্দাম হোসেন এই যুদ্ধকে ব্যাটল অব ক্বাদেসিয়া নামে অভিহিত করেছিলেন। সীমান্ত বিরোধ, ইরাকের অভ্যন্তরে শিয়া জংগীদের ইরানি মদদ দেওয়া ও ইরাকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারিক আজিজের হত্যা চেষ্টার অভিযোগ দেখিয়ে সাদ্দাম ইরান আক্রমণ করেন। ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাকি বাহিনী পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই অবৈধভাবে ইরানি ভূ খন্ডে অনুপ্রবেশ করে ও ব্যাপক আক্রমণ চালায়।ইরানও প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে ও পাল্টা আক্রমণ চালায়। ইরান-ইরাক যুদ্ধের মূল কারণ হিসেবে সাদ্দামের উচ্চাভিলাষ ও আগ্রাসী মনোভাবকেই প্রধানভাবে দায়ী করা হয়।তার সপ্ন ছিল পারস্য উপসাগরের ওপর নিজের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। সদ্য ঘটে যাওয়া ইরানি ইসলামি বিপ্লবের নাজুক অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে ইরাক যুদ্ধে দ্রুত অগ্রগতি অর্জনের চেষ্টা চালিয়েছিল।লম্বা সময়ব্যাপী এ যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ সৈন্য ও লক্ষ্যাধিক সাধারণ মানুষ নিহত হয় শুধুমাত্র তার উচ্চাভিলাষের কারণে।প্রায় ৬২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়।ইরাকের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।অবশেষে জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় ১৯৮৮ সালের আগস্টে যুদ্ধবিরতির মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ এ যুদ্ধের এর অবসান হয়।
কুয়েত আক্রমণঃ
মধ্যপ্রাচ্যে ইরাকের বিভিন্ন আগ্রাসন ও তেলের দাম বাড়ানোর জন্য কুয়েতের জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা দুই দেশের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি করে। সাদ্দাম তখন আক্রমণ চালিয়ে কুয়েতই দখল করে বসেন এবং দাবি করেন যে ঐতিহাসিকভাবে এটি ইরাকের একটি অংশ ছিল। ১৯৯০ সালের ২রা আগস্ট কুয়েতে হামলা করে ইরাকি সৈন্যরা মাত্র ১৩ ঘণ্টার মধ্যে দেশটির সমস্ত অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
বেশিরভাগ মুসলিম রাষ্ট্র তার এ আক্রমণের নিন্দা করে ও প্রায় সবাই তার বিরুদ্ধ অবস্থানে পরিণত হয়।আরব সরকারগুলো তখন সাদ্দামকে রোখার জন্য মার্কিন নেতৃত্বে সাদ্দামের বিরুদ্ধে একজোট হতে থাকে।
ফলশ্রুতিতে, ১৯৯০ সালের আগস্টে জাতিসংঘ নিরাপত্তাপরিষদ একটি প্রস্তাব পাস করে। ওই প্রস্তাবে কুয়েতকে ইরাকের দখলমুক্ত করার জন্য বল প্রয়োগের আশ্রয় নেয়ার কথা বলা হয়।
১৯৯১ সালের ১৭ ই জানুয়ারি ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক জোট ইরাক ও কুয়েতে বিমান হামলা শুরু করে। কুয়েত মুক্ত করার ওই অভিযানের নাম দেয়া হয়েছিল ‘ডেজার্ট স্টর্ম বা মরুভূমির ঝড়’। বিমান হামলায় ব্যবহার করা হয় দুই হাজার ৯০০টি জঙ্গি বিমান। ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ইরাকি লক্ষ্যবস্তুগুলোতে হামলা চালাতে ১২ হাজার উড্ডয়ন চালায় এইসব জঙ্গি বিমান।
টানা ৩৮ দিন ধরে বিমান হামলা চালানোর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের নির্দেশে ১৯৯১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি স্থল অভিযান শুরু করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোট। কুয়েত থেকে ইরাকি সেনা তাড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত এ অভিযানের নাম দেয়া হয় মরুভূমির তরবারি বা “ডেজার্ট সোর্ড”। মাত্র চার দিনেই কুয়েতকে ইরাকি সেনাদের হাত থেকে মুক্ত করে বহুজাতিক বাহিনী। অবশেষে,ইরাক ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সমস্ত প্রস্তাবগুলো মেনে নিয়ে যুদ্ধ-বিরতিতে সম্মত হয়।
আগ্রসনের ফলাফল,রাজনৈতিক অস্থিরতা
এসব আগ্রাসন গোটা মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করে ও উপসাগরীয় সমস্ত অঞ্চলকে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবোধ হতে উৎসাহিত করে।মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো আমেরিকান নেতৃত্বে সাদ্দামকে হটানোর পরিকল্পনায় সমর্থন যোগায়।
উপসাগরীয় যুদ্ধ ইরাকের অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক অবনতি ঘটায় এবং প্রবল রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকটের সৃষ্টি করে।চারদিকে জাতিগত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ইরাকে শিয়া বনাম সুন্নি এবং আরব বনাম কুর্দি বিদ্রোহ সাদ্দামের এসব আগ্রাসনেরই ফসল। এসব বিদ্রোহ ইউএস দ্বারা চালিত হয়েছিল, যার ফলে একসময় বড় বিদ্রোহ দানা বাঁধে,শুরু হয় তার বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন।
সাদ্দামের পতনঃ
২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ার আক্রমণের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে যে সাদ্দাম হোসেন ও আল-কায়দা যৌথভাবে এতে জড়িত ছিল। ফলস্বরূপ, বুশ প্রশাসন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করে এবং ২০০৩ সালে মার্কিন সৈন্যরা ইরাকে আক্রমণ করে।
ইরাক আক্রমণ করার জন্য তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ ও কোয়ালিশন বাহিনী যে কারণ দেখিয়েছিল তা হল: ইরাক ১৯৯১ সালের চুক্তি অমান্য করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ করছে এবং তাদের কাছে এ ধরনের অস্ত্রের মজুদও আছে।তখন সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছিল, ইরাক যুক্তরাষ্ট্র, এর জনগণ এবং মিত্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য বড় ধরনের হুমকি। যদিও পরবর্তীতে আগ্রাসনের পরে পরিদর্শকরা ইরাকে গিয়ে কোন ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজে পায়নি। সাদ্দাম হোসেন আল-কায়েদাকে সহযোগিতা করছেন, এর পক্ষেও কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
২৩শে মার্চ ২০০৩ তারিখে বিচ্ছিন্ন হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশির ভাগ ইরাক দখল করে তাকে গ্রেপ্তারের আদেশ দেয়।তিনি ভূগর্ভস্থ হন। মার্কিন সেনা অভিযানে ধরা পড়ার পর ২০০৪ সালের ৫ নভেম্বর তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অবশেষে ৩০ শে ডিসেম্বর ২০০৬ সালে ঈদ উল-আযহার দিন তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
তথ্যসূত্রঃ
১.national Geography
২.BBC
buy cheap generic rybelsus – purchase glucovance pill buy desmopressin no prescription
terbinafine 250mg generic – buy cheap generic lamisil order griseofulvin sale