রোমেলু লুকাকু, নামটা এখন এতটাই পরিচিত যে, তাকে চেনে না এমন ফুটবল প্রেমী এই পৃথিবীতে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তিনি নিজেকে চিনিয়েছেন তার অসাধারণ ফুটবল প্রতিভার মাধ্যমে। তার এই ফুটবল প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে আছে পুরো ফুটবল বিশ্ব! আর এই প্রতিভা হঠাৎ করে অর্জন করতে পারেননি। অর্জন করেছেন অসম্ভব পরিশ্রম আর ধৈর্যের মাধ্যমে। ঠিক যেমন একজন অভিনেতা তার অভিনয় শৈলী দেখিয়ে থাকেন একটা তিন ঘণ্টার সিনেমায়। আর দর্শক চিৎকার করে বলে ওঠে ‘আরে বাহ, চমৎকার অভিনয়’! কিন্তু এই তিন ঘণ্টার চমৎকার অভিনয় করতে রিহার্সাল দিতে হয়েছে হাজারো ঘণ্টা! আর এটা শুধু সেই অভিনেতাই জানেন। মানুষের সফলতার পেছনে থাকে এক হৃদয়বিদারক কষ্টের গল্প। তেমনি লুকাকুও দেখেছেন তার মায়ের কষ্ট, দেখেছেন দুধের সাথে বেশি করে পানি মেশানো, খেয়েছেন ধার করে কেনা সস্তা খাবার, থেকেছেন তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় বিদ্যুৎ বিহীন, পাননি গোসল করার জন্য পর্যাপ্ত পানি, দেখেছেন অসহায় মায়ের চোখ থেকে টপ টপ করে পানি ঝরতে। আর তাই একদিন তিনি তার মা কে কথা দিয়েছিলেন ‘মা, আমাদের কষ্ট আর থাকবে না’ দেখেনিয়ো আমি ঘোচাব তোমার এই কষ্ট’।

Source: LifeBogger
দি প্লেয়ারস ট্রিবিউন কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন।
‘আমি সেই সময়টা খুব ভালোভাবে মনে করতে পারি, একদিন আমি স্কুলের টিফিনের বিরতিতে খাবার খেতে বাড়ি এসেছিলাম। মা আমার জন্য খাবার তৈরি করছিলেন। আর আমাদের খাবারের মেনু সবসময় একই জিনিশ থাকত রুটি আর দুধ । কিন্তু আমার কোনও অভিযোগ ছিল না! কারণ আমি বুঝতে পারতাম যে, আমাদের এর বেশি সামর্থ্য নেই!
সেদিন টিফিনের একটু আগেই বাড়িতে এসে সরাসরি কিচেনের দিকে গেলাম এবং দেখতে পেলাম আমার মা ফ্রিজ থেকে দুধের কৌটা বেরকরে কি যেন মেশাচ্ছেন, আর একটু কাছে গিয়ে দেখলাম দুধের সাথে পানি মেশাচ্ছেন! আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম! একটু পরেই বুঝতে পারলাম আসল কারণ। কারণটা ছিল, যেন আমরা একটু বেশি খেতে পারি। কারণ পুরো সপ্তাহের দুধ কেনার মত টাকা আমাদের ছিলনা। তখন বুঝতে পেরেছিলাম আমরা শুধু গরিব ছিলাম না আমরা ছিলাম নিঃস্ব, পুরোপুরি নিঃস্ব।

আবার একদিন রাতে বাড়ি ফিরে দেখলাম আমাদের বাড়ির লাইট গুলো অফ।জানতে পারলাম আমাদের ইলেক্ট্রিসিটি কেটে দেওয়া হয়েছে। এভাবে টানা তিন সপ্তাহ আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিলনা। আমি বাড়ি ফিরে গোসল করার জন্য পানি চাইলাম ইলেক্ট্রিসিটি না থাকায় আমার মা কেতলিতে করে ষ্টোভ জ্বালিয়ে পানি গরম করে দিলেন, আমি চায়ের কাপে পানি নিয়ে গোসল করলাম।
লুকাকু বলেন
‘তখন আমি কোন কথা বলতাম না চুপচাপ কষ্টগুলোকে মেনে নিতাম আর মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করতাম। সেদিন আমি শপথ করেছিলাম ঠিক যেভাবে মানুষ হাত তুলে শপথ করে। আমি জানতাম আমার কি করার ছিল আর কি করতে যাচ্ছিলাম’।
তিনি আরও বলেন
‘মানুষ বলে ভালো ফুটবল খেলার জন্য প্রয়োজন ভালো মানুষিক সামর্থ্য। তাহলে আমি বলব আমার রয়েছে এক শক্তিশালী মানুষিক সামর্থ্য। কারণ আমি এবং আমার মা অন্ধকারে থেকেও সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতাম আর বিশ্বাস করতাম খারাপ সময় কেটে যাবেই, সেই সময় কেটে গেছে এখনো যাচ্ছে’
একদিন আমার মা-কে কাঁদতে দেখে বলেছিলাম ‘মা আমি কথা দিচ্ছি তোমার এই দুঃখ আর থাকবে না’! দেখেনিও। আমি এন্ডারলেচট এর হয়ে খেলতে যাচ্ছি।

Source: Telegrafi
আমার বয়স তখন ছয়
একদিন আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘ বাবা তুমি যখন ফুটবল শুরু করেছিলে তখন তোমার বয়স কত ছিল?
বাবা উত্তরে বলেছিল ১৬ বছর বয়সে।
আমি বললাম তারপর-
বাবা বলেছিলও সেটা চলে গেছে, এখন তোমার সম্পর্কে বল
আমি তখন বলেছিলাম।
‘ আমি প্রতিটি খেলাকে ফাইনাল খেলা মনে করে খেলি, যখন আমি পার্কে খেলতাম তখনও মনে করতাম এটাই ফাইনাল, যখন আমি স্কুলের ব্রেকে খেলতাম তখনো মনে করতাম ফাইনাল। আমি ভাবতাম আমার জীবনের প্রতিটি ম্যাচই ফাইনাল ম্যাচ। আমি যখন বলে কিক মারতাম তখন ভাবতাম এটা একটা কান্নার পানি দিয়ে মোড়ানো বল, আর আমি অনেক জোড়ে কিক দিয়ে উড়িয়ে দিতাম সেই কান্নার জল।

আমি সবসময় ভাবতাম আমি একদিন বেলজিয়ামের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হব। আমি সবসময় অনেক রাগান্বিত হয়ে খেলতাম কারণ তখন ভেসে উঠত আমার কষ্টে দিন গুলো।
আমার মনে পড়ে।
আমার বয়স তখন ১২। সেই সময়ে আমি ৩৪ ম্যাচে ৭৬ গোল করেছিলাম! আর প্রতিটি ম্যাচ খেলেছিলাম আমার বাবার বুট পড়ে।
একদিন আমার নানাকে ফোন করে আমার এই সু-সংবাদ জানালাম। আমার জীবনে সে ছিল একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তিনি সবসময় আমার ফুটবল খেলার খবর জানতে চাইতেন। আর আমাকে প্রেরণা যোগাতেন। কিন্তু সেদিন তিনি তেমন গুরুত্ব দিলেন না। তিনি আমাকে বললেন;
রোম তুমি আমার একটা কথা রাখবে?
– কি কথা?
– আমার মেয়েকে দেখে রাখবে।
– মায়ের কথা বলছ?
– হ্যাঁ।
– অবশ্যই।মায়ের খেয়াল কেন রাখব না!
– না আমাকে কথা দাও
– ওকে ঠিক আছে, কথা দিলাম।
অদ্ভুত ভাবে তার ঠিক ৫ দিন পরে আমার নানা মারা গেলেন।
এই মৃত্যু আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল।
২৪ মে ২০০৯
প্লে-অফ ফাইনাল
এন্ডারলেচট বনাম স্ট্যান্ডার্ড লাইচ

সেই দিনটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে উত্তেজনার দিন। সেদিন আমাকে আমার কোচ সাইড বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছিলেন। তখন আমার খুব রাগ হচ্ছিল আর তাই সেদিন কোচের সাথে একটা বাজি ধরে ছিলাম। বলেছিলাম আপনি যদি আমাকে খেলার সুযোগ দেন তাহলে আগামী ডিসেম্বরের ভিতর আমি ২৫ গোল করে দেখাবো। সে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলো , কিন্তু আমার সিরিয়াসনেস দেখে সে বলেছিল তাহলে আমাকে একটা বাজি ধরতে হবে। তিনি বললেন ‘বাজিতে হেরে গেলে তুমি বেঞ্চে চলে যাবে । আমি বললাম আপনি হেরে গেলে খেলোয়াড়দের আসার বাস পরিষ্কার করে দেবেন।আর সেদিনই আমি এন্ডারলেচট এর সাথে প্রো-কন্ট্রাক করেছিলাম এটা ছিল আমার জন্মদিন।
এরপর ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি! আমি নভেম্বরের মাঝেই সেটা করে দেখিয়েছি। এবং কোচের সাথে ক্রিসমাস উপভোগ করেছি, ব্রো।

Source: Royal Blue Mersey
সে বছর এন্ডারলেচট আর স্ট্যান্ডার্ড লাইচ এর মধ্যকার ম্যাচটি ড্র হওয়ার আবারো দুই লেগ খেলার মাধ্যমে ফলাফল নিশ্চিত করতে হবে। প্রথম ম্যাচটি আমি টিভিতে দেখছিলাম। হঠাৎ আমার কোচ ফোন করে দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে পরদিন খেলার মাঠে উপস্থিত হতে বললেন। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না , কি ঘটতে যাচ্ছে! আমি চলে গেলাম এবং মাঠে ঢুকতেই সমস্ত ক্যামেরা আমার দিকে তাক করা হল। আমাকে টিভিতে দেখে সবাই ফোন করে যাচ্ছিলো। সেদিন ৩ মিনিটে ২৩টি টেক্সট এসেছিলো আর আমি একটির রিপ্লাই দিয়েছিলাম ‘কি ঘটতে যাচ্ছে আমি জানিনা’। ৬৩ মিনিটে আমাকে নামানো হল। সেই ম্যাচটা আমরা হেরেছিলাম তবে আমি আমার কথা রেখেছিলাম। যে কথা নানা এবং মা কে দিয়েছিলাম। ১৬ বছর ১১ দিনের মাঝেই অনূর্ধ্ব -১৯ দলের সাথে খেলেছিলাম।
পরবর্তী সিজন শেষ করেছিলাম ‘আফ্রিকান প্লেয়ার অব দি ইয়ার’ এর দ্বিতীয় হয়ে।

আমার মনে পড়ে ২০০২ সালের কথা তখন আমি টাকার অভাবে খেলা দেখতে পারতাম না। আমার ফুটবল খেলার বুটে থাকত বড় বড় ফুটো। আর মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে বিশ্বকাপে খেলেছিলাম এবং আজ আমি বেলজিয়ামের হয়ে ২ টি বিশ্বকাপ খেলে চলেছি। তখন আমি তাদের খেলা দেখতে না পারলেও এখন আমার খেলা দেখে সারা বিশ্ব।
আর এটাই রোমেলু লুকাকু।