প্রায় ৩ লক্ষ ৪৭ হাজার ১৯০ বর্গ কিলোমিটার স্থান নিয়ে গঠিত প্রদেশটির রাজধানী কুয়েটাকে বলা হয় পাকিস্তানের ‘ফলের বাগান’ আর এতে উৎপন্ন হওয়া শুকনো ফল সারা বিশ্বজুড়ে প্রসিদ্ধ। কথা হচ্ছে বেলুচিস্তান প্রদেশ সম্পর্কে যার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তান, দক্ষিণ-পশ্চিম আফগানিস্তান, দক্ষিণ-পূর্ব ইরান এবং সর্ব দক্ষিণে আরব সাগর। প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার এই প্রদেশটি পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও আজ স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও তরুণদের সম্মুখভাগের নেতৃত্বে বিদ্রোহে ফুঁসে উঠেছে পাকিস্তান হতে আলাদা হয়ে নিজের একটি স্বতন্ত্র পরিচয়ের আশায়। ঠিক যেমনটা একসময়ের পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) ফুঁসে উঠেছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এবং শেষমেশ বাংলার দামাল সন্তানদের আত্মত্যাগে একটি ‘বাংলাদেশ’ জন্ম নেয় পৃথিবীর মানচিত্রে।
বেলুচিস্তানের ইতিহাসঃ
বেলুচিস্তানের উৎপত্তির ইতিহাস ঘাটতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে যেইসময়ে ম্যাসেডোনিয়ার রাজা মহাবীর আলেকজান্ডার প্রদেশটি জয় করেন। এর পরবর্তী সময়কালে প্রদেশটির শাসনভার বেশ কয়েকবার পরিবর্তন হয়। কখনো পারস্য আবার কখনো ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন শাসকদের অধীনে ছিলো প্রদেশটি। ৭ম শতকে আরব শাসকেরা বেলুচিস্তান দখল করে। ১৬৬৬ সালের দিকে আফগান শাসকদের অধীনে চলে যায় এবং গোড়াপত্তন হয় বেলুচিস্তানের। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ৪টি করদ প্রদেশের মধ্যে তিনটি পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হলেও ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট বেলুচিস্তান তথা কালাট প্রদেশের শাসক মির আহমেদ ইয়ার খান (খান সাহেব) চতুর্থ অংশ কালাট প্রদেশ নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে। এই কালাট প্রদেশই হলো আজকের বেলুচিস্তান। বহু সমঝোতার পরেও কোন গতি না হওয়াতে ১৯৪৮ সালের ১ এপ্রিল পাকিস্তান কালাটকে নিজেদের অধীনস্ত হিসেবে ঘোষণা করে সামরিক অভিযান চালায়।

এরপর হতে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে বেলুচিস্তান আজও স্বাধীনতার আশায় রয়েছে। পাকিস্তানের জ্বালানী সম্পদের সমৃদ্ধ মজুদ ক্ষেত্র, পারমাণবিক অস্ত্রের বড় মজুদ এবং পরীক্ষাগার হিসেবে বেলুচিস্তান খ্যাত। তাছাড়া চীনের অর্থায়নে এখানে নির্মিত হয়েছে গোয়াদর বন্দর যা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বেলুচিস্তানের মান। এই বন্দর দিয়ে বাণিজ্য করিডরের মাধ্যমে বাণিজ্যপণ্য যাবে সরাসরি চীনে। পুরো আরব সাগরে চীনের আধিপত্য নিশ্চিত করতে এই বন্দরের গুরত্ব ছিলো অপরিসীম। এরই প্রেক্ষিতে ২০৩০ সালের মধ্যে সেখানে ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষনাও দিয়েছে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এত বড় বিনিয়োগ ইতিপূর্বে কোন রাষ্ট্র করেনি। এই বিনিয়োগের ফলে বেলুচিস্তানে গড়ে উঠবে বিদ্যুৎকেন্দ্র, পাইপলাইন সংযুক্তকরণসহ বহু অবকাঠামোগত কাজকর্ম।

বিদ্রোহের শুরুঃ
বেলুচ জাতি তীব্র অহংবোধ, স্বাধীনচেতা মনোভাব এবং অদম্য সাহসিকতার জন্য বহু আগে হতেই বহুল পরিচিত যার কারণে বহুবার অধীনস্ত হলেও কেউই পুরোপুরি বেলুচিস্তানকে শাসন করতে পারেনি। ব্রিটিশ শাসনের প্রায় ১০০ বছর পেরোনোর পর নতি স্বীকার করে ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে। তাদের মধ্যে ‘কালাট চুক্তি’ হয়।
তবে দ্বিদশক শতাব্দীর শুরু হতে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবীতে সোচ্চার হয় তাঁরা। এরইপ্রেক্ষিতে ১৯৩১ সালে গঠিত হয় ‘আঞ্জুমান ই ইত্তেহাদ ই বেলুচিস্থান’ নামের স্বাধীনতাকামী জিহাদী সংগঠন যার পরবর্তী নাম হয় ‘কালাট স্টেট ন্যাশনাল পার্টি”। তবে পরিতাপের বিষয় হলো সংগঠনটি নিষিদ্ধ ঘোষনা করে তৎকালীন পাক সরকার।
১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান স্বাধীন হয় তখন বেলুচিস্তান সম্পর্কে ধুম্রজাল থেকেই যায়। স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মাথায় সংগঠিত হয় প্রথম বিদ্রোহ যখন ১৯৪৮ সালে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে খান সাহেবকে গ্রেফতার করে পাক সেনা। তাঁর অবর্তমানে ভাই প্রিন্স আবদুল করিম দায়িত্ব গ্রহণ করে আন্দোলন সচল রাখে এবং গঠন করে ‘বেলুচ ন্যাশনাল লিবারেশন কমিটি’। ১৯৫০ সালে গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত তিনি সংগ্রাম চালিয়ে যান। তিনি গ্রেফতার হওয়ার পরেও ২২ বছর বেঁচে ছিলেন তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের ফলস্বরূপ প্রায় ১৬ বছর কাটাতে হয় কারাগারের অভ্যন্তরে।

বেলুচিস্তানের সমস্যা প্রেক্ষিতে স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ চুক্তিপত্রের মাধ্যমে বেলুচিস্তান আত্মনিয়ন্ত্রণের ঘোষনা দেন। তার ভাষ্যমতে বেলুচিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই থাকবে। পাকিস্তান বা ভারতের সাথে যুক্ত হবে না। সমতার ভিত্তিতে একটি চুক্তি করার কথা থাকলেও সেই চুক্তি কখনোই করা হয়নি। বেলুচিস্তানকে গ্রাস করার নানা ধরনের ফন্দিফিকির করতে থাকে স্থানীয় সরকার। তবে বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হয় নাই বিদ্রোহের শেকল। সরকার চুক্তিনামা ভঙ্গ করলে আবার শুরু হয় বিদ্রোহ। বিদ্রোহ চরম আকার ধারন করে ষাট ও সত্তর দশকের দিকে। ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে বাংলাদেশ নিজেদের ভিত্তি পাক্কা করার পর হতে বেলুচিস্তানও উত্তাল হয়ে উঠে নিজেদের স্বাধীনতার আশায়।
পাক সরকার এবং সেনাবাহিনীর অন্যতম চিন্তার বিষয় হয়ে দাড়ায় চলমান আন্দোলন এবং এর ফলে সৃষ্ট অস্থিরতা। একুশ শতকের দিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর জেনারেল পারভেজ মোশাররফ শক্ত হাতে আন্দোলন দমনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ২০০৬ সালে অন্ধের যষ্ঠী বেলুচ নেতা নওয়াব আকবর খান বুগতি নির্মমভাবে নিহত হন পাকসেনাদের হাতে। তবে দমে যায়নি বেলুচ জাতি। তাঁরা ক্ষোভে ফেঁপে উঠে ইসলামাবাদের বিপক্ষে এবং স্বাধীনতার দাবীতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করে। ভাগ্য বাংলাদেশের মত সহায় হয় নি বেলুচ জাতিদের। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি শেষমেশ। এই আন্দোলন আজও সক্রিয় রয়েছে। মৃত দেহের সংখ্যা বাড়তে থাকে অগণিতহারে। দেশটির মানবাধিকার বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে উঠে আসে, ২০১১ সালের পর হতে আজ অবধি বেলুচিস্তানে প্রায় ৯৫০ জনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। জরিপে আরো উঠে আসে, প্রতিটি ঘর হতে প্রায় ১ জন করে সদস্য গুম হয়েছে।

মৃতদেহগুলো প্রাপ্তির স্থান কোয়েটা, কালাট, খুজদার ও মাকরান অঞ্চলে। জরিপে উল্লেখ করা হয়, আন্দোলনকারীদের বিনা বিচারে তুলে নিয়ে হত্যা করে পাক সরকার কর্তৃক নিয়োজিত সেনাবাহিনী। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, স্থানীয় সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপদজনক স্থান হল বেলুচিস্তান। বেলুচিস্তানের সমস্যা হলো বিদ্রোহ, হামলা, রাজনীতিবীদ ও সরকার পক্ষের দূর্নীতি, যার করাঘাতে জর্জরিত এবং মৃতপ্রায় প্রদেশটির পক্ষে সোচ্চার একমাত্র আইনজীবীরা রয়েছে বন্দুকের নলের সামনে মাথা ঠেকিয়ে রাখার মত অবস্থায়। চলতি মাসের শুরুর দিকে বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটার একটি হাসপাতালে মূলত আইনজীবীদের লক্ষ্য করে চালানো নজিরবিহীন হামলায় নিহত হয়েছে প্রায় ৭২ জন।
পূর্বেই বলা হয়েছে চীন সরকার ভবিষ্যতে বেলুচিস্তানে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা নাখোশ চীনের উপর। বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রশ্ন তুলে ভারত সরকারও বেলুচিস্তান নিয়ে ঘাটতে শুরু করে। সাম্প্রতিক সময়ে বেলুচিস্তানের দুই নেতা ওয়াহিদ বালুচ এবং মুনির মেহুল ফ্রান্স হতে ভারত সফর করে এবং জানা যায় তারা জানিয়েছে কয়েক যুগ ধরে পাকিস্তান কর্তৃক জোর জবরদখল করে অন্যায় ভাবে স্বাধীনতা খর্ব করা এবং এই প্রেক্ষিতে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে ভারতের সাহায্য কামনা করেছে। তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায় কাশ্মির ইস্যুতে যখন ভারত-পাকিস্তানে যুদ্ধ প্রায় আসন্ন সে সময়ে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার ইস্যুকে নতুন করে সবার সামনে তুলে ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
যতোবারই স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়েছে ঠিক ততোবারই পাকিস্তানি সেনারা বেলুচদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এ পর্যন্ত প্রায় দশবার পাকিস্তানী শোষকদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে বেলুচ জাতি। বেলুচিস্তান ইস্যুটি বর্তমান সময়ে শুধুমাত্র পাকিস্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ধরতে গেলে এর সাথে জড়িত রয়েছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মত বড় দেশ। কোন ধরণের সমাধানের দিকে না এগোলে বরঞ্চ সমস্যাটি অদূর ভবিষ্যতে প্রকট আকার ধারণ করবে।