সার্বদের বিরুদ্ধে ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ফুটবল মাঠে সার্বিয়া-ক্রোয়েশিয়ার উত্তেজনা

0

ক্রোয়েশিয়াকে বিশ্বের দরবারে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আর কোনো প্রয়োজন বোধহয় আছে বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যে তারা প্রথমবারের মতো আগামীকাল ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনাল খেলতে নামছে। ক্রোয়েশিয়া পৃথিবীর নবীন রাষ্ট্রগুলোর ভিতর অন্যতম যার জন্মই হয়েছে ১৯৯১ সালে। ২৫ জুন ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও এরপর তাদের সার্বদের বিপক্ষে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতা যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং ১৯৯৫ সালে ক্রোয়েশিয়ার বিজয়ের মধ্য দিয়ে ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। চলুন ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে আজ জেনে নেওয়া যাক।

পটভূমিঃ
১৯৯১ সালের ৩১ মার্চ ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলেও এর পটভূমি ছিল অনেক গভীর। ১১০২ সালের দিকে ক্রোয়েশিয়া যুক্ত হয় হাঙ্গেরির সাথে এবং নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে১৫২৭ সালে ক্রোয়েশিয়ার জায়গা হয় হাপসবুর্গ রাজ্যে যেখানে ছিল অস্ট্রিয়ান-হাঙ্গেরিয়ান ক্ষমতার দ্বন্দ ও সাথে রয়েছে বাইরের রাজ্যের (অটোমান) ক্রমাগত চাপ। ১৯১৮ সালে বলকান অঞ্চলের কয়েকটি দেশ নিয়ে গঠন করা হয় গ্রেটার সার্বিয়া যার নাম দেওয়া হয় যুগোস্লাভিয়া। এই যুগোস্লাভিয়া ছিল নানা জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে গঠিত একটা রাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুগোস্লাভিয়া বিলুপ্ত হতে ধরলেনও জোসেফ টিটোর চেষ্টায় যুগোস্লাভিয়া পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়ায়।

সাবেক যুগোস্লাভিয়ার মানচিত্র Source:images.nationmaster.com

যুগোস্লাভিয়া বলকান অঞ্চলের ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া, বসনিয়া এন্ড হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া এবং মেসিডোনিয়াকে নিয়ে গঠিত হলেও এই দেশটিতে সুবিধাজনক আসনে থাকত সার্বিয়া এবং সার্ব জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা। অন্যদিকে নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী যেমন ক্রোয়েশিয়ার ক্রোটরা, স্লোভেনিয়ান জনগোষ্ঠী আর বসনিয়ার মুসলিমরা। ১৯৮০ সালে জোসেফ টিটোর মৃত্যুর পর তাই ঐ অঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলো জাতিসত্তার ভিত্তিতে স্বাধীনতার ডাক দেয়।

স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুঃ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুরু হওয়া ঠাণ্ডা যুদ্ধে যুগোস্লাভিয়া ছিল সমাজতান্ত্রিক আদর্শের রাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম বন্ধু রাষ্ট্র। ঠাণ্ডা যুদ্ধে সোভিয়েত এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো অর্থনীতি ঠিক রাখতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।তাই অধিকাংশ ক্রোট জাতিগোষ্ঠীর দেশ ক্রোয়েশিয়ার অধিকাংশ মানুষ একটি স্বাধীন ক্রোয়েশিয়া রাষ্ট্র চাচ্ছিল। কিন্তু ক্রোয়েশিয়াতে বসবাসরত সার্ব জনগোষ্ঠীর লোকেরা এর বিরোধিতা করে আর অন্যদিকে সার্বিয়াও চাচ্ছিল ক্রোয়েশিয়া যেন সার্বিয়ার একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবেই থাকে। শুরু হয়ে ক্রোয়েশিয়া এবং সার্বদের মধ্যে একটা যুদ্ধ যা ছিল ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ক্রোয়েশিয়ানরা একে বলে “হোমল্যান্ড যুদ্ধ”।এমন অবস্থাতেই ক্রোয়েশিয়া স্বাধীনতার ঘোষনা দেয় ১৯৯১ সালের ২৫ জুন।

১৯৯১ সালে সিডনিতে ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন Source:inavukic.com

১৯৯১ সালের ৮ অক্টোবর যুগোস্লাভিয়ার সাথে ব্রিওনি চুক্তির মাধ্যমে ক্রোয়েশিয়া সার্বদের সাথে সীমান্তের সমস্যাগুলো সমাধান করে। তবে এরপর ক্রোয়েশিয়াতে বসবাসরত সার্বরা ক্রোয়েশিয়ার এক-চতুর্থাংশ নিয়ে রিপাবলিক অব সার্বিয়ান ক্রুজিনা (আরএসকে) গঠন করে এবং ক্রোয়েশিয়া এর বিরোধিতা করে এবং পুনরায় আবার সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে একটা যুদ্ধবিরতি হয় এবং ক্রোয়েশিয়াকে আন্তর্জাতিক মহল স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সার্বদের গঠন করা রাষ্ট্রে জাতিসংঘ থেকে নিরাপত্তা বাহিনী প্রেরণ করা হয়৷ যুদ্ধবিরতি হলেও চার বছর সেই অঞ্চলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি চলতে থাকে।

ক্রোয়েশিয়ার চূড়ান্ত বিজয়ঃ

১৯৯৫ সালে ক্রোয়েশিয়া সার্বদের বিরুদ্ধে দুইটা বড় অপারেশন চালায় যা অপারেশন ফ্ল্যাশ এবং অপারেশন স্টর্ম নামে পরিচিত এবং এই দুই অপারেশনের কারণে ক্রোয়েশিয়ানদের চূড়ান্ত বিজয় ঘটে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্রোয়েশিয়া Source: inavukic.com

পরে ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘ বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলো পুনরায় ক্রোয়েশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে। ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্রোয়েশিয়ার মূল নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঞ্জো টুডম্যান। সাড়ে চার বছরের অধিক স্থায়ী ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে পনের হাজারের অধিক ক্রোয়েশিয়ান নিহত হয় এবং ২ লক্ষ ২০ হাজার ক্রোয়েশিয়ান বাস্তুহারা হয়।

ফ্রাঞ্জো টুডম্যান Source: www.cbsnews.com

ফুটবল মাঠে উত্তেজনাঃ

অনেকে বলে খেলায় রাজনীতি মিশাতে হয় না৷ কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার সাথে সাবেক যুগোস্লাভিয়া এবং সার্বিয়ার বিরোধ মাঝেমাঝে ফুটবল খেলার মাঠেও প্রতিফলিত হয়েছে। যুগোস্লাভিয়ার লিগ ম্যাচে ১৩ মে ১৯৯০ সালে মুখোমুখি হয় ক্রোয়াশিয়ার ডায়নামো জাগরেব ও অখন্ড যুগোস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেদের ক্লাব রেড স্টার। সেদিন রেড স্টারের সবচেয়ে একনিষ্ঠ ও উগ্র সমর্থক গোষ্ঠী দেলিয়ে (Delije) প্রায় ৩০০০ সদস্য নিয়ে আরকানের নেতৃত্বে পা রাখে জাগরেবের স্টেডিয়ামে। বলে রাখা ভালো, আরকান বেলগ্রেদের একজন গ্যাংস্টার ছিল যে পরবর্তীতে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ক্রোয়েশিয়া ও বসনিয়ার যুদ্ধে আরকানের নিজস্ব বাহিনী দ্য টাইগার ব্যপক ধ্বংসজজ্ঞ চালায়। হেগের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক ট্রাইবুন্যালে আরকানের বিচারও হয়। দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির জন্য সেদিন খেলা শুরু হওয়ার মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়।

১৯৯০ সালের ফুটবল মাচে ক্রোট আর সার্ব দর্শকদের মারামারি Source: www.ultras-tifo.net

সেদিন রেড স্টারের বেলিয়ারা স্টেডিয়ামের চেয়ার ভেঙ্গে ছুড়ে মারতে থাকে জাগরেব সমর্থকদের দিকে, ভেঙ্গে ফেলে দুই দলের সমর্থকদের আলাদা করে রাখা বেড়াটিও এবং পাল্টা আক্রমণ করে জাগরেবের সমর্থকেরা। সেদিন রেড স্টারের খেলোয়াড়েরা মাঠ ছাড়লেও কিছু জাগরেব খেলোয়াড় জাতীয়তাবাদের টানে মাঠে থেকে গিয়েছিল এবং এদের মধ্যে একজন ছিলেন বোবান। দাঙ্গার একসময় বোবান দেখলেন যে পুলিশ এক জাগরেব সমর্থককে রুলার দিয়ে মারছে। তখনই দৌড়ে গিয়ে উড়ে কষে এক লাত্থি মারেন বোবান।পুলিশকে ধরাশায়ী করে ঐ সমর্থককে পালিয়ে যেতে তিনি সাহায্য করেন।

সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সার্বিয়ানদের ইংল্যান্ডকে সাপোর্ট Source:www.dailystar.co.uk

এই বিশেকাপেও সার্বিয়া আর ক্রোয়েশিয়ার ভিতর উত্তেজনা প্রতিফলিত হয়েছে। রাশিয়া বিশ্বকাপ শুরুর আগে সার্বিয়ার রাজনীতি বেলগ্রেডে ফুটবল স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল মিনি বিশ্বকাপ। সেখানে অংশগ্রহণকারী ৩১ টি দল বিশ্বকাপের জার্সি পরে মাঠে নেমেছিল। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করা দলটির জার্সি না দিয়ে তাদের পরিয়ে দেয়া হয়েছিল শুধুই সাদা-কালো টি-শার্ট যেন কোনো সার্বিয়ানদের অনুভূতিতে আঘাত না লাগে৷ তাই ধরেই নেওয়া যায়, আগামীকাল অন্য সব প্রতিবেশীর সাপোর্ট পেলেও ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষেই গলা ফাটাবে তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সার্বিয়া।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More