“মানুষ কখনোই পরাজয় বরন করে না, প্রয়োজনে লড়াই করতে করতে ধ্বংস হয়ে যায়”– বিখ্যাত এই উক্তিটি বিংশ শতাব্দীর মার্কিন সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের, তার কালজয়ী উপন্যাস “দ্যা ওল্ড ম্যান এন্ড সী” তে হার না মানুষের চিত্র রূপায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন। কিন্তু সেই লেখকই কি না শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন!
পুরোটা জীবন জুড়েই ছিল রোমাঞ্চ আর রহস্যের খেলা। শিকার করার বড্ড নেশা ছিল, ছিল প্রিয় একটা শিকারি বন্দুক। সেই বন্দুক দিয়েই কিনা পরাজয় বরন করেছেন! বিশ্বাস করতে পারেনি কেউই, বিশ্বাস করে নি তার স্ত্রী মেরি হেমিংওয়ে। ১৯৫৪ সালে পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। ঝুলিতে রয়েছে পুলিৎজারের মত বিখ্যাত পুরস্কারও। অসুস্থতার কারণে যেতে পারেন নি নোবেল প্রাপ্তির অনুষ্ঠানে, তবে কি শারীরিক সমস্যাই তার মৃত্যুর কারণ ছিল! প্রেমে পড়েছেন বহুবার, প্রত্যাখ্যানও হয়েছেন অনেকবার।

source: edition.cnn.com
প্রাথমিক জীবন:
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর ইলিনয়ের, ওক পার্কে ১৮৯৯ সালের ২১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন পেশায় ডাক্তার আর মা সঙ্গীত শিল্পী। হেমিংওয়ে নামটি তার নানার নাম অনুসারে রাখা হয়। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি নামটি পছন্দ করতেন না। কারণ, “The importance of being Ernest” নাটকের প্রধান চরিত্র, আর্নেস্ট ছিল বোকা ও সাদা সিধে টাইপের। তিনি মায়ের অনুপ্রেরণাতে সেলো বাজানো শিখেন, যদিও পরবর্তীতে তা ধরে রাখতে পারেন নি। তিনি স্বীকার করেছেন যে, গান শিখার কারণেই “ফর হোম দি বেল টোলস” বইটি লিখতে সহজবোধ্য হয়েছিল। বাল্যকাল থেকেই তার মাছ ধরা, শিকার করা, ক্যাম্প করা রপ্ত করেছিলেন। যা তার পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করেছিল।

১৯১৩ সালে স্কুল জীবন শুরু হয় ওক পার্ক এন্ড রিভার ফরেস্ট হাই স্কুলে, অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন বিভিন্ন খেলাধুলায়। এখানে পড়ার সময়েই সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠেন। স্কুলে থাকতেই জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকতায়। যা পরবর্তীতে তার লেখক জীবনের ভীত গড়ে দিয়েছিল। ট্রাপেজি এন্ড টাবুলা ম্যাগাজিনে খেলাধুলা নিয়ে নিয়মিত লেখা শুরু করেন। স্কুল জীবন শেষে যুক্ত হন “দি ক্যানসাস সিটি স্টার” পত্রিকায়। লেখক জীবনে সাংবাদিকতার প্রভাব নিয়ে হেমিংওয়ে বলেছিলেন,
“On the Star you were forced to learn to write a simple declarative sentence. This is useful to anyone. Newspaper work will not harm a young writer and could help him if he gets out of it in time.”
সাহিত্য জীবনের সূচনা:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৮ সাল, আমেরিকা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হেমিংওয়ে সাংবাদিকতায় ব্যস্ত, হঠাৎ রেড ক্রসের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান ইতালির মিলানে। একজন এম্বুলেন্স চালক হিসেবে শুরু করলেন মানবতার সেবা। যুদ্ধরত অবস্থায়, ইতালির এক সৈন্য মারাত্মক ভাবে আহত হল, হেমিংওয়ে দ্রুত ছুটে গেলেন, তাকে এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু মর্টারের আঘাতে মারাত্মকভাবে আঘাত প্রাপ্ত হন হেমিংওয়ে। তার এই সাহসিকতার জন্য ইতালির সরকার তাকে “ইতালিয়ান সিলভার মেডেল অব ব্রেভারী” তে ভূষিত করে।

source: nytimes.com
ইতালির সেই স্মৃতি স্মরণ করে হেমিংওয়ে বলেছিল, “যখন বালক হিসেবে যুদ্ধে যাও তখন অমরত্ব লাভের জন্য একটা মোহ কাজ করে। অন্য যোদ্ধারা মারা যাবে, আমি মরবো না… এমন মনোভাব থাকে। কিন্তু যখনি প্রথম বারের মত মারাত্মকভাবে আহত হবে তখনই সেই মোহ কেটে যাবে এবং ভাবতে শুরু করবে, আমিও মরে যেতে পারি”।
আহত হয়ে যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিল হেমিংওয়ে তখন তার সেবায় নিয়োজিত ছিল রেড ক্রসের নার্স এগনেস ভন কোরস্কি। হেমিংওয়ে এগনেসের প্রেমে পড়ে যান, এবং তাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেন। দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন আমেরিকায় গিয়ে বিয়ে করবেন তারা। জানুয়ারিতে আমেরিকায় ফিরে গেলেন হেমিংওয়ে, অপেক্ষা করতে থাকেন এগনেসের আমেরিকায় পৌঁছার জন্য। হঠাৎ, একটি চিঠি এলো ইতালি থেকে; প্রেম প্রত্যাখ্যানের চিঠি পাঠিয়েছে এগনেস। ইতালির এক সরকারী কর্মকর্তার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে চিঠিতে জানিয়েছে এগনেস। মাত্র ২০ বছরে প্রেমে প্রত্যাখ্যান হয়ে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন হেমিংওয়ে।

source: www.jfklibrary.org
ইউরোপ জীবন :
সাংবাদিকতাকে পরিপূর্ণ পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেন। পাশাপাশি চালিয়ে যেতে থাকেন তার লেখালেখি। টরেন্টো স্টার নামক পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিলেন তিনি। ১৯২১ সালে তিনি এলিজাবেথ হ্যাডলি রিচার্ডসন কে বিয়ে করলেন। তাদের মধ্যে অল্প কিছু দিনের প্রেম ছিল তারপর সরাসরি বিয়ে। শুরু করলেন নতুন সংসার। স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন আগের মত। টরেন্টো পত্রিকা তাকে ফ্রান্সে প্রেরণ করে। হেমিংওয়ে প্যারিস শহরে স্থানান্তরিত হলেন। প্যারিস শহরেই জীবনের নানা রূপ দেখতে শুরু করেন হেমিংওয়ে। ১৯২৩ সালে প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয় তার প্রথম স্বরচিত বই Three Stories and Ten Poems। এই বছরই হেমিংওয়ে হ্যাডলি দম্পতির প্রথম সন্তান জন জন্মগ্রহণ করে। সন্তানকে দেখতে হেমিংওয়ে টরেন্টোতে চলে যান। এ সময় তিনি সংসার জীবন নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে সংসারের দায়িত্ব পালন করতে তিনি সাংবাদিকতা থেকে ফিরে আসেন। উপন্যাসের জগতে তাঁর প্রবেশ ঘটে In Our Time (১৯২৫) নামক ছোট গল্পের বই লিখে। প্যারিসে এসেই তার পরিচয় ঘটে স্কট ফিটজেরাল্ড, জেমস জয়েস, পাবলো পিকাসো, এজরা পাউন্ডের মতো বিখ্যাত লেখকদের সাথে। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয় তার অন্যতম বিখ্যাত উপন্যাস, “The Sun Also Rises”।

source: pinterest.com
হেমিংওয়ে আবারো প্রেমে পড়েন, এবার তার প্রেমিকা আমেরিকান সাংবাদিক পলিন পাইফার। ফাটল ধরে তার সংসারে, ১৯২৭ সালে তিনি ডিভোর্স দেন তার প্রথম স্ত্রী হ্যাডলি রিচার্ডসনকে। পলিন পাইফার, হেমিংওয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। বিবাহের পরবর্তী সময়ে তিনি লেখা শুরু করেন তার অন্যতম সাহিত্য কর্ম “ Men Without Women”।

source: en.wikipedia.org
সবচেয়ে করুন মুহূর্ত :
হেমিংওয়ের জীবনে সবচেয়ে করুন মুহূর্ত ছিল তার বাবার আত্মহত্যা। ১৯২৮ সালে তার বাবা ক্লারেন্স হেমিংওয়ে আত্মহত্যা করে। ডায়াবেটিস ও আর্থিক অনটন থেকে মুক্তি পেতে তিনি আত্ম হননের পথ বেছে নেন।
বাবার মৃত্যুর পর হেমিংওয়ে অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন শুরু করেন। তিনি প্রচুর পরিমাণে মদ্য পানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। ইতিমধ্যেই তিনি কয়েকবার প্লেন ক্রাশ ও সড়ক দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পান। তারপরও তিনি লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি লেখা শুরু করেন, তার সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস “এ ফেয়ার ওয়েল টু আর্মস”।
বেস্ট সেলার এই উপন্যাসটি ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয়, যা হেমিংওয়ের খ্যাতি বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে দেয়।
স্পেন ও কিউবার জীবন:
হেমিংওয়ে আবারও সাংবাদিকতা পেশায় ফিরে এলেন। ১৯৩৭ সালে তিনি স্পেনের গৃহ যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে তিনি স্পেন ভ্রমণ করেন। স্পেনে গিয়ে তিনি এক নারী সাংবাদিক মার্থা গেলহর্নের সাথে পরিচিত হয়। তিনি আবারো প্রেমে পড়েন। মার্থা তাকে লেখালেখিতে অনুপ্রেরণা যোগাত। মার্থা গেলহর্নের অনুপ্রেরণাতেই হেমিংওয়ে সিভিল ওয়ারের ভয়াবহতা নিয়ে লিখে ফেললেন তার বিখ্যাত উপন্যাস “ For Whom The Bell Tolls”। বিখ্যাত এই বইটির জন্য তিনি পুলিৎজার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। মার্থার সাথে অবৈধ প্রেম তাকে আবারো ডিভোর্সের দিকে নিয়ে যায়। পাইফারকে ডিভোর্স দিয়ে তিনি তৃতীয় বারের মত বিয়ে করেন মার্থা গেলহর্নকে।
সাল ১৯৪০, হেমিংওয়ে কিউবাতে ফিরে আসেন। এখানেই তিনি সমুদ্রের কাছাকাছি একটি বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। নিয়মিত মাছ শিকারে যেতেন। এই সময় তিনি জেলেদের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তার এই বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকেই লিখে ফেলেন কালজয়ী উপন্যাস “ The Old Man and the Sea”। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি দিয়েই তিনি পাঠক মনে চিরস্থায়ী আসন গড়ে নেন। তার এই বিখ্যাত উপন্যাসের জন্য তিনি একই সাথে পুলিৎজার (১৯৫৩) ও নোবেল পুরস্কার (১৯৫৪) লাভ করেন।

Source: en.wikipedia.org
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে, খবর সংগ্রহ করার জন্য হেমিংওয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে। এ সময় তার সাথে পরিচয় হয় টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক ম্যারি ওয়েলসের সাথে। আগের মতই প্রেমে পড়ে হেমিংওয়ে। দুই বছর প্রেম করার পর ১৯৪৫ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা। অন্যদিকে হেমিংওয়ে ডিভোর্স দেন মার্থা গেলহর্নকে। এটি ছিল তার চতুর্থ ও শেষ বিয়ে। কোন এক সাক্ষাতকারে তার একাধিক বিয়ে নিয়ে হেমিংওয়ে বলেছিলেন, “Funny how it should take one war to start a woman in your damn heart and another to finish her. Bad luck”।

source: pinterest.com
আত্মহত্যার রহস্য:
১৯৬০ সালে হেমিংওয়ে তার স্ত্রী সহ আমেরিকাতে স্থায়ী ভাবে ফিরে আসেন। তিনি কিছুটা অসুস্থ ছিলেন এই সময়টাতে। নিয়মিত সকাল বেলা শিকারে বের হতেন। তার শিকার করার জন্য একটি প্রিয় বন্দুক ছিল। এই বন্দুক দিয়েই তিনি ১৯৬১ সালের ২ জুলাই আত্মহত্যা করেন।

source: pauldavisoncrime.com
তার স্ত্রী মেরি হেমিংওয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আর্নেস্ট সকালে শিকার করতে যাবার পূর্বে বন্দুক পরিষ্কার করছিলেন, হয়তো ভুল ক্রমে বন্দুক থেকে গুলি বেরিয়েছে”। তার শারীরিক অসুস্থতাকে তিনি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
অবাক করা বিষয় হল, তার বাবা ক্লারেন্স হেমিংওয়ে, ভাই লিস্টার হেমিংওয়ে আর বোন উরসালা হেমিংওয়েও আত্মহত্যা করেছেন। হেমিংওয়ে পরিবারের রক্তেই মিশে আছে আত্মহত্যার ভয়ানক ব্যাধি। বিজ্ঞানীদের মতে, “বাইপোলার মোড ডিসঅর্ডার” নামক এক ধরনের জিনের কারণে আত্মহত্যা করেছিলেন হেমিংওয়ে। এই রোগ বংশ পরম্পরায় বাসা বাঁধে হেমিংওয়ের শরীরে। এই রোগের দুটি প্রধান লক্ষণ হলো, অতি মাত্রায় উচ্ছ্বাস কিংবা গভীর বিষণ্ণতায় ভোগা। হেমিংওয়ে গভীর বিষণ্ণতা থেকেই আত্মহত্যা করেছিল বলে ধারনা করা হয়। মাত্র ৬১ বছরের ঘটনা বহুল জীবন, সাহিত্যের ধারাকে করেছে সমৃদ্ধ, ইতিহাসকে করছে গতিময়। হেমিংওয়ে তার সাহিত্য কর্মের জন্য চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন কোটি সাহিত্য প্রেমী আর ভক্তদের হৃদয়ে।

www.thehemingwayproject.com
purchase dutasteride without prescription order generic zofran buy generic zofran 8mg
order levofloxacin 500mg pill levofloxacin order