যারা মোটামুটি বই বাজারে ঘুরেন কিংবা ইতিহাস সম্বন্ধে টুকটাক খোঁজ খবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই একবার হলেও আনা ফ্রাঙ্কের নাম শুনে থাকবেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে ১৯৪২ সালে জার্মানের দখলকৃত নেদারল্যান্ডসে এক ইহুদী কিশোরী ও তার পরিবারের আত্মগোপনের ২ বছর গৃহবন্দি হওয়ার ঘটনাই উঠে এসেছে তার ডায়েরিতে। এই ডায়েরিতে আরো উঠে এসেছে হিটলারের পৃথিবীতে ইহুদিদের সেই করুণ পরিণতি। কিন্তু তার পরিবার হিটলারের গোপন পুলিশ বাহিনীর হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারেনি। ১৯৪৪ সালে তারা ধরা পড়ে এবং তাদের হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। আনা ফ্রাঙ্কের বাবা ছাড়া আর কেউই বেঁচে ছিলেন না। আনা মারা গেলেও তার ডায়েরি পরিণত হয় এক অমূল্য ইতিহাসে। এ পর্যন্ত যা ৭০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয় এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বইয়ের তালিকায় অন্যতম অবস্থান করে।

Source: wordpress24.com
আনা ফ্রাঙ্কের বাল্যকালঃ
১৯২৯ সালের ১২ জুন আনা ফ্রাঙ্ক জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন বরেণ্য ব্যবসায়ী। কিন্তু মাত্র চার বছর যেতেই তাদের জীবনে নেমে আসে এক অসহনীয় দুর্ভোগ। ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় এসেই ইহুদিদের বিরুদ্ধে একের পর এক ব্যবস্থা নিতে থাকেন। তাই এখানে ব্যবসা বাণিজ্য করা ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার । তাই এই বছরই আনা ফ্রাঙ্কের বাবা অটো ফ্রাঙ্ক নেদারল্যান্ডস-এর রাজধানী আমস্টার্ডমে ব্যবসাপাতি গুছিয়ে চলে যান। এখানে ছোট ব্যবসা হলেও অল্পতে বেশ গুছিয়ে নেন। এই সময়টাতে আনা ফ্রাঙ্ক তার দাদির সাথে জার্মানেই ছিল। ১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনা ফ্রাঙ্ক আমস্টার্ডমে নিজ পরিবারের সাথে যোগ দেয় এবং ১৯৩৫ সাল থেকে স্কুলে যেতে শুরু করে। স্বভাবতই আনা ফ্রাঙ্ক ছিল বেশ বুদ্ধিমতী ও চতুর। মেধাবী হিসেবে স্কুলে তার বেশ একটা খ্যাতিও ছিল। কিন্তু তাদের নতুন জীবন খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ১৯৪০ সালের মে মাসে নেদারল্যান্ডস জার্মান নাৎসি বাহিনীর দখলে আসে। খুব দ্রুতই হিটলারের বাহিনী জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে, বিশেষত ইহুদিদের উপর নেমে আসে এক খড়গ। ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ ইহুদিকে নেদারল্যান্ড থেকে হল্যান্ডে প্রেরণ করা হয়। যার মধ্যে বাদ যায়নি কিশোরী আনা ফ্রাঙ্কও।

আত্মগোপনে ফ্রাঙ্কের পরিবারঃ
যেহেতু আনা ফ্রাঙ্করা জার্মানিতে থাকতেন তাই ১৯৪২ সালের জুলাইতে তার বড় বোন মার্গট ফ্রাঙ্ককে জার্মানের একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। চিঠি পেয়েই তৎক্ষণাৎ ফ্রাঙ্কের পরিবার তার বাবার ব্যবসায়ের কাছে পরিত্যক্ত একটি বাসায় আত্মগোপন করেন। যেটি আমস্টার্ডমের ২৬৩ পিনছেনগ্রাট রোডে অবস্থিত ছিল। আত্মগোপনের আগে তারা একটি খবর ছড়িয়ে দেয় যে, তারা পালিয়ে সুইজারল্যান্ড-এ চলে গেছে।

এরপর শুরু হয় তাদের এক দীর্ঘ সংগ্রামের যাত্রা। আনা ফ্রাঙ্কের পরিবারের সাথে যুক্ত হয় তার বাবার ব্যবসার সাথে যুক্ত আরেক ইহুদি পরিবার। সবমিলিয়ে হিটলারের হাত থেকে বাঁচতে আটজন সদস্যের এক গুপ্ত জীবন শুরু হয়। আর তাদের বাঁচতে সাহায্য করতো আনা ফ্রাঙ্কের বাবার কর্মচারীরা। যারা তাদের নিজেদের জীবন বাজি রেখে খাবার সাপ্লাই দিত। পাশাপাশি খবরাখবরও জানাতো। তাদের ঘরের দরজা ছিল অনেকটা বইয়ের একটা তাকের মতো। বাইরে থেকে সহজেই ধরার কোন উপায় ছিলনা। যাহোক কিছুদিন পরে তাদের সাথে যুক্ত হন আরো দুই ইহুদি।

আনা ফ্রাঙ্ক এই বন্দিদশাকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে পুরো ব্যাপারটাই ছিল আতঙ্কের। যে কোন সময় ধরা পড়ে যাবার আশঙ্কা কিংবা একটু বাইরেও যাওয়া যেত না। সারাদিন চুপচাপ ঘরে বসে থাকতে হত। কেননা কথা বললে বাইরে যারা কাজকর্ম করে তাদের কাছে ধরা খেয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। তবে এই একঘেয়েমির মধ্যে আনা ফ্রাঙ্ক বেছে নিয়েছিলেন তার ডায়েরিকে। তাদের আত্মগোপনের মাত্র এক মাস আগেই সে তার ১৩তম জন্মদিনে এই ডায়েরিটা উপহার হিসেবে পেয়েছেন। সে সারাদিন তার আবেগ অনুভূতিকে জমা করার জন্য এই ডায়েরিকেই বেঁছে নিয়েছিল। তার ডায়েরিতে বেছে নিয়েছিল এক অদৃশ্য চরিত্র, যাকে সে কিটি নামে ডাকতো। এই কিটিকে উদ্দেশ্য করেই তার লেখাগুলো তৈরি হয়েছিল। আনা ফ্রাঙ্ক তার হতাশা ও একাকীত্বকে বেশ চতুরতার সাথেই বইটিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাশাপাশি এই বয়সে যে মেয়েদের অন্য ছেলের প্রতি ভালোলাগা কাজ করে তা লিখতেও তিনি ছিলেন অকপট। পাশাপাশি মায়ের সাথে কিছু নিয়ে মতানৈক্য কিংবা বোনের সাথে ঝগড়া তা নিয়েও দিয়েছেন চমৎকার বর্ণনা। উল্লেখ্য, আনা ফ্রাঙ্ক তার লেখার ক্ষেত্রে বেশ পরিপক্বতার পরিচয় দেন; বিশেষত যুদ্ধ, মানবতার মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে।

ফ্রাঙ্ক পরিবার গোস্তাপো কর্তৃক ধৃত:
প্রায় ২৫ মাসের টানটান উত্তেজনা ও অবিশ্রান্ত জীবন যাপনের পর ১৯৪৪ সালের ৪ আগস্ট একপ্রকার যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে নাৎসি বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে। কোন এক গুপচরের মাধ্যমে হিটলারের পুলিশ বাহিনী আনা ফ্রাঙ্কদের অবস্থান সম্বন্ধে তথ্য পায় এবং সেখান থেকে তাদের আটক করে দক্ষিণ নেদারল্যান্ডস এর ওয়েস্টব্রোকে প্রেরণ করেন। এরপর তাদের সেখান থেকে প্রেরণ করা হয় পোল্যান্ডের অসউইজে। এখান থেকে আনা ফ্রাঙ্ক ও তার বোন মার্গেটকে প্রেরণ করা হয় জার্মানির বার্গেন-বেলসেনে। ১৯৪৫ সালের মার্চে আনা ফ্রাঙ্ক ও তার বোন ক্ষুধার্ত অবস্থায় মারা যায়। এরপর তাদেরকে বিশাল লাশের স্তূপে ফেলে দেয়া হয়। শুধুমাত্র তার বাবা বেঁচে ছিলেন। এছাড়া অন্যান্য আত্মগোপনকারী সকলেই মারা যান।

আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরিঃ
বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে অটো ফ্রাঙ্ক আমস্টার্ডমে ফিরে আসেন। এখানে তার কোম্পানির অস্ট্রিয়ান সেক্রেটারি মিপ সেজ তার মেয়ের পাঁচটি নোট বই ও প্রায় এলোমেলো ৩০০শ’র অধিক কাগজ হাতে তুলে দেন। আনা ফ্রাঙ্কের বাড়ির সবাইকে যখন জার্মানিরা ধরে নিয়ে যায় তখন তিনি এগুলো আনা ফ্রাঙ্কের ডেস্ক থেকে সংগ্রহ করেন। যদিও বলা হয়ে থাকে যে, আনা ফ্রাঙ্কের বোন মার্গেট ফ্রাঙ্কেরও একটি ডায়েরি ছিল, তবে তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। অটো ফ্রাঙ্ক যত্নের সাথেই এগুলো সংরক্ষণ করেন। ১৯৪৭ সালে প্রথমবারের মতো ডাচ ভাষায় এটি “Rear Annex” নামে প্রকাশিত হয়। যদিও শুরুর দিকে আমেরিকান প্রকাশকরা এটিকে প্রকাশে অত আগ্রহ দেখাননি কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে এটি, “The Diary of a Young Girl” নামে প্রকাশিত হয় এবং খুব দ্রুতই এটি চারদিকে জনপ্রিয়তা লাভ করতে সমর্থ হয়। এরপর বাকি সবটাই ইতিহাস।
তথ্যসূত্রঃ
১. https://en.wikipedia.org/wiki/The_Diary_of_a_Young_Girl
২. https://www.shmoop.com/diary-of-anne-frank/summary.html
৩. https://www.cliffsnotes.com/literature/d/the-diary-of-anne-frank/about-the-diary-of-anne-frank
৪. https://www.biography.com/people/anne-frank-9300892