ইউরোপাঃ বরফে ঢাকা উপগ্রহ আর তার গভীর সমুদ্র

1

লো, গ্যানিমেড আর ক্যালিস্টোদের মত ইউরোপাও বৃহস্পতি গ্রহের একটি উপগ্রহ। জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলেই এই উপগ্রহগুলো প্রথম আবিষ্কার করেন। বৃহস্পতির এই চার ছানার মধ্যে ইউরোপাই হচ্ছে সবচেয়ে ছোট। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই ইউরোপাই সৌরজগতের সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক উপগ্রহগুলোর মধ্যে একটি।

ইউরোপার উপরিভাগ অর্থাৎ পৃষ্ঠতলের প্রায় পুরোটাই বরফের একটি আবরণে আচ্ছাদিত। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই বরফের আবরণের নিচেই রয়েছে বিশাল মহাসাগর। বরফের আবরণের কারণেই ইউরোপাকে সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল দেখায়। শেষবার ২০১৩ সালে এই উপগ্রহে পানির উপস্থিতি চিহ্নিত করা হয়। যদিও এরপর আজ পর্যন্ত এমন পর্যবেক্ষণের আর পুনরাবৃত্তি দেখা যায়নি।

অনেক মহাকাশযানই ইউরোপার পাশ দিয়ে পরিভ্রমণ করেছে (যথা: পায়োনিয়ার ১০ এবং ১১, সত্তর এর দশকে ভয়েজার ১ এবং ২)। ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ এর মধ্যবর্তী সময়ে ‘গ্যালিলিও’ নামের মহাকাশযানটি বৃহস্পতি এবং এর উপগ্রহগুলোতে লম্বা মিশন চালিয়েছে। এছাড়া নাসা এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি উভয়ই ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপার উপর আরেকটি মিশন চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ইউরোপা
Source: Wattpad

একনজরে ইউরোপা

বয়স: বৃহস্পতি গ্রহের মতই ইউরোপার আনুমানিক বয়স প্রায় সাড়ে চারশত কোটি বছর।

সূর্য থেকে দূরত্ব: ইউরোপা থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৪৮ কোটি মাইল (৭৮ কোটি কিলোমিটার) ।

বৃহস্পতি থেকে দূরত্ব: ইউরোপা হচ্ছে জুপিটারের  ৬ষ্ঠ উপগ্রহ। জুপিটার থেকে এটির গড় দূরত্ব প্রায় ৪ লক্ষ ১৪ হাজার মাইল (৬ লক্ষ ৭০ হাজার ৯ শত কিলোমিটার)। জুপিটারকে একবার প্রদক্ষিণ করতে এর সময় লাগে প্রায় সাড়ে ৩ পার্থিব-দিন। মহাকর্ষীয় শক্তির দরুন ইউরোপার মাত্র একটি পাশই বৃহস্পতির দিকে সর্বদা মুখ করে থাকে।

আকার: ইউরোপার ব্যাস প্রায় ১৯০০ মাইল (৩,১০০ কিলোমিটার)।  এটি পৃথিবীর উপগ্রহ চন্দ্রের তুলনায় ছোট কিন্তু বামুন গ্রহ প্লুটোর তুলনায় বড়। তবে এটি সবচেয়ে ছোট গ্যালিলিয়ান উপগ্রহ।

তাপমাত্রা: ইউরোপার পৃষ্ঠতলের নিরক্ষরেখার তাপমাত্রা কখনই -২৬০ ডিগ্রী ফারেনহাইটের (-১৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াস) বেশি উঠে না। অন্যদিকে উপগ্রহের উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা -৩৭০ ডিগ্রী ফারেনহাইট (-২২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস)।

 

ইউরোপা
Source: astronocat.wordpress.com

ইউরোপার বৈশিষ্ট্যাবলী:  

ইউরোপার সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর উচ্চ আলো প্রতিফলন ক্ষমতা। ইউরোপার বরফীয় ভূত্বকের কারণে  এর এলবেডোর (আলো প্রতিফলনের মাত্রা)  পরিমাপ ০.৬৪ । যা কিনা সৌরজগতের অধিকাংশ উপগ্রহগুলির থেকে বেশি।

বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে ইউরোপার উপরিতলের বয়স ২ কোটি থেকে ১৮ কোটি বছর। যা কিনা নবীন উপরিতল বলাই শ্রেয়।

গ্যালিলিও মহাকাশযানের পাঠানো ছবি এবং তথ্য মতে, ইউরোপার প্রায় পুরোটাই সিলিকেট শিলা দিয়ে গঠিত, যার কিনা পৃথিবীর মতো রয়েছে লৌহ কেন্দ্রস্থল। তবে ইউরোপার শিলা তলদেশকে আবৃত করে রেখেছে ৫০ থেকে ১০৫ মাইল পুরু বরফ অথবা পানির আস্তরণ। যা কিনা পৃথিবীতে বিরল ঘটনা।

ইউরোপার চৌম্বক বিভবের উঠতি-নামতি থেকে এক ধরণের পরিবাহীর আভাস মিলে। বিজ্ঞানীরা এটিও চিন্তা করেছেন যে, ইউরোপার পৃষ্ঠতলের নিচে গভীর মহাসাগর বিদ্যমান। এই মহাসাগরে থাকতে পারে যে কোন ধরণের প্রাণের উৎস। মহাজাগতিক প্রাণের সম্ভাবনাই ইউরোপাকে মূলত গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। ইদানীংকালে এক নতুন তত্ত্বও আবিষ্কৃত হয়েছে যাতে বলা হয়েছে ইউরোপা প্রাণ সঞ্চালনের আশ্রয়স্থল হতে পারে। ইউরোপার পৃষ্ঠতলে রয়েছে গভীর ফাটল। অনেকে বিশ্বাস করেন যে এই ফাটলগুলো হচ্ছে ইউরোপার ভূগর্ভে অবস্থিত মহাসাগরের উত্তাল প্রবাহের প্রতিফলন। এটা সম্ভব যে, ইউরোপার কক্ষপথ যখন বৃহস্পতির কাছাকাছি অবস্থান করে তখন ভূগর্ভস্থ সমুদ্রের উত্তাল প্রবাহের দরুন পানি পৃষ্ঠতলে উঠে আসার চেষ্টা করে। যদি এমনটি হয়ে থাকে তবে সমুদ্রের উচ্চতার তারতম্যের কারণে ইউরোপার উপরিভাগে ফাটল ধরে থাকতে পারে।

ইউরোপার বরফের আস্তরণ খুঁড়ে সমুদ্রের পানির নমুনা নেওয়ার প্রয়োজন নাও হতে পারে। ২০১৩ সালে নাসার হাবল স্পেস টেলিস্কোপ উপগ্রহের দক্ষিণ মেরু থেকে জলীয় বাষ্প মহাশূন্যে আনুমানিক ১২৫ মাইল (২০০ কিলোমিটার) উচ্চতায় সজোরে বেরিয়ে আসতে দেখতে পায়। এই আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের মনে উত্তেজনার খোরাক যুগিয়েছিল। তখন তারা ভেবেছিলেন, একটি রোবোটিক উড়ন্ত মহাকাশযান এই জলীয় বাষ্প সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে যার ফলে ইউরোপায় অবতরণ না করেই এর অন্তর্ভাগ সম্পর্কে গবেষণা করা সম্ভব হবে। যাইহোক, পরবর্তীতে ২০১৪ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি জুড়ে এমন কোন আভাস আর পাওয়া যায়নি। গবেষকরা এর বিভিন্ন মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। যেমন: ইউরোপা থেকে এই জলীয় বাষ্পের উদগীরন হয়তবা খুবই দুষ্কর ব্যাপার, অনেকটা পৃথিবীর ভিতর থেকে আগ্নেয়গিরির মাধ্যমে লাভা উদগীরনের মতো। অন্য আরেকটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, পৃথিবী থেকে হাবল টেলিস্কোপের মাধ্যমে ইউরোপার সব জলীয় বাষ্প উদগীরন দেখা সম্ভব নয়।

২০১৪ সালে বিজ্ঞানীরা এটি খুঁজে পান যে, ইউরোপার বুকেও ভূগর্ভস্থ প্লেট থাকতে পারে যা কিনা সৌরজগতে একমাত্র পৃথিবীতেই রয়েছে। এই ভূগর্ভস্থ প্লেটই কোন গ্রহের জীব সঞ্চালনে ভূমিকা রাখে।

ইউরোপা
Source: Pluto Rules

ইউরোপা: প্রাণের সঞ্চালন কি সম্ভব এখানে?                                  

হিমায়িত ভূত্বকের নিচে ভূগর্ভস্থ পানির বিচলনের কারণেই ইউরোপাকে বিজ্ঞানীরা সৌরজগতে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাব্য জায়গাগুলোর মধ্যে শীর্ষে রেখেছেন। পৃথিবীর সমুদ্র গহ্বরের গভীরের ফাটলের মতই ইউরোপার হিমায়িত ভূত্বকের নিচের ফাটলকে নির্দেশ করছেন অনেক বিজ্ঞানী।

২০১৬ সালে একটি গবেষণায় বলা হয়, ইউরোপা যতটুকু হাইড্রোজেন তৈরি করে তার তুলনায় ১০ গুণ অক্সিজেন তৈরি করে, যা কিনা পৃথিবীর সাথে অনেকটাই মিলে যায়। এটি ইউরোপার সমুদ্রগুলোকে প্রাণ বাঁচিয়ে রাখার জন্য পরিবেশ বান্ধব করে তুলতে পারে। ফলে উপগ্রহটির জোয়ারের কারণে উৎপন্ন শক্তির উপর নির্ভর করে থাকতে হবে না। বরং, রাসায়নিক বিক্রিয়াই উপগ্রহের চক্র চালনায় সহায়তা করবে।

ইউরোপা নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবনা

২০১৩ সালে ‘ইউএস ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল’ নাসার আন্তঃগ্রহীয় আবিষ্কার কার্যক্রমের পরবর্তী ১০ বছরের সূচি পেশ করে। ঠিক সেই সময়ই নাসা বৃহস্পতির এই বরফপূর্ণ উপগ্রহে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়।

ইউরোপা
Source: Astronomy Magazine

নাসার ভাষ্যমতে, এই অভিযান শুরু হবে ২০২০ সালের মধ্যে। আর অভিযানের অংশ হিসেবে থাকবে ইউরোপাকে প্রদক্ষিণরত একাধিক মহাকাশযান, এছাড়া জুপিটারকে প্রদক্ষিণরত একটি মহাকাশযান। অত্যাধুনিক ক্যামেরাসহ  ৯ ধরণের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এই মিশনে যুক্ত করা হবে। ইউরোপার বরফ ভেদ করে পর্যবেক্ষণের জন্য এবং বরফের পুরুত্ব মাপার জন্য নিয়োজিত থাকবে রাডার। চৌম্বক বিভব মাপার জন্য থাকবে ম্যাগ্নেটোমিটার (উদগিরন নির্ণয়ের জন্য একটি তাপীয় যন্ত্র) যা দিয়ে সমুদ্রের পানি কতটা লবণাক্ত তাও পরিমাপ করা যাবে । প্রায় ৪৫ টি ক্ষুদ্র মহাকাশযান ইউরোপাকে ১৬ মাইল থেকে ১৭০০ মাইল উচ্চতায় সর্বদা প্রদক্ষিণ করবে।

ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সিও ইউরোপা ও আরও দুইটি উপগ্রহের উপর মিশনের পরিকল্পনা করেছে। এই মিশনের যাত্রা শুরু হওয়ার কথা ২০২২ সালে এবং এটি বৃহস্পতিতে পৌঁছাতে সময় নিবে প্রায় ৮ বছর, অর্থাৎ ২০৩০ সালে এটি জুপিটার এবং এর উপগ্রহের কাছাকাছি পৌঁছাবে।  মিশনটির স্থায়িত্ব হবে প্রায় ৩ বছর। যখন মিশনের মহাকাশযানটি ইউরোপাতে পৌঁছাবে তখন সেটি সেখানকার জৈব অণু এবং অন্যান্য উপাদানগুলো জীবিকা নির্বাহের উপযোগী কিনা তা পরীক্ষা করবে। অন্যদিকে, ইউরোপার ভূত্বক কতটা পুরু এটি পর্যবেক্ষণও এই মিশনের আরেকটি উদ্দেশ্য।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

1 Comment
  1. prodaja investicionog zlata says

    I enjoy examining and I think this website got some genuinely useful stuff on it! .

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More