প্রথম পর্বের পর
গত পর্বে আমরা গ্রহণ সম্পর্কিত পৌরাণিক কাহিনীসমূহ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আজ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাগুলোও জেনে নেয়া যাক! আমরা আগেই বলেছি, কোনো ঘটনা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পর্যবেক্ষণ, পর্যাপ্ত পরীক্ষণ এবং গ্রহণযোগ্য যুক্তি বা ব্যাখ্যা- এই তিনের সমন্বয়ের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানকেই কেবল বিজ্ঞান বলা যাবে। বিজ্ঞান যেহেতু পুরাণের মতো এতো মশলাদার নয়, বরং কিছুটা কাঠখোট্টা; তাই যথাসম্ভব সহজভাবেই বলার চেষ্টা করছি। বাল্যকাল থেকেই আমরা জানি, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে আর পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে চাঁদ। তো ঘুরতে ঘুরতে মাঝেমধ্যেই পৃথিবী, সূর্য ও চাঁদ একই সরলরেখায় এসে পড়ে। সূর্যের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় সে সর্বদাই এই সরলরেখার একপ্রান্তে পড়ে থাকে। কিন্তু সরলরেখার অন্যপ্রান্তে কে থাকবে (চাঁদ নাকি পৃথিবী?), তার উপরেই নির্ভর করছে সূর্যগ্রহণ হবে, নাকি চন্দ্রগ্রহণ হবে! যদি সরলরেখার অন্য প্রান্তে পৃথিবী থাকে, তাহলে চাঁদমামা এসে সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে চাঁদের যে পিঠটা সূর্যের দিকে থাকে, সে পিঠে সূর্যের আলো পড়ে। আমরা জানি, কোনো বস্তুর উপরে এক পাশ থেকে আলো ফেললে বিপরীত পাশে ঐ বস্তুর ছায়া পড়ে। সুতরাং চাঁদের যে পিঠটা পৃথিবীর দিকে থাকে, সে পিঠের ছায়া পৃথিবীর উপরে পড়ে। ফলে চাঁদের ছায়া পৃথিবীর যে স্থানে পড়ে, সেই স্থান থেকে সূর্যকে দেখা যায় না। অর্থাৎ দিনের বেলা কিছু সময়ের জন্য চাঁদ এসে সূর্যকে ঢেকে ফেলে। এটাকেই বলে সূর্যগ্রহণ। সহজ ভাষায়, সূর্যগ্রহণ মানে পৃথিবীপৃষ্ঠের উপরে চাঁদের ছায়া। চাঁদ যখন সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে তখন পূর্ণগ্রহণ হয়, আর সূর্যের কিছু অংশ ঢাকলে হয় আংশিক গ্রহণ। আংশিক গ্রহণ প্রায়ই দেখা যায়, কিন্তু পূর্ণগ্রহণ খুব কম লোকই দেখতে পায়। কারণটা তাহলে খুলেই বলি।

চাঁদের ছায়া একটা নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীর একটা নির্দিষ্ট অংশের উপরেই পড়ে। সে অংশটাকে আবার দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। আম্ব্রা (গাঢ় ছায়া) আর প্যানআম্ব্রা (হালকা ছায়া)। আম্ব্রাল রিজিওন থেকে পূর্ণগ্রহণ আর প্যানআম্ব্রাল রিজিওন থেকে আংশিক গ্রহণ দেখা যায়।

গ্রহণের সময় চাঁদ যে কক্ষপথে পৃথিবীকে আবর্তন করে, শুধুমাত্র সেই কক্ষপথের নিচে থাকা পৃথিবীপৃষ্ঠের উপরেই চাঁদের পূর্ণাঙ্গ ছায়া পড়ে। ভূপৃষ্ঠের ঐ কল্পিত রেখাকে বলা হয় “পাথ অফ টোটালিটি।” এই “পাথ অব টোটালিটি-“তে অবস্থানরত অধিবাসীরাই শুধুমাত্র পূর্ণগ্রহণ দেখার সুযোগ পায়। বাকিদের আংশিক গ্রহণ দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এখন প্রশ্ন হলো, চাঁদের তুলনায় সূর্য এর ব্যাসার্ধ ৪০০ গুণ বড়। তাহলে এতোটুকু চাঁদ এতোবড় সূর্যকে ঢেকে ফেলে কিভাবে? কারণটা বেশ মজার। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের চেয়ে সূর্যের দূরত্ব ঠিক ৪০০ গুণ বেশি। ফলে সূর্যের আকার আর দূরত্বে কাটাকুটি হয়ে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে সুর্যকে ঠিক চাঁদের মতোই দেখায়।

এবার আবারো শুরুতে ফিরে যাওয়া যাক। আমরা আগেই বলেছি, পৃথিবী, সূর্য এবং চাঁদের সরলরেখায় সূর্য সবসময় একপ্রান্তে পড়ে থাকে। সরলরেখার অন্য প্রান্তে যখন চাঁদ থাকে, তখন পৃথিবী এসে সূর্য ও চাঁদের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা জানি, চাঁদের নিজস্ব আলো নেই। সূর্যের আলোতে সে আলোকিত হয়। কিন্তু সরলরেখার মাঝখানে পৃথিবী থাকায় সুর্যের আলো চাঁদের নিকটে পৌঁছাতে পারে না। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই চাঁদের উপর পৃথিবীর ছায়া পড়ে। সে ছায়া যখন চাঁদকে ঢেকে ফেলে, তখন ঝলমলে পুর্ণিমাতেও কিছুক্ষণের জন্য আমরা চাঁদকে দেখতে পাই না। এটাকেই বলে চন্দ্রগ্রহণ। অর্থাৎ সহজ ভাষায়, চন্দ্রগ্রহণ মানে চন্দ্রপৃষ্ঠের উপরে পৃথিবীর ছায়া।

বাকিটা আগের মতোই। পৃথিবীর ছায়া যখন চাঁদকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে তখন পূর্ণগ্রহণ হয়, আর চাঁদের কিছু অংশ ঢাকলে হয় আংশিক গ্রহণ। এখানেও আম্ব্রা,প্যানআম্ব্রা আর পাথ অব টোটালিটি-র ব্যাখ্যাগুলো আগের মতোই। তবে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ স্বচক্ষে দেখতে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার!
পৃথিবীর ছায়া চাঁদকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলার পরমুহূর্তেই এক অভুতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার বদলে পুরো চাঁদটি টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করে। একে বলা হয় “রেড মুন” বা “রক্তিম চাঁদ“। কিন্তু কেন এমন হয়? ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি (বেগুনী)-কে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল শোষণ করে নেয়। কিন্তু দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি (লোহিত) বায়ুমন্ডল ভেদ করে চাঁদের দিকে বেঁকে যায়। লোহিতরশ্মির এই বিচ্ছুরণের কারণেই পূর্ণগ্রহণের সময় চাঁদ টকটকে লাল দেখায়।

এখন কথা হচ্ছে, চাঁদ তো ২৯ দিন পরপর পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। সেইসাথে পৃথিবীও চাঁদকে সাথে নিয়ে সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। সে হিসেবে তো প্রতি ২৯ দিন পরপর সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ একই সরলরেখায় আসার কথা। তাই না? তাহলে প্রতিমাসেই গ্রহণ হয় না কেন? এর ব্যাখ্যাটাও বেশ মজার! চাঁদের কক্ষপথ পৃথিবীর সাপেক্ষে ৫ ডিগ্রি কৌণিক। ফলে পৃথিবী ও সূর্য সর্বদা একই সরলরেখায় থাকলেও চাঁদ কখনো সেই সরলরেখার উপরে থাকে, আবার কখনো নিচে থাকে। এ কারণেই প্রতি মাসে গ্রহণ হয় না।

শেষ করার আগে বলে রাখি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই অগ্রগতির যুগেও আমাদের সমাজে গ্রহণ সম্পর্কে বহু কুসংস্কার প্রচলিত আছে, যা কিনা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পুর্ণ ভিত্তিহীন এবং অমূলক। যেমনঃ গ্রহণের সময় গর্ভবতী মায়েরা কোনও কিছু খেলে জন্মের পরে সন্তান পেটুক হয়। এসময় কাটাবাছা করলে, বিশেষ করে মাছ কুটলে ঠোঁট কাটা, কান কাট বা নাক কাটা সন্তানের জন্ম হয়। সূর্যগ্রহণের সময় গাছের ডাল ভাঙলে বা বাঁকানোর চেষ্টা করলে হাত-পা বাঁকানো (পোলিও) সন্তানের জন্ম হয়। এছাড়াও বলা হয়, গ্রহণের সময় নাকি কোনোকিছু খেতে নেই, এসময় খাবার তৈরি করলেও তা ফেলে দিতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি! এই একবিংশ শতাব্দীতে বসবাস করেও যারা এসব ভ্রান্ত ধারণায় বিশ্বাস করে, তারা নিঃসন্দেহে এখনো বোকার স্বর্গে বাস করছে!

***একটি সতর্কবার্তাঃ সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের দিকে সরাসরি তাকানো উচিৎ নয়। এসময় সুতীব্র আলোকরশ্মি নির্গত হয়,যা সরাসরি চোখে পড়লে দৃষ্টিশক্তি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য বিশেষায়িত কালো চশমাও আজকাল পাওয়া যায়। তবে বিশেষায়িত চশমা না থাকলেও অসুবিধা নেই। কার্ডবোর্ডের মধ্যে ফুটো করে স্বচ্ছ কোনো মাধ্যমের ভেতর দিয়ে (যেমনঃ পানি) খুব সহজেই পরোক্ষভাবে সূর্যগ্রহণ উপভোগ করা সম্ভব। অবশ্য পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হয়ে যাওয়ার পর সরাসরি সূর্যের দিকে তাকাতে কোনো বাধা নেই। আর চাঁদের যেহেতু নিজস্ব আলোই নেই, তাই চন্দ্রগ্রহণ সরাসরি অবলোকনের ব্যাপারে এরকম কোনো বিধিনিষেধ নেই।
Reference:
- NASA Space Place
- National Geography