বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী গায়কদের মধ্যে বব ডিলান অন্যতম। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে জনপ্রিয় বহু প্রতিভাধার এই ব্যক্তি তাঁর গানে তুলে আনেন সামাজিক এবং রাজনৈতিক অনেক বিষয় যার কারণে বিভিন্ন সময়ে তিনি হয়েছেন আলোচিত, ২০১৬ সালে সাহিত্যে পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। সংগীত জগতের এই কিংবদন্তীকে নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।
কে এই বব ডিলান?
একাধারে গীতিকার, সুরকার, সংগীত শিল্পী, লেখক এবং চিত্রকর বব ডিলান এর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৪ মে মিনেসোটার ডুলুথ এর সেইন্ট মেরিজ হসপিটালে। তাঁর আসল নাম রবার্ট এলেন জিমারম্যান। তাঁর শৈশব কেটেছে হিবিং, মিনেসোটায়। ইলেকট্রনিক জিনিসের দোকানের মালিক বাবা আব্রাম জিমারম্যান ছিলেন এবং মা বিয়েট্রিস “বিয়েটি” স্টোন ছিলেন ছোট একটি ইহুদি সম্প্রদায়ের সদস্য। রবার্ট এবং তাঁর ছোট ভাই ডেভিড বড় হয়েছেন হিবিং এর ইহুদি পরিবেশে এবং সেখান থেকেই ১৯৫৯ সালে হাইস্কুলের গণ্ডি পার করেন।
ছোট থেকেই গান বাজনার শখ ছিল রবার্টের। শৈশবে রেডিওতে ব্লুজ এবং কান্ট্রি জানরার গান শুনতেন আর কৈশোরে শুনতেন রক এন্ড রোল। সেই থেকে শুরু। হাইস্কুলে থাকতে বেশ কিছু ব্যান্ড বানিয়েছিলেন রবার্ট। কলেজে থাকতে “বব ডিলান” নামে ফোক এবং কান্ট্রি গাওয়া শুরু করেন তিনি। ১৯৬১ সালে প্রথম রেকর্ডিং এর কন্ট্রাক্ট পান এবং আমেরিকার সংগীত ভুবনে মৌলিক এবং শক্তিশালী কণ্ঠ হিসেবে আগমন ঘটে।
সংগীত জগতে প্রবেশ এবং উত্থান
এল্ভিস প্রিসলি, জেরি লি লুইস এবং লিটল রিচার্ডের মত বিখ্যাত গায়কদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অল্পবয়সী ডিলান নিজের ব্যান্ড গঠন করে যার মধ্যে রয়েছে গোল্ডেন কোর্ডস এবং এলস্টন গান। ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটায় পরার সময় স্থানীয় ক্যাফেতে বব ডিলান নামে গান করা শুরু করেন। ১৯৬০ সালে ১ম বর্ষে থাকাকালীন সময়ে কলেজ ত্যাগ করে নিউইয়র্কে পাড়ি জমান ডিলান। নিউইয়র্কের এক হাসপাতালে কিংবদন্তী ফোক গায়ক উডি গাথ্রি স্নায়ুতন্ত্রের দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ছিলেন। ডিলান প্রতিদিন উডিকে দেখতে যেতেন, গ্রিনউইচ গ্রামের কফিহাউস এবং ফোক ক্লাবগুলোতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তাঁর। সেখানে অন্যান্য মিউজিসিয়ানদের সাথে সাক্ষাত হত, তাদের কাছ থেকে গান লেখার রশদ যোগার করতেন ডিলান এবং খুব দ্রুত গান লেখা শুরু করেন- যাদের মধ্যে “সং টু উডি” অন্যতম।
১৯৬১ সালের হেমন্তে তাঁর গাওয়া গান দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ইতিবাচক সাড়া লাভ করে এবং কলোম্বিয়া রেকর্ডের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। এই পর্যায়ে ডিলান নিজের পদবি আইনতভাবে ডিলানে পরিবর্তন করেন। ১৯৬২ সালে বের হওয়া রেকর্ডে মাত্র দুইটি মৌলিক গান থাকলেও অ্যালবামের ফোক এবং ব্লুজ গানের কভার থেকে ডিলানের কণ্ঠের জাদু প্রকাশ পায়। প্রথম বছরে অ্যালবামটির মাত্র ৫০০ কপি বিক্রি হয়। এই ঘটনায় কলোম্বিয়া রেকর্ডের অনেকেই ডিলানের সাথে কন্ট্রাক্ট ভেঙ্গে হ্যামন্ডস ফলির মত শিল্পীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু হ্যামন্ড নিজে ডিলানের হয়ে কথা বলেন এবং জনি ক্যাশ এতে সমর্থন জানায়।
১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে ডিলান যুক্তরাজ্যে তাঁর প্রথম ট্যুরে যান। সেখানে তিনি ম্যাড হাউস অন ক্যাসেল স্ট্রিট নামক নাটকে অভিনয়ের অফার পান। নাটকে তিনি অভিনয় করেন এবং নাটকের শেষে “ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড” গানটি পরিবেশন করেন। ১৯৬৩ সালে ডিলানের ২য় অ্যালবাম বের হয় এবং ততদিনে গায়ক এবং গীতিকার হিসেবে তাঁর খ্যাতির প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। এই অ্যালবামের বেশিরভাগ গান ছিল প্রতিবাদের গান। দ্য ফ্রি হুইলিন’ বব ডিলান অ্যালবামে আমেরিকান পপুলার মিউজিকের ইতিহাসে সবচেয়ে মৌলিক এবং কাব্যিক কণ্ঠ হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। ১৯৬৪ সালের মধ্যে ডিলান বছরে ২০০ টি কনসার্টে অংশ নিতেন কিন্তু প্রতিবাদী আন্দোলনের জন্য গান লিখে এবং সুর করে একসময় ডিলান ক্লান্ত হয়ে যান। ১৯৬৪ সালে তিনি এনাদার সাইড অব বব ডিলান শীর্ষক যে অ্যালবাম বের করেন তা ছিল অনেকটা ব্যক্তিগত, অন্তর্মুখী গানের সংকলন এবং ডিলানের রাজনৈতিক গানগুলো থেকে অনেক ভিন্ন।
১৯৬৬ সালের দুর্ঘটনা
১৯৬৬ সালের ২৯ জুলাই উডস্টক, নিউইয়র্কে বাড়ির কাছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হন বব ডিলান এবং এই দুর্ঘটনায় প্রাপ্ত আঘাত থেকে সেরে উঠতে সময় নেন প্রায় এক বছর। এই দুর্ঘটনা নিয়ে এখনো অনেক রহস্য রয়েছে কারণ অ্যাকসিডেন্ট এর সময় কোন অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়নি বা তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি। ডিলানের বায়োগ্রাফারদের ভাষ্যমতে, এই অ্যাকসিডেন্ট ছিল ডিলানের চারপাশের সকল চাপ থেকে বিরতি নেয়ার সুযোগ। ডিলান নিজেও তাঁর জীবনীতে বলেছেন, “I had been in a motorcycle accident and I’d been hurt, but I recovered. Truth was that I wanted to get out of the rat race.” এরপর ডিলান প্রায় আট বছর কোন ট্যুরে যাননি, জনসমক্ষেও খুব কম উপস্থিত হতেন।
অ্যাকসিডেন্টের প্রায় ১৯ মাস পর ১৯৬৭ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে ডিলান ন্যাশভিলে নিজের স্টুডিওতে ফিরে আসেন। তাঁর সাথে বেইস এ ছিলেন চার্লি ম্যাকোয়, ড্রামস এ কেনি বাটারি এবং স্টিল গিটারে ছিলেন পিট ড্রেক। ফলাফল, জন ওয়েসলি হার্ডিং, আমেরিকান ওয়েস্ট এবং বাইবেলের আলোকে লেখা ছোট ছোট গানের রেকর্ডিং। গানের লিরিকে ফুটে উঠেছিল জুডিও- ক্রিস্টিয়ান সংস্কৃতির ভাব-গাম্ভীর্য, যা ডিলানের ১৯৬০ সালের গানগুলো থেকে ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ১৯৬৭ সালের ৩ অক্টোবর উডি গাথ্রি মৃত্যুবরণ করেন এবং তখন ডিলান ১২ মাস পর ১৯৬৮ সালের ২০ জানুয়ারিতে প্রথম সরাসরি জনসমক্ষে আসেন কার্নেগী হলে অনুষ্ঠিত গাথ্রি মেমোরিয়াল কনসার্ট এ।
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এবং বব ডিলান
১৯৭১ সালের যুদ্ধে যখন বাংলাদেশ পুড়ছে, সেই আগুনের উত্তাপ এসে পৌঁছায় সুদূর আমেরিকায়। নিরীহ, নিরস্ত্র জনগণের উপর অত্যাচারের ঘটনায় তীব্র নিন্দা এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত মানুষের সাহায্যার্থে আয়োজিত হয় কনসার্ট ফর বাংলাদেশ যার আয়োজক ছিলেন জর্জ হ্যারিসন এবং পণ্ডিত রবিশংকর। তাদের ডাকে সাড়া দেন ফোক সংগীতের কিংবদন্তী বব ডিলান। কনসার্টে ডিলানের উপস্থিতি ছিল দর্শকদের জন্য চমক। ১৯৭১ সালের ১ আগস্টে আয়োজিত এই কনসার্টে বব ডিলান তাঁর বিখ্যাত “ব্লোয়িং ফর দ্য উইন্ড” গানটি পরিবেশন করেন। কনসার্টে মোট লোক সংখ্যা ছিল ৪০,০০০ এবং কনসার্ট থেকে ২৫০,০০০ ডলার উঠেছিল যা ইউনিসেফের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠানো হয়।
বব ডিলানের গান
বব ডিলান সর্বকালের জনপ্রিয় বেশ কিছু গানের জন্মদাতা। তাঁর বিখ্যাত ১০ টি গানের তালিকা দেয়া হল-
১. নট ডার্ক ইয়েট।
২. এভ্রি গ্রেইন অব স্যান্ড
৩. অল অ্যালং দ্য ওয়াচ টাওয়ার
৪. সাবটেরানিয়ান হোমসিক ব্লুজ
৫. ভিশন অব জোহানা
৬. এ হার্ড রেইন’স আ-গনা ফল
৭. ট্যাঙ্গেলড আপ ইন ব্লু
৮. ইট’স অলরাইট মা, ( আই অ্যাম অনলি ব্লিডিং
৯. লাইক এ রোলিং স্টোন
১০. ব্লোয়িন’ ইন দ্য উইন্ড
বব ডিলানের কবিতা
গানের পাশাপাশি কবিতা লেখায় সমান ভাবে প্রতিভাবান বব ডিলান। তাঁর লেখায় স্যামুয়েল টেইলর কোলেরিজ এবং উইলিয়াম ব্লেইক এর মত রোমান্টিক কবিদের প্রভাব লক্ষণীয়। ডিলানের কবিতায় প্রেম আছে, ধর্ম আছে, আছে প্রতিবাদ। গানেই তাঁর কবিতা, কবিতার মাঝেই গান। গানের মধ্য দিয়ে কাব্য সাহিত্যে অতুলনীয় অবদান রাখার জন্য এই কিংবদন্তী নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর। ঔপন্যাসিক টনি মরিসনের পর তিনি প্রথম আমেরিকান যিনি এই সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তাঁর লেখা বেশ কিছু বই ছাপা হয়েছে- গদ্য কবিতার বই টরেনটুলা, স্মৃতিকথা ক্রনিকেলসঃ ভলিউম ১, গানের লিরিকের উপর কয়েকটি বই, এবং নিজের চিত্রকর্মের কিছু বই।
বর্তমানে বব ডিলান
২০০৬ সালে ডিলান মডার্ন টাইমস নামে স্টুডিও অ্যালবাম বের করেন। আগস্টের শেষে বের হওয়ার পর পরের মাসে টপ অ্যালবাম চার্টের শীর্ষে ছিল অ্যালবামটি। ২০০৯ সালের এপ্রিলে তিনি প্রকাশ করেন টুগেদার থ্রু লাইফ। ২০১০ সালে বের করেন অ্যালবাম উইটমার্ক ডেমোস, বব ডিলানঃ দ্য অরিজিনাল মোনো রেকর্ডিংস।
২০১১ সালে প্রকাশিত হয় বব ডিলান ইন কনসার্ট- ব্র্যান্ডিস ইউনিভার্সিটি ১৯৬৩ নামের আরেকটি লাইভ অ্যালবাম। ২০১২ সালে চালু করেন নিজের নতুন স্টুডিও টেম্পেস্ট। ২০১৫ সালে কভার অ্যালবাম শ্যাডোস ইন দ্য নাইট বের করেন। তার এক বছর পর ২০১৬ সালে ডিলান তাঁর ৩৭ তম স্টুডিও অ্যালবাম ফলেন এঞ্জেল বের করেন। নোবেলের পাশাপাশি গ্র্যামি, গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছ থেকে সন্মানসূচক প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এ ভূষিত হন বব ডিলান।
order terbinafine 250mg generic – buy lamisil purchase griseofulvin
semaglutide ca – buy desmopressin online cheap order DDAVP