প্রায় আড়াই ঘন্টা কোনোরূপে পাড়ি দিলাম, যা দেখছিলাম সব-ই আশ-পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। সিকুয়েন্সগুলো শুধু চোখকে বিনোদিত করছে । সিনেমার প্রথম ১০মিনিট দেখার পর মনে হচ্ছিলো হয়তো ভুলবশত ন্যাশনাল জিওগ্রাফির কোনো ডকুমেন্টারি ডাউনলোড করে ফেলেছি , ১৯মিনিটের মাথায় যখন এপস’দের নিক্ষিপ্ত হাড় বিশাল স্পেসশিপে রূপান্তরিত হলো তখন ভুল ভাঙলো । “আইএমডিবি’তে ঈর্ষনীয় স্থানে সিনেমাটির অবস্থান ” শুধুমাত্র এই কথাটি মাথায় ঘুর-পাক খাচ্ছিলো, এই কথার জোরের আড়াই ঘন্টা বসেছিলাম, আড়াই ঘন্টা পর একরাশ হতাশা সৃষ্টি হলো, হতাশার কারণ এই না যে আমার মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে গেলো, হতাশার কারণ, সিনেমাটি আত্মস্থ করতে না পারা । এরপর আরো কয়েকবার দেখলাম, ধীরে ধীরে কিছু বিষয় বুঝতে শুরু করলাম । তখন পর্যন্ত সিনেমাটি ভালো লাগেনি, শুধুমাত্র সিনেমাটি বোঝার খাতির দেখছি, কিন্তু কখন যে এই ভালো না লাগার ব্যাপারটি ভালো লাগতে শুরু করে দিলো বুঝতে পারলাম না ।

Source: GramUnion
দ্বিতীয় বার যখন সিনেমাটি দেখি তখন “নিক্ষিপ্ত হাড় বিশাল স্পেস-শিপে রূপান্তর” এই ব্যাপারটি মাথায় এক প্রকার আলোড়ন সৃষ্টি করলো, তখন বুঝলাম এটি শুধুমাত্র একটি সিনেমা না যা আমাদের চোখ আর মনের বিনোদনের জন্য নির্মিত , এটি একটি মহাকাব্য যা পরিচালক নির্মান করেছেন “বিবর্তনের উদ্দেশ্যে” । এই ব্যাপারটি নিয়ে পরে আলোচনা করছি ।

২০০১ আ স্পেস অডেসি, চলচ্চিত্র ইতিহাসের সব’চে দূর্বোধ্য সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম । সিনেমাটি নির্মাণ করা হয়েছে দূর্বোধ্য করে, দূর্বোধ্য নির্মাণের পেছনে কারণ একটা-ই, চিন্তা-চেতনার প্রসার । সিনেমার মাধ্যমে সমাজকে পরিবর্তন করা সম্ভব না, কিন্তু চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন সম্ভব, এবং তাই করে দেখিয়েছেন স্যার স্ট্যানলী কিউব্রিক ।
কিউব্রিক নিজেও কতোটা দূরদর্শী তারও প্রমাণ সিনেমার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে । এই সিনেমা নির্মানের এক বছর পর নীল আর্মস্টং তার দল-বল নিয়ে চাদে পাড়ি জমান, কিন্তু নীল আর্মস্টং-এর আগে কিউব্রিক চাদে পা রাখেন তার এই সিনেমার মাধ্যমে ।
সিনেমার দূর্বোধ্যতা নিয়ে যখন স্যার আর্থার ক্লার্কের কাছে জানতে চাওয়া হয় তখন তিনি বলেন- “If you understand ‘2001’ completely, we failed. We wanted to raise far more questions than we answered.” উনার উক্ত উক্তিতে একটা বিষয় ফুটে উঠেছে আর তা হলো, এই সিনেমাকে শুধু সিনেমা ভাবলে আপনি ভুলের মধ্যে ডুবে আছেন । “বিবর্তনের উদ্দেশ্যে”, নিয়ে সিনেমাটি নির্মিত, ঠিক কিরূপ “বিবর্তন” আনতে চেয়েছেন পরিচালক সেটা-ই মূখ্য । এখন ঐদিন শেষ যখন সিনেমা মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়া হতো । এখন সিনেমা দেখতে হলে আপনাকে ভাবতে হবে, আর সেই ভাবনার সূচনা ঘটিয়েছেন “স্ট্যানলী কিউব্রিক” । ২০০১ আ স্পেস অডিসি সিনেমাটি উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এটি আমাদের সবার-ই জানা, উপন্যাসে প্রতিটা বিষয় যেভাবে ক্লিয়ার করে বলা হয়েছে সিনেমায় তার ছিটে ফোটাও নেই, সিনেমায় যা আছে সব-ই মন্তাজে আবৃত । সিনেমার প্রতিটি সিকুয়েন্স-ই আপনাকে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করবে, বাধ্য করবে আপনাকে ভেতরে লুকায়িত রহস্যকে উন্মোচিত করতে ।

Source: legacy.wbur.org
ছোটবেলা থেকে কিউব্রিক মিউজিকের প্রতি আসক্ত ছিলেন, কলেজ জীবনে বিভিন্ন মিউজিক ব্যান্ডের সাথে জড়িতও ছিলেন, যদিও তিনি ছিলেন মূলত একজন ড্রামার । তার এই সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা ফুটিয়ে তুলেছেন আ স্পেস অডিসিতে । প্রতিটি দৃশ্যে মিউজিকের ব্যবহার-ই ছিলো দৃশ্যগুলোর প্রাণ , এমন শিহরণ সৃষ্টিকারী সুরের ব্যবহার খুব কম-ই দেখা যায় ।
অন্যত্র সিনেমার সেট ডিজাইন এতো-ই অসাধারণ হয়েছে যারা সিনেমাটি বুঝতে ব্যর্থ হয়ে তারা বলেছেন, কিউব্রিক সিনেমার নাম করে সেট বানানো শিখিয়ে দিয়েছেন । অসাধারণ সেট ডিজাইন সিনেমার অসাধারণত্বকে আরো দ্বিগুণ করে দিয়েছে ।
১৯৬৮ সালের ভিজুয়াল ইফেক্টসের সুরের সাহায্যে এমন সিনেমা নির্মাণ করে কিউব্রিক নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছেন । ২০০১ আ স্পেস অডিসি-এর সমপর্যায়ের সিনেমা নির্মান এখনকার পরিচালকদের শুধুমাত্র স্বপ্ন । সর্বকালের সেরা কল্পবিজ্ঞান সিনেমা এটি ।
স্পয়লার এলার্ট
এই ভাগে আলোচনা করা হবে সিনেমার দূর্বোধ্য বিষয় নিয়ে, যারা সিনেমা শেষ করে কনফিউশনে আক্রান্ত তাদের জন্য উক্ত আলোচনা । সিনেমাটি চারটি ভাগে/প্লটে সাজানো হয়েছে , যদিও প্রথম দেখায় মনে হয়েছিলো চারটি প্লট-ই ভিন্ন কিন্তু পরবর্তীতে বুঝতে পারলাম এই প্লটগুলো মধ্যে খুব যৌক্তিক সংযোগ রয়েছে ।
প্রথম ভাগের নামকরণ করা হয়েছে The Dawn of Man । মানুষ কিভাবে “সভ্য” হওয়া শুরু করলো তা বিভিন্ন সাইনের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে । একটি হাড়ের আঘাতে যখন আরেকটি হাড় ভেঙ্গে গেলো তখন সেই অসভ্য প্রাণী বুঝতে পারলো তারা এমন কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে যা তাদের অস্তিত্বতে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে । এক প্রকারে বিজয়ের উল্লাসে হাড়টি আকাশে ছুড়ে মারে যা স্পেস শিপে রূপে নেয়( রূপক অর্থে ) । এই পার্টে সিনেমার রাইটার পরোক্ষ ভাবে ডারউইনের বিবর্তনবাদ মতবাদের সাহায্য নিয়েছেন ।
দ্বিতীয় ভাগে দেখানো হয়েছে সভ্য মানুষ চাদে পাড়ি জমিয়েছে অজানাকে জানতে । অজানা ব্যাপারটি হলো চাদে অদ্ভুত কোনো বস্তুর সন্ধান পাওয়া গেছে, সেটি পর্যবেক্ষন করতে ।
তৃতীয় ভাগে দেখানো হয়েছে মানুষ চাঁদ থেকে জুপিটারের দিকে যাচ্ছে । এই ভাগে দেখানো হয়েছে মানুষ প্রযুক্তির শেকড় থেকে শিখরে পৌছে গেছে । যেখানে হ্যাল নামক সুপার কম্পিউটার তাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে ।
প্লট নং চার, Jupiter and Beyond the Infinite । জুপিটার থেকে ইনফিনিটির দিকে যাত্রা । সুপার-কম্পিউটার হ্যালের কাছ থেকে প্রতারিত হয়ে ডেভ পড নিয়ে বের হয়ে পড়ে, এমন সময় চারকোণাকৃতি কিছু একটা চোখে পরে ডেভের, এটিকে-ই অনুসরণ করতে করতে ওয়ার্ম হোলের সাহায্যে ডেভ চলে যায় অন্য একটি জগতে । এখানে ডেভ নিজেকে আবিষ্কার করে সুসজ্জিত কামরায় । যেখানে ডেভ নিজের যৌবন কাল এবং বার্ধক্য দেখতে পারে এবং পরিশেষে দেখা যায় ডেভ একটি পাথরস্তম্ভকে ইঙ্গিত করে দেখাচ্ছে এরপর দেখা যায় একটি ভ্রুন শিশু পৃথীবিকে প্রদক্ষিণ করছে ।

Source: Essays & Articles of Cinema – WordPress.com
এই চারটি প্লটকে একটি সুতোয় গাথা হয়েছে একটি মনোলিথ(পাথরস্তম্ভ)এর মাধ্যমে । এই মনোলিথ-ই হলো সিনেমার মূল চরিত্র । কিন্তু এই মূল চরিত্রের ব্যাখ্যা সিনেমায় কোথাও দেওয়া হয়নি । এখানে-ই পরিচালক সবাইকে ভাবতে বাধ্য করেছেন, যে যেভাবে পেরেছেন যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছেন ।
এই মনোলিথকে পরিচালক উপস্থাপন করেছেন একটি “সত্তা” হিসেবে, যার আছে অসীম ক্ষমতা , এই ক্ষমতা বলে-ই সে পদে পদে সাহায্য করেছে পৃথীবির সবচে বুদ্ধিমান প্রানীকে । (প্রথম প্লট অনুযায়ি) মনোলিথটি পৃথীবিতে আবির্ভূত হয় আর চিন্তা-শক্তি প্রদান করে সেই এপস’দের, যার ফলাফল আমরা পরের সিকুয়েন্সে-ই দেখতে পাই ।
এরপর আবার মানুষ আটকে যায়(দ্বিতীয় প্লটে) চাদে, যেখানে তারা সেই মনোলিথকে আবিষ্কার করে, কিন্তু কোনো কূল-কিনারা করতে পারে না, যে এটি কোথা থেকে এসেছে । এখানেও সেই মনোলিথ তাদের সাহায্য করে, যার ফলাফল আমরা দেখতে পাই তৃতীয় প্লটে যেখান মানুষ জুপিটারের দিকে ছুটে চলছে ।
এই ছিলো মনোলিথের ব্যাখ্যা ।
কিন্তু শেষের ঐ স্থান-কাল-সময় ভেদী যাত্রার মানে কি ? আর শেষের ঐ ভ্রুন-শিশুর ব্যাখ্যা-ই বা কি ?
এখানেও ঐ মনোলিথ জড়িত । চতুর্থ প্লটে আমরা দেখতে পাই, ডেভ সেই মনোলিথকে অনুসরন করতে করতে নিজেকে আবিষ্কার করে একটি রুমে, যার কোনো দরজা ছিলো না । আপেক্ষিক দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে সেই রুমে কোনো দরজা নেই কিন্তু একটু গভীর ভাবে ভাবলে আমরা দরজার সন্ধান পেয়ে যাবো । সেই রুমের দরজা মনোলিথ নিজে-ই । এই রুমে দেখা যায় ডেভ নিজের জীবনচক্রের দুটি ধাপ দেখতে পায় , যৌবন-বার্ধক্য । ডেভ দেখতে পায় মৃতপ্রায় একজন ডেভ বিছানায় শুয়ে আছে আর ঐ মনোলিথের দিকে আঙ্গুল তাক করে আছে । এই ব্যাপারটি একটু বেশি ঘোলাটে, কেন মৃতাবস্থায় ডেভ এরূপ আচরণ করলো ।
এই মনোলিথের ব্যাপারটি ডেভ প্রথমে জানতে পারে জুপিটারে যাত্রাকালীন অবস্থায়, এরপর যখন ডেভ মনোলিথকে অনুসরণ করতে করতে এই অবস্থায় এসে পৌছায় তখন বুঝতে পারে এর সবকিছুর পেছনে এই মনোলিথের হাত রয়েছে । যদিও এর আগে একটি দৃশ্যে দেখা যায় বৃদ্ধ ডেভ যখন খাবার খাচ্ছিলো তখন তার হাত থেকে পানি ভর্তি গ্লাস মেঝেতে পড়ে যায়, এই দৃশ্যটি পরিচালক সিনেমা দীর্ঘায়িত করার জন্য চিত্রায়িত করেননি এর পেছনে একটি কারণ রয়েছে , এখানে গ্লাস আর গ্লাসের ভেতরের পানিকে সিম্বোলিক অর্থে দেখানো হয়েছে, এখানে গ্লাস হচ্ছে একজন মানুষ আর গ্লাসের পানি হচ্ছে মানুষ মধ্যে লুকায়িত জ্ঞান/চিন্তা-চেতনা ।
এরপরে একটি দৃশ্যে দেখা যায় বৃদ্ধ ডেভ একটি ভ্রুনে পরিনত হয়ে পৃথীবি প্রদক্ষিণ করছে, এই দৃশ্যের সহজতর ব্যাখ্যা হচ্ছে মানবজাতির একটি নতুন প্রজন্ম পৃথীবি পেতে যাচ্ছে, যা পূর্বের মানুষ জাতি থেকে অনেক বেশি এডভান্স ।

Source: Time
এই ছিলো আপাত দৃষ্টিকোণ থেকে সিনেমার বিশ্লেষন, যারা সিনেমাটি দেখে কিছু বুঝতে পারেননি বা কিছু প্লট নিয়ে কনফিউজড, তাদের জন্য কিছুটা হলেও হেল্প হবে, পুরোপুরি বুঝতে হলে আপনাকে সিনেমাটি আরো কয়েকবার দেখতে হবে এবং দেখার পর ভাবতে হবে ।
প্রথম প্রিমিয়ারের দিন সিনেমাটি বোধগম্য না হওয়ায় প্রায় ২৫০জন দর্শক সিট ছেড়ে উঠে গেছেন, এতে বিন্দুমাত্র দুঃখ প্রকাশ করেনি কুবরিক, কারণ তিনি জানেন আজ না হোক কাল তার নির্মানের মূল্যায়ন একদিন সবাই করবে । ১৯৬৮ সালে এমন-ই মাল্টি-ভিউ সিনেমা নির্মিত হয়েছে যা এখনও দর্শককে ভাবায়, আশা করি এটি নিয়া দর্শক আরো কয়েক দশক ভাববে , উন্মোচিত হবে এর গভীরে লুকিয়ে থাকা আরো হাজারো রহস্য ।