স্বাধীন কুর্দিস্তান আন্দোলন: কুর্দিদের স্বপ্নের রাষ্ট্র বাস্তবায়ন সম্ভব?

2

আধুনিক বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র মূলত জাতিরাষ্ট্র যেখানে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হল জাতীয়তাবাদ। তবে এখনও অনেক জাতি রয়েছে যাদের ভাষা,সংস্কৃতি,নিজস্ব ইতিহাস ও জাতীয়তাবাদী চেতনা থাকার পরও শুধু কপাল দোষেই তাদের কপালে স্বাধীনতার স্বাদ জোটেনি। কুর্দি জাতি এদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কুর্দি জাতিই সম্ভবত সবচাইতে বড় জাতি যারা নিজেদের বিশাল জনগোষ্ঠী ও ভূমি নিয়েও অন্যের অধীনে পরাধীন হয়ে আছে।পৃথিবীতে যে সকল জাতি বা জনগোষ্ঠী নিজেদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে কুর্দি জাতিগোষ্ঠী তাদের মধ্যে অন্যতম। এই বৃহৎ জাতি গোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে বিভক্ত করে রাখা হয়েছে। ফলে তারা একত্র হয়ে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে না পারলেও বিচ্ছিন্নভাবেই তারা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ইরাকের কুর্দিরা তাদের অধিকার আদায়ে অধিক সোচ্চার এমনকি তারা অন্যদের চাইতে অধিক সুসংগঠিত।

কুর্দিস্তানের পরিচয়ঃ

কুর্দিস্তান হল মধ্যপ্রাচ্যের একটি অঞ্চল। এই অঞ্চলে যারা বসবাস করে তাদের কে কুর্দি বলা হয়। কুর্দিরা প্রায় সবাই কুর্দি ভাষায় কথা বলে।কিন্তু কুর্দিদের এই অঞ্চলটি এখন আর তাদের নিজেদের অধীনে নেই।কুর্দিদের বিশাল অঞ্চলটি তাদের পার্শ্ববর্তী প্রধানত চারটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে গেছে। এই অঞ্চল সমূহ হল ইরাক,ইরান,তুরস্ক ও সিরিয়া। অর্থাৎ এই চারটি অঞ্চলের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যাওয়া কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলকেই কুর্দিস্তান বলা হয়। আধুনিক কালে কুর্দিস্তান বলতে তুরস্কের পূর্বের কিছু অংশ, ইরাকের উত্তরের অংশ,ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও সিরিয়ার উত্তরে কিছু অংশকে বুঝায়। যদিও আবার এসব বিভক্ত কুর্দিদের নিজেদের মধ্যেই অন্তর্দ্বন্দ্ব বিদ্যমান।

কুর্দিস্তানের অবস্থান
কুর্দিস্তানের অবস্থান
Source: wikimedia

কুর্দিদের পূর্ব ইতিহাসঃ

আজকের ছিন্নবিচ্ছিন্ন তুর্কি জাতির পিছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে কুর্দিরা আজকের এই শোচনীয় অবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে। কুর্দিদের ইতিহাস বেশ পুরনো। সর্বপ্রথম ১২শ শতকে সেলজুক সুলতান সাঞ্জার কুর্দিস্তান নামটি সরকারীভাবে ব্যবহার করেন। তিনি এই কুর্দিস্তানকে একটি প্রদেশের মর্যাদা প্রদান করেন এবং এর রাজধানী নির্ধারণ করেন বাহার শহরকে।সেলজুকদের পর এই অঞ্চলের ক্ষমতা চলে যায় অটোমানদের হাতে। অটোমানরা দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে তাদের শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করেন।এই সময়ে কুর্দিদের স্বাধীন হবার কোন সুযোগ ছিল না। কেননা তৎকালীন সময়ে অটোমানরা তাদের দক্ষ সৈন্যবাহিনী দিয়ে তাদের বিশাল সাম্রাজ্যকে কঠোর হাতে শাসন করত।ফলে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত ক্ষমতা কুর্দিদের ছিল না।

১৯২০ সালের পর যখন অটোমান সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক পতন শুরু হয় তখন অন্যান্যদের মত কুর্দিরাও তাদের স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার হয়ে উঠে। শুরুর দিকে তুর্কিদের সাথে পশ্চিমাদের সেভরা চুক্তির খসড়াতে কুর্দিদের স্বাধীনতার জন্য গণভোটের উল্লেখ ছিল। কিন্তু এই চুক্তি ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে ১৯২৩ সালে লুসান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ককে স্বাধীনতা দেয়া হয় এবং এই চুক্তির মাধ্যমে কুর্দিদের গণভোটের বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করা হয়। ফলে এর সাথে সাথে কুর্দিদের স্বাধীনতার প্রশ্নও চাপা পড়ে যায়। এর পর ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কুর্দিস্তান কে তাদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের (ইরাক,ইরান,তুরস্ক ও সিরিয়া) মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়।     

বিভক্ত কুর্দিদের অবস্থাঃ

কুর্দিরা প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ হয়ে যাবার পর থেকে তারা আর একক কুর্দি জাতি সত্তার পরিচয় বহন করতে পারছে না। তাদের কে আজ আলাদা আলাদা পরিচয়ে পরিচিত হতে হচ্ছে। যারা তুরস্কে আছে তাদেরকে তুর্কি কুর্দি,যারা ইরাকে আছে তাদেরকে ইরাকি কুর্দি, যারা ইরানে আছে তাদের কে ইরানী কুর্দি ও যারা সিরিয়া তে আছে তাদেরকে সিরীয় কুর্দি পরিচয় নিয়ে ঘুরতে হয়। তাদের অবস্থাও ভিন্ন ভিন্ন।

প্রথমেই আসা যাক তুর্কি কুর্দিদের প্রশ্নে, ১৯২৩ সালে কুর্দিরা বিভক্ত হবার পর সবচেয়ে বেশি কুর্দিদের ঠাই হয় তুর্কিতে। বর্তমানে তুরস্কের মোট জনসংখ্যার ২০% কুর্দি জনগণ। কিন্তু শুরু থেকেই তুর্কিরা কুর্দিদের আলাদা ভাষা,সংস্কৃতি কে কঠোর হস্তে দমন করার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠে। এমনকি জোর করে তাদের কুর্দি পরিচয়ের স্থলে তুর্কি পরিচয়কে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালানো হয়। এমনকি কুর্দিদের ভাষাকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত কুর্দিদের মাতৃভাষা তুরস্কে নিষিদ্ধ ছিল। এই সময়ে কুর্দিরাও বসে ছিল না। ১৯২৩ সালের পর থেকে স্বাধীন কুর্দি প্রতিষ্ঠার দাবীতে কুর্দিরা বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ করে কিন্তু তুর্কি শাসকরা তা কঠোর হাতে দমন করে।

কুর্দি ও তুর্কি সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ,
কুর্দি ও তুর্কি সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ
Source: .banglanews24.

১৯৭৮ সালে কুর্দিরা পৃথক রাষ্ট্রের দাবীতে গড়ে তোলে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি(পিকেকে)। ফলে স্বাধীনতার দাবীতে কুর্দিরা নতুন ভাবে বিদ্রোহ শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৮৪ সালে তুর্কিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করে এতে প্রায় ৪০ হাজার লোকের প্রাণহানি হয়।কিন্তু তাদের এই বিপ্লব ব্যর্থ হয়। ফলে তুর্কিরা কৌশলে পিকেকে কে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়ে দেয়।সর্বশেষ ২০১৫ সালে আই এস দের সাথে কুর্দিদের হতাহতের বিষয় কে কেন্দ্র করে তুরস্কের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে কুর্দিদের সম্পর্ক আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ফলে তুর্কি সরকার আই এস ও পিকেকের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান ঘোষণা করে। এতে প্রায় কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়। এটি ছিল মূলত কুর্দিদের দমিয়ে রাখার জন্য এক ধরনের কৌশল।

ইরাকি কুর্দিদের অবস্থা অন্যদের তুলনায় অনেকটা ভাল। এই ভাল হওয়ার পিছনে তাদেরকে লড়াই সংগ্রামও করতে হয়েছে সবচাইতে বেশি।১৯২৩ সালে তারা ইরাকীদের অধীনে যাওয়ার পর থেকেই তারা তাদের অধিকার আদায়ে অধিক সোচ্চার ছিল। ১৯৪৬ সালে কুর্দিরা ইরাকের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসন লাভের জন্য বারজানীর নেতৃত্বে কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি(কেডিপি) গড়ে তোলে। তাদের আন্দোলনের মুখেই ইরাকী সরকার কুর্দিদের নাগরিকত্ব দান করতে সম্মত হয়। পরবর্তীতে নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে সাদ্দামের যুগে প্রবেশ করে

সাদ্দামের সাথেও তাদের বিরোধ বাধে। ফলে ইরান-ইরাক যুদ্ধে কুর্দিরা ইরান কে সমর্থন দেয় এতে সাদ্দাম ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের উপর দমন পীড়ন শুরু করে এতে প্রায় ৫০ হাজারের অধিক কুর্দি নিহত হয়।সর্বশেষ ১৯৯১ সালে তারা তাদের বহুল প্রতীক্ষিত স্বায়ত্তশাসন লাভ করে।এরপরই তাদের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য নতুন করে সোচ্চার হয়ে যায়। যার ফলে সর্বশেষ ২০১৭ সালে কুর্দিস্তানে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট হয় এই গণভোটে ৯২% কুর্দিরা স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয় কিন্তু ইরাকী কেন্দ্রীয় সরকার এই গণভোটকে অবৈধ বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং তুরস্কও গণভোটের বিপক্ষে কথা বলেন।ফলে বর্তমানে ইরাকী তুর্কিদের স্বাধীনতার প্রশ্নও আটকে গেছে।

কুর্দিস্তান আন্দোলন
কুর্দিস্তান আন্দোলন

সিরিয়াতে মোট ১০% এর কাছাকাছি কুর্দি জনগণ রয়েছে। এদের সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষের মত। সিরিয়ার অধীনে যাওয়ার পর থেকে তাদের কে জোর করে আরবীয়করন করার চেষ্টা চলছে। সিরিয় সরকার সবসময় তাদের উপর কুর্দির স্থলে আরবী কে প্রাধান্য দেয়। ১৯৬০ সালের পর থেকে সিরিয়াতে কুর্দিদের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠেছে তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা তাদের অধিকার আদায় করতে পারছে না। তার উপরে বাশার আল আসাদ ক্ষমতায় আসার পর সেখানে আইএস জঙ্গি-গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছে। ফলে তাদের উপর একদিকে যেমন আসাদ সরকারের দমন পীড়ন রয়েছে সাথে আইএসদের  মোকাবেলা করতে হয় তাই সিরিয়ার কুর্দিরা রয়েছে সবচাইতে খারাপ অবস্থায়। এমনকি তাদের স্বাধীনতা লাভের আশা একেবারে নেই বললেই চলে।

ইরানের কুর্দিদের অবস্থাও একই। ইরান যেহেতু শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চল তাই সুন্নি কুর্দিরা এখানে উপযুক্ত মর্যাদা পাবে না এটাই স্বাভাবিক হিসেবে ধরতে হবে। বাস্তবতাও তাইইরান সর্বদা কুর্দিদের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখে। তাদের দাবী দাওয়া কঠোর হাতে দমন করে । ফলে ইরানে কুর্দিরা শোষণ আর বঞ্চনার প্রতীক হয়েই আছে।

কুর্দিদের ভবিষ্যৎঃ

এত আলোচনার পরেও প্রশ্ন থেকে যায় এই অঞ্চলের কুর্দিদের ভবিষ্যৎ কী ? আগামীতে কি হবে তাদের ভাগ্যে? তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে তা জানতে হলে কিছুটা পিছনে ফিরে তাকানো দরকার। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ইরাকের গণভোটের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে ইরাকের ৯২ ভাগ কুর্দি নাগরিক নিজেদের স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেবার পরও তাদের স্বাধীনতা আটকে গেছে।এসময় তাদের পিছনে পশ্চিমাদের সমর্থন থাকলেও তাদের পার্শ্ববর্তী সকল রাষ্ট্র তাদের এই গণভোটকে প্রত্যাখ্যান করে। তার উপরে তুর্কি ও ইরান সরাসরি এই অঞ্চলে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম নিতে পারেনা বলে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে। আর তারা ইরাকি কুর্দি রাষ্ট্রের বিরোধিতা করার কারণ হল তারা জানে যে ইরাকের কুর্দিরা স্বাধীনতা অর্জন করে ফেললে তাদের নিজের দেশের কুর্দিদের দমিয়ে রাখা যাবে না। তাই তারা বরাবরই কুর্দিদের স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করে আসছে  । আর ইরাকও কখনো কুর্দি অধ্যুষিত তেল সমৃদ্ধ অঞ্চলটি হাতছাড়া করতে চাইবে না। আর তুর্কি ও ইরানের কুর্দিরা তো মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগই পাচ্ছে না। সুতরাং তাদের স্বাধীনতার প্রশ্ন এখন অনেক দূরে। তাই সহজে বলা যাচ্ছে যে কুর্দিরা অচিরেই স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে না।

সিরিয় কুর্দিদের উপর বিমান হামলা
সিরিয় কুর্দিদের উপর বিমান হামলা
Source: .banglagazette

সুন্নি মতাদর্শ লালন-কারী কুর্দিরা সকলদিক দিয়ে আজ শোষিত বঞ্চিত। তাদের এই শোষণ বঞ্চনার সুযোগ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে পশ্চিমা ও ইজরায়েল তাদের কে নিজেদের প্রয়োজনে এ-অঞ্চলে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। যা আবার এই অঞ্চলের শান্তি বিনষ্টের মত কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে কুর্দিদের উপর যে সব অঞ্চলেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের মত ব্যাপার ঘটছে তা আজ আর অস্বীকার করা যায় না।তাই সকল শান্তিপ্রিয় মানুষ মাত্রই আশা থাকবে যে কুর্দিদের উপর যে অন্যায় অত্যাচার হচ্ছে তা যেন অচিরেই বন্ধ হয়। একই সাথে তাদের নিয়ে ইজরাইল ও পশ্চিমাদের যে গোপন পরিকল্পনা তারও যেন অবসান ঘটে।

Source Feature Image
Leave A Reply
2 Comments
  1. Hqjhdt says

    purchase lamisil generic – buy forcan pills griseofulvin drug

  2. Lgvxjr says

    order metformin – metformin 1000mg pill buy acarbose pills for sale

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More