খলিফা হারুন অর রশিদ: আরব্যোপন্যাসের নায়কের গল্প
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। চাঁদ এখন যৌবন কাল শেষ করে বয়োবৃদ্ধ হওয়ার দিকে তাই সন্ধ্যারাতেই আলোর বিচ্ছুরণ শুরু করে না,রাত ঘনীভূত হবার পর তার আলোর কার্যকারিতা শুরু হয়। তাই কিছুদূরে বাচ্চাদের কান্নার শব্দ শোনা গেলেও অবস্থান নির্ণয় করা সহজ হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে সামনের দিকে আগাতে হল। যারা এগিয়ে যাচ্ছে সংখ্যা দুইজন হলেও দূর থেকে আরও বেশ কয়েকজন তাঁদের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। বেশ কিছু বালুময় বিস্তৃর্ণ পথ পাড়ি দেবার পর কান্নার আওয়াজ যে দিক থেকে আসছে ঠিক সেদিকেই নিভুনিভু আগুনের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। সুতরাং আরও কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে তাদের নিকটে অথচ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শিশুদের কান্না এবং ওখানে আগুন দিয়ে কি করা হচ্ছে তার পর্যবেক্ষণ চলছে। প্রথম দর্শনে দেখা গেল একজন ভদ্র মহিলা চুলায় কিছু রান্না করছে এবং তার পাশে দুইজন শিশু খাবারের জন্য কান্না করছে যদিও মহিলাটি বাচ্চাদের অতিশীঘ্রই খাবার দেবার আশ্বাস দিচ্ছে। এভাবে বেশকিছু সময় অতিবাহিত হল। দুইজন আগন্তুক ঠায় দাঁড়িয়ে এসব চিত্র দেখে যাচ্ছে। একজন আগন্তুকের বয়স খানিকটা বেশী হলেও অপরজন ছিল পাক্কা যুবক। এসব চিত্র দেখার ফাঁকেফাঁকে আগন্তুক-দ্বয় নিজেদের মধ্যে কিছু ছোট ছোট আলাপও করছে । এরই মধ্যে চাঁদও আলো ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে, সবকিছু আরও স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও যখন দেখা গেল মহিলা বাচ্চাদের কে যে স্বল্প সময়ের আশ্বাস দিচ্ছে তা শেষ হচ্ছে না। তখন আগন্তুক দুইজন মহিলার দিকে এগিয়ে গেল এবং জিজ্ঞেস করল বাচ্চাদের এভাবে কান্নার প্রকৃত কারণ কি। তখন মহিলা অত্যন্ত অসহায়তার সাথে বলতে লাগল- এই দুই বাচ্চা আমার সন্তান, আমার স্বামী যুদ্ধে শহিদ, আমি সারাদিন চেষ্টা করেও তাদের জন্য কোন খাদ্য সংগ্রহ করতে পারিনি। তাই তাদের সান্ত্বনা দেবার জন্য পাতিলের মধ্যে পাথর সিদ্ধ করছি এবং অপেক্ষা করছি কখন তারা কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। তখন আগন্তুক লোকদের মধ্যে প্রথম-জন খুব মর্মাহত হলেন এবং পাশের যুবককে তাদের খাবারের জন্য নিজ কাঁধে করে আটা এবং খেজুর নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। যেই কথা সেই কাজ। অল্প সময়ের মধ্যে খাদ্য নিয়ে ফিরে এলেন যুবক। এর অল্প সময় পরই মহিলা জানতে পারল তার জন্য খাদ্য বহন করে নিয়ে আসা ব্যক্তিই খলিফা হারুন অর রশিদ ।
হারুন অর রশিদের পরিচয়:
ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত চরিত্র হারুন অর রশিদ ৭৬৬ সালের ২৪শে মার্চ আব্বাসী খিলাফতের অধীনস্থ রাই নামক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল আল মাহদী ও মাতার নাম খাইজুরান। বাল্যকালে তিনি ইয়াহিয়া বর্মাকের নিকট বিদ্যা শিক্ষা লাভ করেন এবং ইয়াহিয়ার মতই একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি হিসেবে পরিণত হন। ৭৮৬ সালে হাদির মৃত্যুর পর আব্বাসী বংশের ৫ম শাসক হিসেবে ২০ বছর বয়সে খিলাফতের মসনদে আরোহণ করেন তিনি। দক্ষতার সাথে দীর্ঘদিন শাসন করার পর ৮০৯ সালে তুস নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তার তিন ছেলেকে রেখে যান। তারা ছিল আমিন,মাপুন ও মুতা-সিম। তার ইচ্ছা অনুযায়ী পরবর্তী শাসক হিসেবে মনোনীত হয় তার ছেলে আমিন। হারুন অর রশিদের শাসনকালে বিজ্ঞান,ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির জন্য তার শাসনকালকে আব্বাসী খিলাফতের স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে ।
হারুন অর রশিদের রাজনৈতিক সাফল্য:
হারুন অর রশিদ আব্বাসী খিলাফতের মসনদে আরোহণ করার অল্পকাল সময়ের মধ্যেই খারেজীরা বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। প্রথমে মসুলে এই বিদ্রোহ দেখা দিলেও পরবর্তীতে তা আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানে ছড়িয়ে পড়ে। এসব অঞ্চলে খারেজীদের কে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আল ওয়ালিদ, হারুন অর রশিদ প্রথমে তাকে হত্যা করে দমন করলেও তার আরেক নারী উত্তরাধিকারী হিসেবে লায়লা নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। লায়লা নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর এই আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে এবং আরব ইতিহাসে জোয়ান অব আর্ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পাশাপাশি ইরাক পর্যন্ত এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। খারেজীদের এই তীব্র আন্দোলন দমন করার জন্য খলিফা কঠোর নীতি গ্রহণ করেন এবং খারেজিদের পরাজিত করে লায়লাকে স্বাভাবিক নারীসুলভ জীবনে ফিরে যেতে সুযোগ প্রদান করেন। এতে খারেজী আন্দোলন দমন করা হয় এবং হারুন অর রশিদ রাজনৈতিক সাফল্য লাভ করেন।
বাইজানটাইনদের সাথে আল মাহদীর সময় হতেই আব্বাসীদের বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। তখনকার সময়ে হারুন বাইজানটাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সফলতা লাভ করার জন্যই রশিদ উপাধি লাভ করেন। হারুন অর রশিদ ক্ষমতা লাভ করার পরও এই বিরোধ বর্তমান থাকে। ফলে তার শাসনের শুরুর দিকে ৭৯১ সালে বাইজানটাইন শাসক আইরিনের সাথে বিরোধ দেখা দিলে হারুন সফলতা লাভ করেন এবং বাইজানটাইনরা কর প্রদানের শর্তে চুক্তি করে। কিন্তু বাইজানটাইনদের শাসনক্ষমতা পরিবর্তন হবার পর নাইসেফোরাস ক্ষমতায় এসে পূর্বের কর দানের চুক্তি অস্বীকার ও আব্বাসীদের বিরোধিতা শুরু করে। তাকে সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য খলিফা নাইসেফোরাসের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন এতে নাইসেফোরাস ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ৮০৮ সালে আবার বিদ্রোহ করলে আবারও তাকে পরাজিত করেন রশিদ। ঐতিহাসিকদের মতে শুধু এরকম চুক্তি ভঙ্গ দুইবারই হয়নি বরং হারুন অর রশিদের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বেশ কয়েকবার এরকম ঘটনা ঘটেছে কিন্তু বার বারই হারুন অর রশিদ জয় লাভ করে তার বীরত্ব প্রমাণ করেছেন।
হারুন অর রশিদের শাসনকালে অন্যতম ঘটনা হল আফ্রিকায় বিদ্রোহ দমন। হারুন অর রশিদ ক্ষমতায় আরোহণ করার পর পরই আফ্রিকায় বিদ্রোহ দেখা দেয়। সেখানে বিদ্রোহ দমন করার জন্য হারসামা কে প্রেরণ করেন। হারসামার অসাধারণ রণনৈপুণ্যে সেখানে বিদ্রোহ দমন করে এবং ইব্রাহিম ইবনে আগলাব কে সেখানকার শাসক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এর পরবর্তীতে সেখানে বংশানুক্রিমভাবে আগলাবি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবেই আব্বাসী খিলাফতকে সুসংহত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে শাসনকে কণ্টক-মুক্ত করে এবং রাজনৈতিক সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করেন ।
হারুন অর রশিদের অবদান:
ইসলামের ইতিহাস তথা আরব বিশ্বের ইতিহাসে একজন শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে হারুন অর রশিদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। তিনি যেমন ছিলেন সমরকৌশলী তেমনি প্রজারঞ্জক শাসকও। তিনি রাতের আঁধারে সমস্ত সাম্রাজ্য ঘুরে ঘুরে প্রজাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন। তার এই প্রজাহৈতেষী গুন নিয়ে বহু আরব্য উপন্যাস-গল্পগাঁথা রচিত হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য অবদান সমূহ হল ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি,গরিবদুঃখীদের জন্য সরাইখানা চালু করা,যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নতুন নতুন মসজিদ -মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা।
তার সময়ে নৌযোগাযোগ উন্নত হবার কারণে সুদূর ইউরোপের সাথে আব্বাসী খিলাফতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তার শাসনাধীন এলাকায় ব্যবসায়ীদের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয় এবং ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা প্রধান করা হয়। ফলে ব্যবসা ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়। তার আমলে অন্যতম একটি আমূল পরিবর্তনকারী ঘটনা হল “আল বিমারিস্তান” নামক চিকিৎসালয় স্থাপন। এটি ছিল বৃহৎ আকারের একটি চিকিৎসালয় যেখানে মুসলিম বিশ্বের নামকরা সব চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা সেখানে সেবা প্রদান ও গবেষণা কাজে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে “আল রাজি” ছিলেন অন্যতম। এই চিকিৎসালয় আব্বাসী খেলাফতের বাসিন্দাদের জন্য ভূস্বর্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।
তার সময়ে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী সমূহ হল আরবদের পানির কষ্ট লাঘব করার জন্য ১০ লক্ষ দিনার ব্যয়ে নির্মিত “নাহরে যুবাইদা”। আব্দুল্লাহ বিন ইদ্রিস,শফি,আসমায়ী,আব্দুল্লাহ বিন নোয়াস প্রভৃতি জ্ঞানীগুণী ও কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা দান এবং ইব্রাহিম মসুলীর মত বিখ্যাত গায়কদের নিজ দরবারে আশ্রয় প্রদান করা।
ধর্মীয় বিচারে হারুন অর রশিদ:
হারুন অর রশিদ শুধু একজন দক্ষ প্রজাহৈতেষী শাসকই ছিলেন না বরং মনে প্রাণে একজন খাটি মুসলমানও ছিলেন। তিনি ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক জীবনেও ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য একনিষ্ঠ-ভাবে কাজ করে গিয়েছেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি যে একজন ধার্মিক ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কেননা তিনি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ ও সুন্নত নামাজ ছাড়াও দৈনিক একশত রাকাত নফল নামাজ আদায় করতেন। তিনি তার জীবদ্দশায় সর্বমোট নয় বার হজ্জ পালন করেছেন। তিনি যে বছর যুদ্ধ বিগ্রহের জন্য হজ্জ পালন করতে অক্ষম হতেন সে বছর তিনি নিজ খরচে তিনশত জনকে হজ্জ করাতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন তিনি কিভাবে তার প্রজাদের শাসন করছেন তার জন্য আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতা করতে হবে। তাই তিনি শাসন পরিচালনায় কুরান শরিফকে অনুসরণ করতেন এবং ইসলাম ধর্মভিত্তিক শাসন কার্য পরিচালনা করতেন। হারুন অর রশিদ ছিলেন হানাফি সুন্নি মুসলমান। ইমাম আবু হানিফা হানিফা মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা হলেও তার সময়েই এটি ব্যাপক প্রসারতা লাভ করে। কারণ তার পৃষ্ঠপোষকতায় আবু ইউসুফ নামক এক ব্যক্তি হানাফি মতকে উচ্চ অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। তাছাড়াও তিনি মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে হানাফি মাজহাবের পাঠ শিক্ষা দেয়া হত। তার পৃষ্ঠপোষকতা বহু ইসলামী গ্রন্থ আরবীতে অনূদিত হয় ও ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।
হারুন অর রশিদ শুধু একজন ধর্মীয় শাসকই ছিলেন না বরং সমগ্র বিশ্ব ইতিহাসে একজন শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে নিজের অবস্থান সুসংহত করেছেন। তার নৈশভ্রমন ও মানব কল্যাণের স্তুতি নিয়ে বহু আরব্য উপন্যাস রচিত হয়েছে। যাতে তার প্রশংসা কীর্তি,ধার্মিকতা ও মানব কল্যানের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তবে কোন কোন ঐতিহাসিক এসব উপন্যাস-সাহিত্যকে বাস্তবতার অতিরঞ্জন বলে অভিহিত করেছেন। তবে তার সম্পর্কে গল্প উপন্যাস সত্য বা বাস্তবতা বিবর্জিত যাই হোক না কেন তিনি যে একজন শ্রেষ্ঠ শাসক তাতে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন মতপার্থক্য নাই। তার প্রশাসনিক দক্ষতার কারণেই আব্বাসী খিলাফতের শাসন দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর এই ভিত্তির উপর দাড়িয়েই তার পরবর্তীতে আব্বাসী খিলাফত দীর্ঘদিন শাসন ক্ষমতায় টিকে ছিল। হারুন অর রশিদের অন্যতম উত্তরাধিকারী আল মামুন হাত ধরে তা আরো সুসংগঠিত হয়। এসব কৃতিত্বের দাবিদার হিসেবে হারুন অর রশিদ কে স্বীকৃতি দেয়াই যেতে পারে। কেননা বলা হয়ে থাকে তার কারণেই আব্বাসী খিলাফত দীর্ঘ প্রায় পাঁচশত বছর শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।
তথ্যসূত্র
ইসলামের ইতিহাস – কে আলি
terbinafine buy online – cheap fulvicin 250 mg buy cheap generic griseofulvin
rybelsus price – how to buy semaglutide DDAVP for sale