মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম সংগ্রাহক বা ধারক বাহক বলা হয় জাদুঘরকে। জাদুঘরে ইতিহাস ঐতিহ্য ও সভ্যতার ধারাবাহিক নিদর্শন পাওয় যায়। তাই জাদুঘরে আসা দর্শনার্থীরা অতি সহজে ও সংক্ষেপে ইতিহাসের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে ইতিহাসের ধারাবাহিক ধারনা লাভ করতে পারে।
একটি দেশের জাদুঘরকে ঐ দেশের ইতিহাস ও সভ্যতার সংগ্রহশালা বলা হয়। তবে বিশ্বের বিখ্যাত কিছু জাদুঘর শুধু তাদের নিজ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য কেই তুলে ধরে না বরং সমগ্র বিশ্বের ইতিহাস ঐতিহ্য কে বহন করে। ফলে এসব জাদুঘর সমগ্র বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসুদের আকৃষ্ট করে। এবং মানব জীবনের ধারাবাহিক ইতিহাস/ঐতিহ্য/কলা/বিজ্ঞান কে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়। তাই আজকে বিশ্বের বিখ্যাত ১০ টি জাদুঘর নিয়ে আলোচনা করব যাতে পাঠক সমাজ এসব জাদুঘর সম্পর্কে সম্যক ধারনা লাভ করতে পারে।
১. মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম:
মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামটি নিউইয়র্কে অবস্থিত। এটি ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিতে প্রায় ২০ লাখের বেশি দর্শনীয় বস্তু রয়েছে। যা সমগ্র বিশ্ব থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এখানে ইসলামিক, মিশরীয়, ইন্ডিয়ান ও গ্রিক কলা/সংস্কৃতি এবং ইউরোপের চিত্র শিল্পের নিদর্শন রয়েছে। এখানে প্রায় ৬০০০ বছরের মানব ইতিহাসের সন্নিবেশ করা হয়েছে। এই জাদুঘরে বিখ্যাত এডাম ও ইভের মূর্তি রয়েছে যা এটিকে আরো ব্যাপক জনপ্রিয়তা উপহার দিয়েছে।
এই জাদুঘরটি এতই বৃহৎ যে সমগ্র এক দিনে এটি পরিদর্শন করা সম্ভব নয়। গত বছর দর্শনার্থীদের ভোটের মাধ্যমে এটি বিশ্বের সবচাইতে জনপ্রিয় জাদুঘর হবার মর্যাদা লাভ করে।
২. ল্যুভর মিউজিয়াম
ল্যুভর মিউজিয়াম পৃথিবীর অন্যতম একটি বিখ্যাত মিউজিয়াম। প্রথম সাড়ির জাদুঘর গুলোর তালিকা তৈরি করতে বলা হলে এটি নিঃসন্দেহে প্রথম দিকে স্থান পাবে। এই বিখ্যাত জাদুঘরটি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত। এই জাদুঘরকে আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসের সংগ্রহশালা বলা যায়। এর সামনে কাঁচের পিরামিড এটিকে বহুমাত্রিকতা দান করেছে। এখানে গ্রিক, মিশরীয়, রোমান ও প্রাচ্য দেশীয় অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে। সবচাইতে আকর্ষণীয় বস্তু সমূহ হল রেনাসা আমলের নিদর্শন সমূহ যা এটিকে আরো বহুমাত্রিকতা দান করেছে। এখানে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম মোনালিসাসহ রেম্বান্ট, রুবেন্স ও টশিয়ানের বিখ্যাতসব কৃতকর্ম স্থান পেয়েছে।
এছাড়াও এখানে আধুনিককালেরও বহু বিখ্যাত শিল্পী ও ভাস্করের শিল্প ও ভাস্কর্য কর্ম রয়েছে। যদিও শুরুর দিকে একটি মধ্যযুগীয় একটি দুর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হত। প্রথমে ১৬২৪ সালে সম্রাট ত্রয়োদশ লুইয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা হিসেবে ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে ১৮৪৮ সালে তা ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় সম্পদে পরিণত হয় এবং তাকে জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে এখানে ছয়টি গ্যালারীতে ভাগ করে দর্শনার্থীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
৩. গিমে মিউজিয়াম
গিমে মিউজিয়ামটি ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত। এটি প্রথমে ১৮৭৯ সালে যাত্রা শুরু করে ও দশ বছর পর ১৮৮৯ সালে তা স্থানান্তর করে বর্তমান স্থান অর্থাৎ প্যারিসে নিয়ে আসা হয়। এটির নামকরণ করা হয় ফ্রান্সের একজন ব্যক্তির নামানুসারে। এমিল গিমে নামে একজন সৌখিন শিল্পপতি ১৮৭৬ সাল থেকে শুরু করে ১৮৭৯ সাল পর্যন্ত এশিয়ার চীন,জাপান, ভারতবর্ষ ও আফ্রিকার মিশর এবং ইউরোপের গ্রিসে ভ্রমণ করে বিভিন্ন প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন ও পুরাকীর্তি সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে তা নিজের সংগ্রহে একটি মিউজিয়াম স্থাপন করেন। এবং তার নামানুসারে এই মিউজিয়ামের নাম দেন গিমে মিউজিয়াম।
১৮৮৯ সালের পর তা প্যারিসে স্থানান্তর করা হলে তা ফ্রান্স সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় চলে যায়। এবং তাতে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার প্রত্নতত্ব ও পুরাকীর্তি দিয়ে সমৃদ্ধ করেন।
৪. মাদাম তুসো মিউজিয়াম
মাদাম তুসো মিউজিয়ামটি যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থিত । এটি পৃথিবীর বিখ্যাত মিউজিয়ামের মধ্যে অন্যতম । এটি প্রথমে ১৮৩১ সালে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় যাত্রা শুরু করে পরবর্তীতে ১৮৩৫ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মিউজিয়ামটি বিখ্যাত হবার প্রধান কারণ হল বিভিন্ন বিখ্যাত মোমের মূর্তি/মমি সংরক্ষণ করা। এখানে এরিস্টটল থেকে শুরু করে স্টিফেন হকিং, অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান পর্যন্ত সকল কিংবদন্তির মো
মের তৈরি প্রতিকৃতি রয়েছে। তাছাড়া হিটলার ও ফরাসি বিপ্লবের সময় বীরত্বের সাথে লড়াই করে মৃত্যুবরণ কারী এবং মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত বীরদের মাথার মোমের তৈরি প্রতিকৃতি অন্যতম। এটিরও নাম করন করা হয় মাদাম তুসো নামে এক ব্যক্তির নামানুসারে।
৫. ব্রিটিশ মিউজিয়াম
ব্রিটিশ মিউজিয়ামটি যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থিত। এটি ১৭৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের ঐতিহাসিক নিদর্শন ও প্রন্ততাত্তিক কর্ম এখানে স্থান পেয়েছে। এখানে প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ১৯৬ সালের প্রন্ততাত্তিক নিদর্শন পাওয়া যায়। এই মিউজিয়ামকে ইজিপটিয়ান ঐতিহ্যের এক বিরাট সংগ্রহশালা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া ব্রিটিশদের ইতিহাসের বড় উৎস হিসেবে একে বিবেচনা করা হয়। এখানে সর্বমোট ৭০ লক্ষ সংগ্রহ কর্ম রয়েছে । এই মিউজিয়ামে বছরে ৬০ লক্ষ দর্শনার্থী পরিদর্শন করে। তবে এখানে ৪০ লক্ষ সংগ্রহ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।
৬. ভ্যাটিকান মিউজিয়াম
ভ্যাটিকান সিটিতে এই মিউজিয়ামটি অবস্থিত। এটি মূলত খ্রিষ্টান ক্যাথলিকদের জন্য বানানো হলেও বর্তমানে তা সকলের জন্য উন্মুক্ত। এটি মূলত কোন জাতি গোষ্ঠীর ইতিহাস তুলে ধরেনি বরং এটি সমাজ ও সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি বিভিন্ন মানচিত্র ও ধর্মীয় বিভিন্ন চিত্রকর্ম এখানকার সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে। বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু করে মিশরীয় সভ্যতার শিল্পকর্মও এখানে গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করেছে।
এখানে সিসটাইন চ্যাপল এবং র্যাফেল-এর জন্য আলাদা সংগ্রহশালা তৈরি করেছে যা এখানকার দর্শনার্থীদের নজরকে ভালভাবেই আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। বলা হয়ে থাকে এখানে পরিদর্শন করেছে এমন সবার সাথে কথা বললে সবাই প্রথমে এই দুই সংগ্রহশালার কথাই বলবে। এছাড়াও এখানে মোট ২২ টি সংগ্রহশালা রয়েছে। বছরে প্রায় ৪০ লাখেরও বেশি দর্শনার্থী এই মিউজিয়ামে পরিদর্শনের জন্য যান।
৭. ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম
ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামটি মিশরে অবস্থিত । এটি ১৮৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও মিশরীয় অধিকাংশ সভ্যতার নিদর্শন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । তারপরও এখানে রয়েছে মিশরের ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ নিদর্শন। এখানকার গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের মধ্যে রয়েছে – মিশরীয় কিশোর সম্রাট তুতেন খামেনের সমাধি, স্ফিংস দৈত্যের ভাস্কর্যসহ মিশরের হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এখানে সর্বমোট ১ লক্ষ ২০ হাজার নিদর্শন রয়েছে যা দর্শনার্থীদের কে তৃপ্ত করতে সক্ষম।
৮. প্রাদো মিউজিয়াম
প্রাদো মিউজিয়ামটি স্প্যানের মাদ্রিদে অবস্থিত। ১৮১৯ সালে এই জাদুঘরটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এটি পৃথিবীর অন্যতম একটি বিখ্যাত জাদুঘর। এখানে যে সব নিদর্শন রয়েছে তা স্পেনের প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বহন করে চলছে। এখানে স্পেনের বিখ্যাত চিত্রকর্ম ও তাদের কারিগরদের পথিকৃতি স্থান করে নিয়েছে। এছাড়াও সমগ্র ইউরোপের বিখ্যাত সব চিত্র কর্ম এখানে স্থান লাভ করেছে। বিখ্যাত চিত্রকর ভেলাজকুয়েজের ‘লাস মেনিয়াস’ চিত্রকর্ম থেকে শুরু করে বিখ্যাত সব চিত্রকরদের আঁকা ছবি স্থান লাভ করেছে এই জাদুঘরে। বিখ্যাত জুয়ান দে ভিলানুয়েভার মাধ্যমে এই জাদুঘরটির ডিজাইন করা হয়। এই জাদুঘরের প্রধানতম আকর্ষণ হল রুবেন্সের ‘দ্য থ্রি গ্রেসেস। ফলে এটি বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেছে।
৯. উফিজি গ্যালারি মিউজিয়াম
উফিজি মিউজিয়ামটি ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে অবস্থিত। এটি ইতালির ইতিহাস ঐতিহ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য কে অতি সুন্দরভাবে বহন করে চলছে। এই মিউজিয়াম কে ইউরোপের রেনেসাঁর সংগ্রহশালা বলা হয়। এই মিউজিয়ামের প্রবেশের পথেই চোখে পরে বিখ্যাতসব ভাস্কর্য । মিউজিয়ামের দেয়ালে দেয়ালে স্থান পেয়েছে এসব ভাস্কর্য ও বিভিন্ন পথিকৃতই। বিখ্যাত চিত্রকর মাইকেল এঞ্জেলা ও লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির মত বিখ্যাত সব ব্যক্তিদের আকা ছবি স্থান পেয়েছে এই মিউজিয়ামে। বিখ্যাত ভাস্কর বোত্তিসেল্লির ‘বার্থ অব ভেনাস’ এবং ‘প্রিমাভেরা’সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্নসব ভাস্কর্য স্থান পেয়েছে এখানে ।
১০. হার্মিটেজ মিউজিয়াম
হার্মিটেজ মিউজিয়ামটি রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গে অবস্থিত। ১৭৬৪ সালে তৎকালীন জার শাসক রানী দ্বিতীয় ক্যাথরিনের সময় এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে ১৮৫২ সালে এটিকে সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। অনেকেই ধারনা করেন যে রাশিয়া শিল্পকলা ইউরোপের অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে তাদের জন্য এই মিউজিয়ামটি একটি বার্তা প্রদান করে কারণ এখনে প্রায় ৩০ লক্ষ ইতিহাস ঐতিহ্যের নিদর্শন বিদ্যমান রয়েছে। এখানে শশকিন, আইভাজোতুস্কি, কুইনজি, রোপিনসহ আরো অনেকের বহু চিত্রকর্ম স্থান লাভ করেছে। ছয়তলা বিশিষ্ট এই বিশাল জাদুঘরটি উইন্টার প্যালেস, ছোট প্যালেস, নিউ প্যালেস নামে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন এটি পরিদর্শনের জন্য আগমন করেন।
তথ্যসূত্রঃ
১. https://www.nationalgeographic.com/travel/top-10/museum-galleries/
২. http://www.dhakatimes24.com/
৩. https://thepointsguy.com/2017/09/tripadvisor-top-museums/
glycomet over the counter – sitagliptin 100mg cost acarbose 50mg brand