সোভিয়েত ইউনিয়ন:উত্থান ও পতনের ইতিহাস
১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের মধ্যদিয়ে প্রথমবারের মতো মার্ক্সবাদের ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক দেশের গোড়াপত্তন হয়। ১৯২১ এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে লেনিনের রেড আর্মির বিজয় সূচিত হয়। ১৯২২ সালে এক চুক্তির মধ্য দিয়ে রাশিয়ার পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশ মিলে গড়ে উঠে সোভিয়েত ইউনিয়ন। অনেক চড়াই- উৎরাই এর মধ্য দিয়ে মস্কোর ক্ষমতা কমে যাবার এক পর্যায়ে ১৯৯১ সালে এই ইস্টার্ন ইউরোপের দেশগুলো আবার বিভক্ত হয়ে যায়। আজকের আর্টিকেলটি আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের আদ্যপ্রান্ত জানার চেষ্টা করবো।
রুশ বিপ্লব:
১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের মধ্যদিয়ে বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শীরা দ্বিতীয় জার নিকোলাসকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে এক বলশেভিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এই নব্য রাষ্ট্রই রাশিয়ান প্রাক্তন সাম্রাজ্য। বলশেভিকদের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়েই শুরু হয় এক ব্যাপক গৃহযুদ্ধ। বলশেভিকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে জারের অনুগত কিছু লোকজন, পাশাপাশি কিছু পুঁজিপতি বুর্জোয়ারাও এদের সাথে মিলিত হয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে বিঘ্নিত করতে গৃহযুদ্ধে নামে। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক বলশেভিক, যারা রেড আর্মি নামে পরিচিত, হোয়াইট আর্মি অর্থাৎ জারের অনুগতদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়। এই সময়ে বলশেভিকরা জারের অনুগত ও উচ্চ শ্রেণির উপর ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালায়। ১৯২১ সালে লেনিন এই রেড আর্মির নিধনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। এরমধ্য দিয়েই চূড়ান্তভাবে শেষ হয় বলশেভিক বিপ্লব।
সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন ও সদস্য দেশসূহঃ
১৯২২ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ভ্লাদিমির লেনিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করেন। ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই চুক্তি সম্পন্ন হয়। প্রথম রাশিয়া,বেলারুশ, ইউক্রেন ও কাকেশাসীয় অঞ্চলের ইউনিট বর্তমান জর্জিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান মিলে এই চুক্তি স্বাক্ষর করে। পাশাপাশি অন্যান্য দেশেরও সোভিয়েত ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তির জন্য নমনীয় নীতি রাখা হয়। যার ফলে ১৯৪০ সাল নাগাদ সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য সংখ্য ১৫ এর কোঠায় গিয়ে পৌঁছায়। সদস্য দেশসমূহ ছিল বর্তমান রাশিয়া,ইউক্রেন, বেলারুশ, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, এস্তনিয়া,জর্জিয়া, কাজাখিস্তান, কিরজিখিস্তান,লটভিয়া,লিথুনিয়া, মালদোভা, তাজিকিস্তান, তুর্কিমিনেস্তান ও উজবেকিস্তান।
সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের মূলনীতিঃ
সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন ছিল সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতিফলন। সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের ঘোষণাপত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা হয় যে, বিশ্ব আজ দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি পুঁজিবাদী শোষণকারী গোষ্ঠী আর অন্যটি নতুন প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক মুক্ত বিশ্ব। এই মুক্ত বিশ্ব হল ভ্রাতৃত্ববোধ ও আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতার ভিত্তিতে শান্তির সমন্বয়ে তৈরি। কিন্তু সমাজতান্ত্রিকদের প্রতি বিদ্বেষী পুঁজিবাদী শোষণকারীদের হাত থেকে রক্ষায় নিজেদের মধ্যে সংহতি তৈরি করা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের যৌক্তিকতাকে তিনটি লেয়ারে বিভক্ত করা হয়েছিল। প্রথমত, গৃহযুদ্ধের ফলে প্রতিটি রাষ্ট্রর অর্থনীতিই প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। যা কিনা কাটিয়ে উঠতে সমাজতান্ত্রিক ধারার সহযোগিতাপূর্ণ অর্থনীতিই একমাত্র উপযোগী হিসেবে কাজ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, বহিঃশত্রুর হাত থেকে এই দেশ সমূহের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কেননা তৎকালীন সময় বাইরের ক্ষমতাশীল দেশ সুযোগ পেলেই অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতো। আর যেহেতু এই দেশসমূহের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল ভঙ্গুর তাই জোট হয়ে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার একটি সোপান হিসেবে এই ইউনিয়ন গঠন করা হবে। তৃতীয়ত,মার্ক্সবাদ একটি বাউন্ডারি বিহীন দেশ গঠনের স্বপ্নে বিভোর ছিল। বিশ্ব শ্রমিকের অধিকার সম্মিলনে ছিল সদা ব্যাপৃত। তাই এই পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সমন্বয়ে এর প্রথম প্রয়াস ছিল বলেই ধরে নেয়া যায়। এবং বলা হয়ে থাকে যে এই তিনের সমন্বয়েই সৃষ্টি ও সংহত হবে উন্নয়ন,শান্তি ও নিরাপত্তা। এই চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে প্রতিটি দেশের ক্ষমতা সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর ন্যাস্ত হয়। আর এর মূল কেন্দ্রবিন্দু হয় মস্কো। মোট ২৬ টি আর্টিকেলের ভিত্তিতে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়।
স্ট্যালিনের যুগে সোভিয়েত ইউনিয়ন:
আধুনিক জর্জিয়ায় জন্মগ্রহণ করা স্ট্যালিন ক্ষমতায় আসেন ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। তার শাসনামল ছিল রক্তপাতের এক কালো অধ্যায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। ভগ্ন অনুন্নত কৃষিভিত্তিক দেশকে তিনি একটি শিল্পে উন্নত ও সামরিক পরাশক্তিতে রূপান্তরিত করে দেন। একজন প্রখ্যাত লেখক বলছিলেন যে,”তিনি(স্ট্যালিন) সোভিয়েত ইউনিয়নকে লাঙলের সাথে পান আর ক্ষমতা ছাড়ার সময় তিনি নিউক্লিয়ার সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে রেখে যান।” তিনি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটাতে সমর্থ হন। প্রথমদিকের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলো ছিল কৃষিকে ব্যাপক আধুনিকায়ন করা। পরবর্তীতে তা থেকে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করা হয়। ১৯২৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে সামগ্রিক অর্থনীতিকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। গ্রাম্য লোকদের জোর করে শহরে থাকতে বাধ্য করা হয়। মালিকানাধীন সকল সম্পত্তি রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৩০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর্জন করে। যদিও এই উন্নয়ন করতে গিয়ে স্ট্যালিন অনেকটা পেশিশক্তির ব্যবহার করেন। এমনকি ত্রিশের দশকের শুরু দিকে তাঁর নীতির কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে এক খাদ্য সংকটে অনেকে মারা যান। যদিও এই সম্বন্ধে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ বাইরে কিছুই জানতে দেয়নি। স্ট্যালিনের শাসনামলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ব্যাপক আকারে বিরোধী শক্তিকে বিশোধন করা। ১৯৩৬-৩৮ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিতরে সমাজতান্ত্রিক বিরোধীতা করেছে এমন প্রায় ৬০,০০০ হাজার নিজ জনগণকে স্ট্যালিন হত্যা করেন। আরো অনেককে লেবার ক্যাম্পে পাঠানো হয়। বিস্ময়করভাবে সোভিয়েত অর্থনীতির বড় একটা অবদান কিন্তু এই লেবার ক্যাম্প থেকেও আসতো।
সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনঃ
বৈষম্যহীন বিশ্ব গড়ার মহৎ যে প্রত্যয় নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন যাত্রা শুরু করেছিল তা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। ষাট ও সত্তরের দশকে ক্রুশ্চেভ ও বেজনেবের আমলে সরকারি মদদে সোভিয়েত ইউনিয়নেই অনেক বুর্জোয়া তৈরি হয়। কিন্তু অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ব্যাপক দৈন দশায় নিপাতিত হয়। শিল্পকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা হওয়ায় খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে বরাবরই একটা সংকট লেগেই থাকতো। সত্তর ও আশির দশকে রুটিরুজির জন্য প্রতিদিনই দীর্ঘ সিরিয়াল ছিল এক নিত্যদিনকার চিত্র। এমনকি মৌলিক অধিকারও সবসময় সোভিয়েত সরকার বাস্তবায়ন করতে পারতো না। এমনকি পোশাক ও জুতোর জন্যও অগাধ অভাব ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। জেনে অবাক হবেন যে জিয়ার আমলে বাংলাদেশ থেকেও সোভিয়েত ইউনিয়ন টুথপেস্ট আমদানি করতো। এককথায় জারের শাসনামলের মতো সোভিয়েত সমাজ দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদল ছিল উচ্চ ধনিক বুর্জোয়া শ্রেণি,অন্যদিকে ছিল অভাবগ্রস্ত খুধায় নিপীড়িত সাধারণ জনতা। তরুণ সমাজ কোনভাবেই আর এমন শাসন ব্যবস্থার সাথে ঘর করতে রাজি ছিল না। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছিল। চারদিকে জনরোষ ছড়িয়ে জেতে শুরু করে।
অন্যদিকে ভঙ্গুর সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে আমেরিকার আগ্রাসী নীতি অর্থনীতিকে আরেক ধাপ পিছনে ঠেলে দেয়। রোনাল্ড রিগান সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিশ্ব থেকে আইসোলেটেড করে দেয়। পাশাপাশি তেলের দাম এমনভাবে কমিয়ে দেয় যা সোভিয়েত অর্থনীতিকে একদম গুঁড়িয়ে দেয়। কেননা সোভিয়েত অর্থনীতি মূলত তেল ও গ্যাসের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। ফলে পূর্ব ইউরোপের উপর থেকে সোভিয়েত কর্তৃত্ব আস্তে আস্তে কমতে থাকে। অন্যদিকে আয়রন কারটেইলের এরিয়ার মধ্যে ইউএস এর প্রভাব বাড়তে থাকে।
গরবাচেভ ও সোভিয়েত এর মূল পতনঃ
১৯৮৫ সালে এক সংকটময় অবস্থায় ক্ষমতায় আসে গরবাচেভ। তিনি দুইটি নীতির বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে আবার সেই আগের জৌলুশ ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। প্রথমটি হল গ্লাসনস্ত যা ছিল রাজনৈতিক উদারবাদ। সোভিয়েত ইউনিয়নে যেখানে রাজনৈতিক কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ ছিল পূর্বের সময়ে সেখানে এবার খোলাখুলি মতামত ও সরকারকে গঠনমূলক দোষারোপ করার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেন। মিডিয়াকে খুলে দেন। অন্যদিকে পেরেস্ত্রইকার মাধ্যমে অর্থনীতিকে মুক্ত করে দেন। ফলে অনেকটা চায়নার ধাচের অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা পায়। অনেকটা পুঁজিবাদী ধারার অর্থনীতি গড়ে উঠে এই সময়ে। কিন্তু গরবাচেভের এই সংস্কার আরো ভয়াবহতা ডেকে আনে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য। যা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে তরান্বিত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্যাটেলাইট দেশগুলো কেন্দ্র থেকে আরো মুক্ত হয়ে পড়ে।
১৯৮৯ সালে প্যোলান্ডের স্বাধীনতার জন্য বিপ্লব। অন্যদিকে বার্লিল দেয়ালের পতন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের আগাম সংকেত। ১৯৯১ সালের আগস্টে তিন দিনের দুনিয়া কাঁপানো এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গরভাচেব এর ক্ষমতাকে ইয়ালতাসির চ্যালেঞ্জ করে বসে। গরবাচেভ ক্ষমতায় ছিলেন ঠিক কিন্তু আগের সেই প্রতাপ আর ছিল না। ১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর গরবাচেভ ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর গঠিত হওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালের ৩১ ডিসেম্বর শান্তিপূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়। এর মাধ্যমেই সমাপ্তি ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের।
তথ্যসূত্রঃ
১.বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর-তারেক শামসুর রেহমান.
২.https://www.history.com/topics/history-of-the-soviet-union
rybelsus sale – DDAVP sale desmopressin canada
buy terbinafine cheap – griseofulvin 250 mg price griseofulvin tablet