দুবাই শহরের শেখ জায়েদ রাস্তার পাশে ২০১০ সালে নির্মিত ‘বুর্জ খলিফা’ ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবনের মর্যাদা নিয়ে। নিঃসন্দেহে এটি একুশ শতকের একটি বিস্ময়কর এবং অনন্য সৃষ্টি। ১৫০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত রকেট আকৃতির এই ভবনটির উচ্চতা ৭১৭ ফুট। আইফেল টাওয়ারের চেয়েও প্রায় তিনগুণ বেশি উঁচু এই ভবনটি। ভূমি থেকে উচ্চতায় এতোই উঁচু যে সূর্যাস্তের পরও প্রায় দুই মিনিট ধরে উপরের তলার মানুষ সূর্য দেখতে পায়। তাই রমজান মাসে সর্বোচ্চ তলার মানুষ ইফতারি করেন একই ভবনে নিচ তলায় থাকা মানুষের দুই মিনিট পর। শুধু উচ্চতায় এটি শ্রেষ্ঠ নয়। বুর্জ খলিফার শ্রেষ্ঠত্বের পিছনে রয়েছে অনেকগুলো বিশ্বরেকর্ড এবং মনোমুগ্ধকর নির্মাণকৌশল। চলুন জেনে আসা যাক, বিস্ময়কর এই ভবনটির নির্মাণ কৌশল এবং অজানা কিছু তথ্য।
নামকরণ
‘বুর্জ‘ আরবি শব্দ। এর অর্থ টাওয়ার। দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাখতুম ভবনটির উদ্বোধন করেন। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সম্মানে ভবনটির নামকরণ করেন বুর্জ খলিফা। নির্মাণের সময় ‘বুর্জ দুবাই‘ নামে এর নামকরণ হলেও উদ্বোধনের সময় এর নাম পরিবর্তন করে বুর্জ খলিফা রাখা হয়। ভবনটির আর একটি নাম ‘দুবাই টাওয়ার’।
বিশ্বরেকর্ড সমূহ
১. এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ উচ্চতার ভবন। ২ হাজার ৭১৭ ফুট বা ৮২৮ মিটার উঁচু সুবিশাল এই ভবনটি। অনেকের মতে বুর্জ খলিফার মূল উচ্চতা ৫৮৫ মিটার। অবশিষ্ট উচ্চতা ভবনের চূড়ায় যে কুণ্ডলী সৃষ্টি হয়েছে, তার উচ্চতা।
২. বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তলাবিশিষ্ট ভবন বুর্জ খলিফা এবং এর ১৬০টি তলা বাসযোগ্য। প্রথম ১৫টি ফ্লোরই রয়েছে আরমানি হোটেলের দখলে। ৫০-১০৮ তলার মধ্যে রয়েছে ৯০০টি বিক্রয়যোগ্য এপার্টমেন্ট। কিন্তু সেগুলো উদ্বোধনের দিনেই বিক্রি হয়ে যায়।
৩. এটি বিশ্বের দীর্ঘতম এবং দ্রুততম এলিভেটর বা লিফট বিশিষ্ট ভবন। এলিভেটর গুলো ডাবল ডেকার এবং আটটি এস্কেলেটর বিশিষ্ট। এগুলো ১০ মিটার/সেকেন্ড গতিতে ওঠানামা করে এবং প্রতি কেবিনে ১২ থেকে ১৪ জন মানুষ পরিবহণ করতে পারে।
৪. উচ্চতম আবাস ব্যবস্থার ভবন বুর্জ খলিফা। বুর্জ খলিফা একমাত্র ভবন যেখানে মানুষ সর্বোচ্চ (১০৮ তলা) উচ্চতায় বসবাস করতে পারে।
৫. বুর্জ খলিফায় রয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতায় নামাজের ব্যবস্থা।
৬. বিশের উচ্চতম সুইমিংপুলও রয়েছে বুর্জ খলিফায় (৪৩ তলায়)।
৭. পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থানের পর্যবেক্ষণ ডেকের অবস্থান রয়েছে এই সুউচ্চ ভবনে ৪৪২ মিটার উঁচুতে।
নির্মাণকৌশল
বিশ্বের সুউচ্চ এই ভবনটি নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৪ সালে। আর শেষ হয় ২০০৯ সালে ১ অক্টোবর। ভবনের প্রধান স্থপতি ছিলে আদ্রিয়ান স্মিথ। আর প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন সুফিয়ান আল জাবিরি। ভবন নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ‘এসওএম বা স্কিডমোর, ওয়িংস এন্ড মেরিল’ নামক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ৩৮০ জন দক্ষ প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ এর নির্মাণ কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। ভবনটিতে বাংলাদেশি বংশভূত প্রখ্যাত স্থপতি ফজলুর রহমান খান কর্তৃক আবিষ্কৃত ‘বান্ডেল টিউব‘ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। যার ফলে সুবিশাল এই ভবনে মাত্র ৪ হাজার টন লোহা ব্যবহার করেই নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল। ভবনের মূল নক্সার ধারণাটি মূলত গ্রহণ করা হয় নবম শতকে নির্মিত ইরাকের সর্পিলাকার একটি মসজিদের কাঠামো থেকে। এমন সর্পিলাকৃতির জন্য অবশ্য আরো একটি কারণ আছে, তা হলো ঘূর্ণিঝড় সহনশীলতা বাড়ানো। দুবাই ধূলিঝড় প্রবণ একটি শহর। আর প্রচণ্ড ধূলিঝড় থেকে সর্পিলাকৃতি কাঠামো বিল্ডিংকে অধিক সহনশীল করেছে।
অভ্যন্তরীণ তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত জানালার কাঁচে রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। যার ফলে বাহিরে প্রচণ্ড উত্তাপ থাকলেও ভবনের অভ্যন্তরে থাকে স্বাভাবিক তাপমাত্রা। বুর্জ খলিফায় ২৪,৩৪৮ টি জানালা আছে। আবার এসব জানালা পরিষ্কারের জন্য আছে তিনটি ট্রাক। ৩৬ জন শ্রমিকের সব জানালা পরিষ্কার করতে ৩ থেকে ৪ মাস সময় লেগে যায়।
বুর্জ খলিফার নির্মাণ শ্রমিকদের অধিকাংশ ছিল দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এই উচ্চাভিলাষী অট্টালিকা নির্মাণে প্রায় ৭৫০০০ শ্রমিক ৬ বছর যাবত কাজ করেছেন। এমনও দিন ছিলো যেদিন একসাথে ১২ হাজার শ্রমিক কাজ করেছে। প্রতি তিনদিন পর পর ছাদ ঢালাই দেয়া হতো। প্রচণ্ড গরমের কারণে অনেক সময় রাতে কাজ করার প্রয়োজন হতো। এসব শ্রমিকদের দৈনিক পারিশ্রমিক ছিলো মাত্র ২.৮৪ ডলার। দুবাই সরকারের শ্রমিকদের প্রতি আচরণ ছিলো অত্যন্ত কষ্টদায়ক। ছিলো না ভালো থাকার বা খাবারের ব্যবস্থা। যার ফলশ্রুতিতে ২০০৬ সালে ২১ মার্চ আড়াই হাজার শ্রমিক কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ ঘোষণা করেন, কিন্তু আন্দোলনের ফলাফল ছিলো শূন্য।
ভবনের অভ্যন্তরীণ মনোমুগ্ধকর নির্মাণশৈলী
ভবনের অভ্যন্তরীণ দৃশ্য বাহিরের দৃশ্যের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। বাছাইকৃত ১০০০ চিত্রকর্ম দিয়ে ভবনের অভ্যন্তর সাজানো হয়। ১ লক্ষ ৭৪ হাজার বর্গ মিটার দেয়াল জুড়ে রয়েছে বিশালাকার ২৬ হাজার শক্ত প্রতিসারক কাঁচ এবং এলুমিনিয়ামের পাত। এখানে প্রবেশ করতে দর্শনার্থীদের গুনতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। ১৬০ তলার পর আবার এই টাকার পরিমাণ আরো বেশি হয়। ৯ থেকে ১৬ তলা পর্যন্ত আমেরিকানদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ১৯ থেকে ৩৭ তলা এবং ৭৭ থেকে ১০৮ তলায় রয়েছে থাকার ব্যবস্থা। ১৫৮ তলায় আছে একটি মসজিদ। ভবনে দুইটি আকর্ষণীয় সুইমিংপুল আছে। এগুলো ৪৩ এবং ৭৬ তলায় অবস্থিত। ১২৪ তম তলায় প্রকৃতি দর্শনের বিশেষ ব্যবস্থা আছে।
ভবনের বাহিরের সৌন্দর্য
বুর্জ খলিফার সৌন্দর্য শুধু ভিতরেই সীমাবদ্ধ নয়। এর বাহিরেও পার্ক ও ঝর্না দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মনোরম পরিবেশ। বুর্জ খলিফার মূল প্রবেশ পথের ধারেই রয়েছে নীলাভ পানির একটি ঝর্না, যা তৈরি করতে খরচ হয়েছে ১৩৩ মিলিওন ব্রিটিশ পাউন্ড। ৬৬০০ টি রঙিন বাতি দ্বারা রাতে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করে এই কৃত্রিম ঝর্ণা। ভবনের চার পাশে রয়েছে মনোরম বুর্জ খলিফা পার্ক। ‘হাইমেনোক্যালিস’ নামক একপ্রকার মরু উদ্ভিদের আদলে তৈরি করা হয়েছে এটি।
বুর্জ খলিফার চেয়েও উঁচু ভবন নির্মাণের ঘোষণা
বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবনগুলো গড়ে উঠেছে দুবাই শহরে। তারপরেও থেমে যায়নি দুবাই সরকার। সম্প্রতি দুবাই সরকার বুর্জ খলিফার চেয়েও উঁচু ভবন নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। নতুন এই ভবনটিতে থাকবে ঘূর্ণায়মান ব্যালকনি, ঝুলন্ত বাগান, হোটেল এবং বিলাসবহুল এপার্টমেন্ট। ২০২০ সালের মধ্যেই নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। (bbc.com)
semaglutide 14mg cost – buy glucovance pills for sale desmopressin where to buy