বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান

1

T-33 বিমানটি নিয়ে ছুটে আসছিলেন সেই বীর আর মনে স্বপ্ন ছিলো এক স্বাধীন বাংলার। দেশ স্বাধীন করে নিজেকে বিসর্জন দেওয়ার পরেও ৩৫ বছর, জ্বী হ্যাঁ ঠিক ৩৫ বছর তাঁর কবর ছিলো সেই নরপিশাচদের কবলে আর তাঁর কবরের ফলকে লিখা ছিলো, ‘ ইদার শো রাহা হ্যাঁ এক গাদ্দার। ‘

আমাদের একজন বীরশ্রেষ্ঠ এতোবছর শুয়ে ছিলো নাপাকীদের দেশে যিনি নিজের পরিবারকে ত্যাগ দিয়ে আমাদের এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা।চোখের পানি বাঁধ কিছুতেই মানতে চায় না,গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠে। এ কি আমি স্বপ্ন দেখছি ?

দেশের প্রতি অসীম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার কারণেই পাকিস্তানীদের মাটিতে দাড়িয়েই স্বপ্ন দেখেছিলেন এক স্বাধীন বাংলার যার বুকে থাকবে লাল সুর্য যা ঘিরে থাকবে সবুজ প্রকৃতির নির্মল ছায়া। আমরা আজ খোলা বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছি,স্বাধীন একটি দেশে ভোর সকালে উঠা রক্তিম সুর্যের আলো আমাদের গায়ে আলতো ছোঁয়া দিয়ে যায়।

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, পেশায় ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। কেমন প্রশস্ত বক্ষের অধিকারী হলে একজন মানুষ ওই দেশে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতাহননকারীদের বিরুদ্ধে ট্রেনিং ক্যাম্প গড়ে তুলতে পারেন ? প্রশিক্ষণ দিতেন বাংলার যুবকদের ? সংগ্রহ করা অস্ত্র নিয়ে গড়ে তুলতে পারে অস্ত্রশালা যার আধারে গড়ে উঠে প্রতিরোধ বাহিনী !! এমনই এক অসীম সাহসের অধিকারী আমাদের সুর্যসন্তান বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান।

বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান১৯৭১ সালের জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে স্বপরিবারের ঘুরতে আসেন তিনি। ২৫ শে মার্চ কালো রাতে তিনি ছিলেন রায়পুরের রামনগর গ্রামে। যুদ্ধ শুরুর পরেই তিনি গড়ে তুলতে শুরু করেন প্রতিরোধ বাহিনী। ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানী বিমানের বোমাবর্ষন হয় তাঁর প্রতিরোধ বাহিনীর ঘাঁটিতে কিন্তু তাঁর বিচক্ষনতার দরুন বেঁচে যায় তাঁরা ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই। পাক-সৈন্যরা ভৈরব আক্রমণ করলে বেঙ্গল রেজিমেন্টে ই,পি,আর-এর সঙ্গে থেকে প্রতিরোধ বুহ্য তৈরি করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনী এফ-৮৬ স্যাবর জেট থেকে তাঁদের ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করে ৷

এরপরেই ২৩ এপ্রিল ঢাকায় আসেন এবং ৯ মে ফিরে যান করাচি স্বপরিবারে। মনে মনে স্বপ্ন বুনেছিলেন যে নরপিশাচদের কাছ হতে ছিনিয়ে আনবেন জঙ্গিবিমান এবং মাতৃভুমির গলায় পড়িয়ে দিবেন জয়ের মালা। কি নিষ্পাপ সেই স্বপ্ন।
১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট শুক্রবার ফ্লাইট শিডিউল অনুযায়ী মিনহাজের উড্ডয়নের দিন ছিলো ৷ মতিউর রহমান পূর্ব পরিকল্পনা মতো অফিসে এসে শিডিউল টাইমে গাড়ি নিয়ে চলে যান রানওয়ের পূর্ব পাশে ৷ সামনে পিছনে দুই সিটের প্রশিক্ষণ বিমান T-33 । রশিদ মিনহাজ যে ছিলো মতিউর রহমানেরই একজন ছাত্র, বিমানের সামনের সিটে বসে স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসতেই তাকে অজ্ঞান করে ফেলে দিয়ে বিমানের পেছনের সিটে লাফিয়ে উঠে বসলেন কিন্তু জ্ঞান হারাবার আগে মিনহাজ বলে ফেললেন যে তিনিসহ বিমানটি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ছোট পাহাড়ের আড়ালে থাকায় কেউ দেখতে না পেলেও কন্ট্রোল টাওয়ার শুনতে পেল।সাথে সাথেই চারটি জঙ্গী বিমান ধাওয়া করে মতিউর রহমানকে।বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মতিউর বিমান নিয়ে ছুটে চললেন৷ রাডারকে ফাঁকি দেবার জন্য নির্ধারিত উচ্চতার চেয়ে অনেক নিচ দিয়ে বিমান চালাচ্ছিলেন তিনি ৷

জ্ঞান হারাবার পুর্বে রশীদের সাথে মতিউর রহমানের যুদ্ধ চলতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রশীদ ইজেক্ট সুইচ চাপলে মতিউর রহমান বিমান থেকে ছিটকে পড়েন এবং বিমান উড্ডয়নের উচ্চতা কম থাকায় রশীদ সহ বিমানটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে থাট্টা এলাকায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। মতিউর রহমানের সাথে প্যারাসুট না থাকাতে তিনি নিহত হন। তাঁর মৃতদেহ ঘটনাস্থল হতে প্রায় আধ মাইল দূরে পাওয়া যায়।এই রশীদকে পাকিস্তান সরকার সম্মানসূচক খেতাব দান করে। একই ঘটনায় দুই বিপরীত ভূমিকার জন্য দুইজনকে তাদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক খেতাব প্রদানের এমন ঘটনা বিরল।

শুনতে চান যে আমাদের বীরশ্রেষ্ঠকে কি মর্যাদায় ভুষিত করেছিলো হায়েনারা? তারা মতিউর রহমানকে করাচির মাসরুর বেসের চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানে সমাহিত করা হয় আর ফলকে লিখে দিয়েছিলো সেই কথা যা দেখে নিজেরই লজ্জ্বা আর ঘৃণায় মাথা নিচু হয়ে আসে। পরিবার উনারও ছিলো, চাইলে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিয়ে তাদেরই পক্ষে থেকে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন আয়েশে কিন্তু তিনি বাংলার বীর সন্তান বলে কথা।

আমাদের সুর্য্যসন্তান অপমানের গ্লানি উপরে নিয়ে চুপচাপ নীরবে শুয়ে ছিলেন নরকী দেশে।যেই সাহসী মনে আর মুখে স্মিত হাসি নিয়ে দেশকে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন, উনার পবিত্র শহীদী দেহ নিজ স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের আগ-অবধি হাসিমুখে সয়ে গিয়েছিলেন অপমানের গ্লানি। কি নিষ্পাপ, কি নির্মল আত্মত্যাগ। এই না হলে বীরশ্রেষ্ঠ।চিন্তা করতেই শ্রদ্ধায় নিজেরই বুক ফুলে যায়।

বাংলাদেশের এই কৃতি সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান জন্মেছিলেন ২৯ অক্টোবর ১৯৪১ সালে পুরান ঢাকার ১০৯, আগা সাদেক রোডের “মোবারক লজ” এ। তাঁর বাবা ‘মৌলভী আবদুস সামাদ’, মা ‘সৈয়দা মোবারকুন্নেসা’ তাঁর পৈতৃক  নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামে যা এখন মতিনগর নামে পরিচিত। ৯ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৬ষ্ঠ। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পাস করার পর সারগোদায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। ডিস্টিংকশনসহ মেট্রিক  পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তাঁর স্ত্রীর নাম ‘মিলি রাহমান’

কর্মজীবনের দিকে লক্ষ্য দিলে মতিউর রহমান ১৯৬১ সালে পাকিস্তান বিমান  বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে রিসালপুর পি,এ,এফ কলেজ থেকে পাইলট অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন। কমিশন প্রাপ্ত হবার পর তিনি করাচির মৌরিপুর (বর্তমান মাসরুর) এয়ার বেজ এর ২ নম্বর স্কোয়ার্ডন এ জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসাবে নিযুক্ত হন। এখানে তিনি টি-৩৩ জেট বিমানের উপর কনভার্সন কোর্স সম্পন্ন করেন এবং ৭৫.৬৬% নম্বর পেয়ে উর্ত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি এফ-৮৬ স্যাবর জেট এর উপরেও কনভার্সন কোর্স করেন এবং ৮১% নম্বর পেয়ে উর্ত্তীর্ণ হন। বৈমানিক কনভার্সন কোর্স এ ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে তাকে পেশোয়ারে (১৯ নং স্কোয়ার্ডন) এ পোস্টিং দেয়া হয়।

১৯৬৫ তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লাইং অফিসার অবস্থায় কর্মরত ছিলেন। এরপর মিগ কনভার্সন কোর্সের জন্য পুনরায় সারগোদায় যান। সেখানে ১৯৬৭ সালের ২১ জুলাই তারিখে একটি মিগ-১৯ বিমান চালানোর সময় আকাশে সেটা হঠাৎ বিকল হয়ে গেলে দক্ষতার সাথে প্যারাসুট যোগে মাটিতে অবতরণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ইরানের রানী ফারাহ দিবার সম্মানে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত বিমান মহড়ায় তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি পাইলট। রিসালপুরে দু’বছর ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হিসাবে কাজ করার পর ১৯৭০ এ বদলি হয়ে আসেন জেট ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হয়ে।

২০০৬ সালের ২৩ জুন মতিউর রহমানের দেহাবশেষ পাকিস্তান হতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়।জাতির এই বীরসন্তানকে পূর্ণ মর্যাদায় ২৫শে জুন শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে পুনরায় দাফন করা হয়। স্বদেশের মাটি খুবই আপন, নিজ সন্তানকে বুকে পেয়ে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলো এই মাটি।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করা হয় তিনি তাদের অন্যতম।

সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি যা তা হলো ঘুমাতে যাওয়ার আগে এবং ঘুম হতে উঠার জন্য সৃষ্টিকর্তাকে শোকরিয়া জ্ঞাপন করি নিজেদের রক্তে স্বাধীন করা ভাষায়। জ্বী হ্যাঁ, আমাদেরই নিজস্ব ভাষা যা অর্জন করতে যে আত্মত্যাগের ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে তা এই যাবতকালের দুনিয়াতে আর কোন নজির নেই। এঁদের আত্মত্যাগ না হলে হয়তো শোকরিয়াটা হতো, ‘ আপকা বহুত বহুত শুকরিয়া’ বলেই শুরু করতে হতো।

বাংলার এই দুঃসাহসী কৃতি সন্তান মৃত্যুবরণ করে ২০ আগস্ট ১৯৭১ বিমান ধ্বস দূর্ঘটনায়। আচ্ছা, সেই সময়ে কি মায়ের মতোন মাটি কেঁদেছিলো তাঁর সন্তানকে বুকে ফিরে পেয়ে ??
জানতে খুব ইচ্ছে করে।

( বিভিন্ন তথ্যসূত্রের জন্য উইকিপিডিয়ার সহায়তা গ্রহণ করা হয়েছে। )

Leave A Reply
1 Comment
  1. Mlgpps says

    order semaglutide sale – rybelsus 14mg generic order DDAVP online

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More