পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর কোনটি??

0

মার্ক টুয়েন বলেছেন, ভারতের বেনারাস ‘ইতিহাস, সংস্কৃতি, এমন কি কোন পৌরাণিক কল্পকাহিনীর থেকেও পুরনো’ এক শহর। যদিও তার বিশ্বাস অবশ্যই সঠিক ছিল না। তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো শহর আসলে কোথায়? 

এক সময় পৃথিবীতে ক্রোকডাইলোপলিস নামের এক শহরের অস্তিত্ব ছিল, যে শহরের নাগরিক কুমির দেবতা সোবেক এর পূজা করত। সোবেক এর পার্থিব প্রতিনিধি হিসেবে ক্রোকডাইলোপলিসের লোকজন এক জীবন্ত কুমিরের কাছে ভক্তি অর্পণ করত, যার নামকরণ করা হয়েছিল পেতসুচোস- সোবেক এর পুত্র। পেতসুচোসকে সোনা এবং মুল্যবান রত্ন দিয়ে আবৃত করে রাখা হত মন্দিরে, যেখানে পেতসুচোসের নিজস্ব জলাশয় ছিল এবং তার খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব ছিল বিশেষ এক পুরোহিতের উপর। যখন এক পেতসুচোস মারা যেত, তখন তার দেহ মমি করে বিশেষ ভাবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হত- এবং নতুন পেতসুচোস প্রতিস্থাপন করা হত সোবেক এর পুত্র হিসেবে।

ক্রোকডাইলোপলিস
ক্রোকডাইলোপলিস

ক্রোকডাইলোপলিস শহর অবস্থিত ছিল নীল নদের পশ্চিম তীরে, মেম্ফিসের দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং এর প্রতিষ্ঠাকাল ধরে নেয়া হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সাল। মিশরীয়রা এই শহরের নাম দিয়েছিল শেদেট এবং সম্ভবত মিশরের সবচেয়ে প্রাচীন শহর ছিল এই শেদেট। যেহেতু শেদেট এর লোকেরা সোবেক এর পূজারি ছিল তাই গ্রীকরা এর নামকরণ করেছিল ‘ক্রোকডাইলোপলিস’ যার অর্থ ‘কুমিরের শহর’। বর্তমানে ক্রোকডাইলোপলিস মিশরের ফাইয়ুম শহরের অংশ- যার ফলে ফাইয়ুম শহরকে পৃথিবীর সবথেকে প্রাচীন জীবিত শহর হিসেবে ধরে নেয়া হয়।

কিন্তু তা কেবলই ধারণা। উত্তর আমেরিকা এবং অস্ট্রেলেশিয়ার প্রতিটি শহরকে বাদ দিয়ে যদি বিশ্বের প্রাচীনতম শহরকে চিহ্নিত করতে হয় তবে তা হবে অনিশ্চিত এক ব্যবসার মত। এই “ব্যবসায়” দাবি আছে, আছে পাল্টা দাবি; পৌরাণিক কল্পকথা এবং লোককাহিনীও আছে; আরও আছে বিতর্কিত তথ্য প্রমাণ। এই বিষয়ের স্থিরতার কারণ হল একটি বসতির শহর হয়ে গড়ে ওঠার পেছনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি- অনেকের মতে স্বনির্ভরতা এবং বানিজ্যে উন্নতি, আবার অনেকের মতে পানি নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার উন্নতির উপর। তবে একাডেমীক পরিষদের মধ্যেও কিছু দীর্ঘমেয়াদী বিঘ্নতা রয়েছে যা একটি শহরের কৃষি সম্পর্কে পূর্বাভাস প্রদান করে।

তবে এমন কিছু স্থান রয়েছে যেগুলোকে নিঃসন্দেহে শহর বলা যায়, আর এর দাবিদার ভারতের বেনারস থেকে বুলগেরিয়ার প্লভদিভ শহর অব্দি। বেনারস বা বানারসি সম্পর্কে মার্ক টুয়েন বলেছেন, “বেনারস ইতিহাস, সংস্কৃতি, এমনকি কোন পৌরাণিক কল্পকাহিনীর থেকেও পুরনো এক শহর, এবং এই সবকিছুকে একত্রিত করলে তাকে আরও দুইগুণ পুরনো দেখাবে।” লোককাহিনী বলে, বেনারসের সৃষ্টি হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে দেবতা শিবের হাতে, যেখানে অন্য সকল তথ্য থেকে জানা যায় যে ২০০০ বছর পর গঙ্গার তীরে এই শহর প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরদিকে প্লভদিভ শহরের প্রতিষ্ঠাকাল ধরে নেয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ সাল এবং এই সময়কালের পক্ষে বেশ কিছু শক্ত তথ্যপ্রমাণ বিদ্যমান।

বেনারস বা বানারসি
বেনারস বা বানারসি

কিন্তু প্রাচীন নগরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উর্বর ভূমি ছিল মধ্যপ্রাচ্য এবং Fertile Crescent বা উর্বর চন্দ্রকলা (মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত চাঁদের ফালি আকৃতির ঐতিহাসিক অঞ্চল)। তবে এর মানে এমন নয় যে তাদের গায়ে প্রাচীন শহরের তকমা সহজেই লাগানো যাবে। এই প্রদেশের শহরগুলোর কোনটিই নিজেদের প্রাচীনতম শহর হিসেবে দাবী করেনি বা এই বিষয়ে গবেষণা করেনি, অথবা তাদের কখন রোম, এথেন্স বা সাইরেন্সেস্টার এর মত বিখ্যাত শহরের ন্যায় ব্যবসায়ীক মনভাব ছিল না।

ইরাকের যেমন আছে কিরকুক শহর, এককালে আরাফা এর প্রাচীন এসিরিয়ান রাজধানী, যে শহর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ২,২০০ সালের কাছাকাছি সময়ে এবং এই শহরের ৫০০০ বছরের পুরনো দুর্গের ধ্বংসস্তূপ তার অস্তিত্তের প্রমাণ বহন করে। তারপর পার্শ্ববর্তী আরেকটি শহর এরবিল, যা ছিল কুর্দিস্তান এর রাজধানী এবং দাবি করা হয় যে এই শহর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ সালে ।

একইভাবে ইরানে আছে সুসা, যার বর্তমান নাম সুশ, যার প্রতিষ্ঠাকাল, পুরাতত্ত্ববিদদের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ৪৩৯৫ সাল (কার্বন-তারিখ) এবং তারও ৮০০ বছর আগে থেকে সেই স্থানে বসতি গড়ে ওঠে। জাগ্রস পর্বতমালার নিম্নাংশে, টাইগ্রিস নদীর ২৫০ কিমি দূরে কারখেহ্ এবং দেজ্ নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে সুশ অবস্থিত। তবে পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর হিসেবে সুশ এর দাবি কিছুটা দুর্বল, কারণ এই শহরকে ১৫শ এবং ১৬শ শতাব্দীতে “ছোট বসতি” হিসেবে পর্যবসিত করা হয়েছিল।

সুসা
সুসা

জেরুসালেম এবং বৈরুতকেও প্রাচীন শহর হিসেবে স্থান দেয়া যেতে পারে যেহেতু তাদের নগরায়নের সময়কাল কম করে হলেও খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সাল। একই কারণে জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত জেরিখোকেও প্রাচীন নগর হিসেবে ধরা যায়। পুরাতত্ত্ববিদগণ জেরিখোতে ধারাবাহিকভাবে এমন ২০ টি বসতির সন্ধান পেয়েছেন যেগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৯০০০ সালে অস্তিত্বমান ছিল। সেসময়ই জেরিখোর চারপাশে ১২ ফুট উঁচু, ৬ ফুট চওড়া দেয়াল গড়া হয়েছিল, যা তুলে ধরে অসাধারণ ও অভূতপূর্ব আত্মরক্ষামূলক স্থাপত্য শৈলীর কীর্তি। বাইবেল এর মতে, জেরিখোতে দেয়ালের বিকাশ ঘটে। এই শহর, পরবর্তীতে অ্যালেক্সান্ডার দ্য গ্রেট এর ব্যক্তিগত ভূসম্পত্তিতে পরিণত হয়, এবং হেরোদ- সেই হেরোদ- শহরটিকে মুক্ত করেছিল ক্লিওপেট্রার কাছ থেকে, যাকে উপহার হিসেবে এই শহর দান করেছিলেন মার্ক এন্থনি।

যদিও জেরিখো শহর সুক্ষভাবে একটি “ ক্রমাগত অধ্যুষিত “ শহর হিসেবে পরিচিত, তবুও বেশ কয়েক শতক ধরে এই শহর পরিত্যক্ত ছিল। লেবাননের ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে অবস্থিত বিবলোস সম্ভবত প্রথম ফিনিশিয়ান শহর, যার প্রতিষ্ঠাকাল খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ সাল- জেরিখোর মত প্রাচীন শহর না হলেও খ্রিস্টপূর্ব ৫,০০০ সাল থেকে জন অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিতি লাভের দাবীদার।

এক সময় দামেস্ক শহরকে অবিতর্কিতভাবে সবচেয়ে পুরনো শহর হিসেবে ধরা হত। সিরিয়ার দক্ষিন-পশ্চিমে দামেস্ক অবস্থিত। বাইবেলের আদিপুস্তকে এই শহরের উল্লেখ আছে এবং এই শহরের প্রতিষ্ঠাকাল খ্রিস্টপূর্ব ৯০০০ সাল হওয়ার প্রমাণাদিও রয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমানে যে দামেস্ক শহর রয়েছে, খ্রিস্টপূর্ব দুইহাজার বছর পর্যন্ত বিশেষ কোন কার্যক্রমের প্রমাণ পাওয়া যায়নি- অনেকটা ওয়েস্ট ব্রোমউইচ এর মত যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বারমিংহাম প্রতিষ্ঠার ৭ শতক আগে। আরমেনিয়ানদের আগমনের আগ পর্যন্ত দামেস্ক গুরুত্বপূর্ণ কোন শহর হিসেবে বিখ্যাত ছিল না। মূলত মেসোপটেমিয়ার  আরমেনিয়ান যাযাবরেরা দামেস্কে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পর থেকে এই শহরের সার্বিক উন্নতি ঘটে।

দামেস্ক
দামেস্ক

তবে আশ্চর্যজনকভাবে দামেস্ক নয়, অনুসন্ধানের ফলে পাওয়া প্রমাণসমূহ বিবেচনা করলে সিরিয়ার সবচেয়ে বড় শহর আলেপ্পোকেই পৃথিবীর সবথেকে প্রাচীন শহর হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। গরিব এবং কুসংস্কারোচ্ছন্ন আলেপ্পো, একসময় ছিল কায়রো এবং কনস্টান্টিনোপল( বর্তমান ইস্তাম্বুল) এর সবথেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী।প্রাপ্ত প্রমাণ থেকে ধারণা করা যায় যে, এই শহর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ সালে। কিন্তু শহরের উত্তরে খনন চালিয়ে এই তথ্য পাওয়া যায় যে, শহরে বিচরণকারী যাযাবরেরা তারও ৫০০০ বছর আগে সেই জায়গায় বসতি গড়েছিল।

লিখিত বিবরণী থেকে জানা যায় যে, দামেস্ক এর অনেক আগে থেকেই গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল আলেপ্পো। শুধুমাত্র সুয়েজ খাল চালু হবার পর থেকে আলেপ্পো গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যিক শহরের তালিকা থেকে বাদ পরে। সাম্প্রতিক গৃহযুদ্ধের আগ পর্যন্ত শহরের প্রাচীন দুর্গ-যেগুলো খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দীর অস্তিত্বের ধারক, মসজিদ এবংমধ্যযুগীয় হাম্মামগুলো সংরক্ষনের প্রচেষ্টা লক্ষনীয় ছিল। এর বেশিরভাগই এখন ধুলায় মিশে গেছে এবং আলেপ্পো পরিণত হয়েছে ভাঙ্গা পাথরের রাজত্বে।

পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো শহর সত্যিকার অর্থে কোনটি তা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের হয়ত কখনই অবসান ঘটবেনা। এই তর্ক অনেক দিনের পুরনো। নতুন নতুন তথ্যেরও সন্ধান মিলছে প্রতিনিয়ত। তবে এখন পর্যন্ত যে সকল তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে তা বিবেচনা করলে পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর হিসেবে আলেপ্পোকে ঘোষণা করা হলে ভুল কিছু হবেনা- বলা চলে, এই উপাধি আলেপ্পোর প্রাপ্য।

 

Source: www.theguardian.com  

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More