পৃথিবী সৃষ্টির গোড়ারদিকে ভাষা কি মানুষ তা জানতো না। তাই বলে কি মানুষ তার ভাবের আদান প্রদান করতো না? হ্যাঁ মানুষ তখন ইশারায় তার ভাবের আদান প্রদান করতো। বিশ্বে প্রায় ৫ হাজারের বেশি ভাষা প্রচলিত আছে। আর সেইসব ভাষার উদ্ভব হয়েছে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে। কিন্তু পৃথিবীতে এত ভাষার মধ্যে কোনটা প্রথম কিংবা সর্বপ্রাচীন তা নিয়ে চলছে বেশ আলোচনা -সমালোচনা ও গবেষনা। কেউই এখন পর্যন্ত বলতে পারছেন না কোনটা পৃথিবীর আদি ভাষা। বহুভাষাবিদরা বহু ভাষার উপর গবেষনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, কোন ভাষা অন্য সব ভাষার আগে এসেছে তা একমাত্র বিভিন্ন যুগের পাঠ্য থেকে বিভিন্ন পুরনো স্থাপনা থেকে পাওয়া সম্ভব হবে। বিভিন্ন আদি নিদর্শন থেকে পাওয়া গবেষনায় এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর ১০টি সর্বপ্রাচীন ভাষার প্রমান পাওয়া গেছে। আর বিশ্বের অন্যতম দশটি ভাষা নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন :
১. আরবী ভাষা :
আরবী ভাষা যদিও আরব দেশগুলোতে প্রচলিত তবুও এর শ্রুতা অনেক।বিশ্বের প্রায় ২৮ টি দেশে আরবী ভাষার শ্রুতা আছে। বিশ্বে আরবী ভাষায় কথা বলেন প্রায় ৪২০ মিলিয়ন লোক যা শুনতে খুবই অবিশ্বাস্য লাগবে। এই ভাষার প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় ৫১২ সি-ই তে। আরবী ভাষার প্রচলন শুরু হয় লৌহযুগ থেকে আর সেইসময় থেকেই লোকেরা এই প্রাচীন ভাষায় কথা বলা শুরু করেন।

Source: Madeenah.com
আরবী ভাষা এখন আরব দেশগুলোর সরকারী ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।আরবী ভাষায় কথা বলেন বা বলতে পারেন এমন লোকেরা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। প্রত্যেক ভাষার মতো আরবী ভাষারও উপভাষা এবং শাখা রয়েছে। আধুনিক আরবী ভাষা সরাসরি কোরান থেকে এসেছে। আর কোরানের ভাষা ছিল ক্ল্যাসিকাল ভাষা। এই ভাষাই আধুনিক আরবী ভাষার মানের ভিত্তি ।
২. হিব্রু ভাষা :
হিব্রু ভাষার বয়স প্রায় ৩ হাজার বছরের মতো। বিশ্বে হিব্রু ভাষায় কথা বলেন এমন লোকের সংখ্যা প্রায় ৯ মিলিয়ন। যখন ইহুদীরা গত দুই শতাব্দী ধরে ইসরাইলের জন্য আন্দোলন করে তখন হিব্রু ভাষা ইসরাইলের সরকারী ও জাতীয় ভাষা হয়ে ওঠে। বর্তমানে বিশ্বের অন্যসব ভাষার মতো হিব্রু ও প্রাচীন ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

Source: Quora
বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ইহুদীরা এই ভাষায় কথা বলে। যদিও আধুনিক হিব্রু সামান্য ভিন্ন ইদিশের প্রভাবের জন্য। ইদিশ হচ্ছে ইহুদীদের আরেকটা ভাষার নাম। তবুও প্রায় সব ইহুদীরা ভালোভাবে পড়তে ও বুঝতে পারেন বাইবেলের দুই খন্ডের এই একখন্ডকে অবিকল ভাবে।
৩. তামিল ভাষা :
তামিল সম্ভবত পৃথিবীর পুরাতন ১০টি ভাষার মধ্যে অন্যতম একটি ভাষা। বিভিন্ন আদি নিদর্শন ও নথি থেকে প্রমান পাওয়া যায় যে, প্রায় ২হাজার বছর আগ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এই প্রাচীন ভাষার ব্যবহার লোকেরা করে আসছে। এখনো পর্যন্ত এই দ্রাবিড়িয়ান ভাষা দক্ষিন ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে।

Source: B3 – ZCubes
এছাড়াও এই ভাষা শ্রীলংকা ও সিংগাপুরের সরকারী ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৭০ মিলিয়ন লোক তামিল ভাষায় কথা বলে। তাছাড়াও এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম ক্ল্যাসিকাল ভাষা হিসেবে টিকে আছে। তামিল ভাষা তিনটি শ্রেনিতে বিভক্ত আর এই তিনটি শাখা হচ্ছে যথা ১.ক্ল্যাসিকাল তামিল ২.আধুনিক তামিল ৩.আঞ্চলিক তামিল। আর এই তিনটি শাখাই বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে।
৪. ফার্সি ভাষা :
ফার্সি ভাষা পৃথিবীর পুরনো অন্যসব ভাষার মতোই অন্যতম এক ভাষা।বিশ্বে ফার্সি ভাষায় কথা বলেন এমন লোকের সংখ্যা প্রায় ১১০ মিলিয়ন লোক। রাজনৈতিক কারন বশত আফগানিস্তানে এটাকে দারি নামে ডাকা হয়, তাজিকি নামে তাজিকিস্তানে ডাকা হয়। যাইহোক এই ভাষা তিনটি দেশে সামান্য পরিবর্তন হলেও এর প্রয়োজনীয়তা অনেক।

Source: Quora
শেষ শতকে এসে এটা বিবেচনাযোগ্য যে এই ভাষা অন্য ভাষাদের প্রভাবিত করছে। বিশেষ করে উর্দুকে। ফার্সি সাহিত্য, পদ্য,গদ্যের ব্যাপক ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। তাছাড়া এই ভাষায় পণ্ডিত ও বিভিন্ন ভাষাবিদরা চর্চা ও গবেষনা করেছেন।
৫.চীনা ভাষা :
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষের ভাষা হচ্ছে চীনা ভাষা। পৃথিবীতে প্রায় ১২০ কোটিরও বেশি লোক চীনা ভাষাকে তাদের নিজের প্রধান ভাষা হিসেবে মনে করেন। ধারনা করা হয় ১২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে শাং সাম্রাজ্যের শেষের দিকে এই ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।

Source: LIGHTINCHINA
সমসাময়িক ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে চীনা ভাষাকে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ভাষা হিসেবে মনে করা হয়। চীন, তাইওয়ান, সিংগাপুর ও দক্ষিন এশিয়ার কিছু অঞ্চলের লোক চীনা ভাষায় কথা বলে। একজরিপে দেখা যায় যে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৬ ভাগ লোক চীনা ভাষায় কথা বলে।
৬. বাস্কো ভাষা :
বাস্কো ভাষাটি ইউরোপের অন্যান্য ভাষা থেকে স্বতন্ত্র্য একটি ভাষা । স্পেনের উত্তরদিকের ও ফ্রান্সের দক্ষিন-পশ্চিম দিক অঞ্চলের একটি অদিবাসীদের ভাষার নাম হচ্ছে বাস্কো। অন্যান্য ভাষার সাথে বাস্কোর কোন মিল নেই। বর্তমানে এই ভাষায় কথা বলে এমন লোকের সংখ্যা প্রায় ৭৫১৫০০। এটা বলা যায় যে, বহুপ্রাচীন ভাষা হিসেবে প্রাক-ইন্দো-ইউরোপীয় যুগ হতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দ্বন্ধের মধ্যেও এখন পর্যন্ত এই ভাষাটি বিশ্বের বুকে টিকে আছে। এই ভাষা কোথা থেকে উৎপত্তি হয়েছে তা দেখানোর মত কোন অকাট্য দলিল নেই। যাইহোক শেষ সময়ে এসে এই ভাষাটি নিজে প্রভাবিত হয়েছে এবং অন্যান্য রোমান ভাষাদের ও নিজে প্রভাবিত করেছে।
৭.আইরিশ গেইলিক :
আইরিশ গেইলিক আয়ারল্যান্ডের স্থানীয় সংখ্যালঘুদের ভাষা। এটা উৎপত্তি হয়েছে ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষার সেলটিক শাখা হতে। যীশুখ্রীষ্টের জন্মের চার শতক পরে আদিম আইরিশরা এই ভাষার লৈখিকতার উন্নয়ন করেন। ল্যাটিন ভাষা আবির্ভাবের অনেক আগে অনেকেই এটাকে বিশ্বের প্রথম কথ্য ভাষা হিসেবে বিবেচিত করে। বর্তমানে আইরিশরা এই ভাষাকে আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্রের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এছাড়া ও আইরিশরা এই ভাষাকে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সংখ্যালঘুদের জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
৮.গ্রীক ভাষা :
যীশুখ্রীষ্টের জন্মের প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বে এই ভাষার গোড়াপত্তন হয়েছে বলে মনে করেন বিভিন্ন ভাষাবিদরা। এই ভাষার রয়েছে প্রাচুর্যময় ইতিহাস। একসময় বিশ্বের বিখ্যাত দার্শনিক, পন্ডিত এবং বড়বড় শিক্ষাবিদরা এই ভাষাতেই তারা লিখতেন, পড়তেন, ভাবতেন।

Source: Best Of Greece
পৃথিবীর অন্যসব প্রাচীন ভাষার মতো গ্রীক ভাষা একটি শ্রেষ্ঠ ভাষা হিসেবে আজও ধরত্রীর বুকে টিকে আছে। এটি গ্রীস ও সাইপ্রাসের সরকারী ভাষা। বর্তমানে গ্রীস ও সাইপ্রাসের প্রায় এককোটি তিরিশ লাখ লোক এই ভাষাতেই কথা বলেন। এছাড়াও এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সরকারী ভাষাও বটে।
৯. লিথুয়ানিয়ান :
যখন অধিকাংশ ইউরোপিয়ান ভাষাগুলো ইন্দো-ইউরোপীয়ানের শাখা হতে এসেছে তখন অনেক বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান বিভাগ থেকে এই প্রাচীন ভাষার উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করা হয়, যা এখনো বিশ্বের বুকে প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা হিসেবে টিকে আছে। এই ভাষাকে অত্যধিক রক্ষনশীল বাল্টিক ভাষাও বলা হয়। বিশ্বে এই ভাষায় কথা বলেন প্রায় ৩ মিলিয়ন লোক। এই ভাষায় আদি যুগের বৈশিষ্ট্য এখনো পাওয়া যায় যেমনটা প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার মতো। এটা লিথুয়ানিয়ার সরকারী ভাষা ও পোল্যান্ডের সংখ্যালঘুদের সরকারী ভাষা হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে।
১০. ল্যাটিন ভাষা :
ল্যাটিন ভাষাটি সংস্কৃতি,কলা ও ইতিহাসের প্রতিনিধিত্ব করে। খ্রীষ্টের জন্মের আনুমানিক ৭৫০ বছর পূর্বে এই ভাষার গোড়াপত্তন হয়েছে বলে মনে করেন বিভিন্ন ভাষাবিদরা। ল্যাটিন একটি ক্ল্যাসিকাল ভাষা যা ইন্দো -ইউরোপীয় শ্রেনিভুক্ত। এটি অনেক ইউরোপীয় ভাষার মূল ও আদি উৎস। এই প্রাচীন ভাষাটি রোমান সাম্রাজ্যে কথ্য ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হতো তাই এই ভাষাকে প্রাচীন লেখ্য ও কথ্য ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

Source: Omniglot
পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আজও এই ঐতিহ্যবাহী ভাষাটি তার অস্তিত্ব বজায় রেখে চলছে। এটি ভ্যাটিকান সিটির সরকারী ভাষা। এই ভাষায় খ্রীষ্টীয় ধর্মযাজক ও পাদ্রীগন সাবলীল ভাবে কথা বলতে পারেন। এছাড়াও এটি পোল্যান্ডের সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তাছাড়া এই ভাষায় শিক্ষা অর্জনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই বিষয়ে কোর্স চালু করেছে।