তাম্মাম আযযাম একজন সিরিয়ান আর্টিস্ট ৷ তাঁর জন্ম সিরিয়ার দামেস্কে ১৯৮০ সালে ৷ তিনি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অনুষদে তৈলচিত্রের উপর অধ্যয়ন করেন ৷ সিরিয়ায় একজন সফল চিত্রশিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার পাশাপাশি তিনি একজন উদীয়মান গ্রাফিক্স ডিজাইনার ছিলেন ৷ এই অভিজ্ঞতাই তাঁকে ডিজিটাল মিডিয়ায় একজন শিল্পী হিসেবে কাজ করতে উৎসাহিত করেছে যখন তিনি সিরিয়া যুদ্ধের কারণে নিজ দেশ থেকে দুবাইয়ে চলে গেলেন ৷
আযযামের কাজের প্রাথমিক দিকটি হলো তিনি তাঁর শিল্পকর্মে অভিযোজন করেন এমন সব চিত্রকর্মের যা মানুষ সহজেই অনুধাবন করতে পারে, যেগুলো মানুষ খোলাচোখে প্রতিনিয়ত দেখছে সেই সব বিষয়ে গভীর চিন্তার উদ্রেক ঘটায় তাঁর চিত্রকর্ম ৷
সিরিয়া সংকটের শুরুর দিকে, আযযাম আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে সিরিয়ায় ঘটা নির্মম ঘটনা সমূহের চাক্ষুষ প্রমাণ দিতে ডিজিটাল মাধ্যম ও গ্রাফিক আর্ট ব্যবহার করেন ৷ তাঁর ঐ সমস্ত কাজ গুলো ব্যাপকভাবে সারা বিশ্বে সমাদৃত হয় যা ডিজিটাল মিডিয়া ও গ্রাফিক আর্টে তাঁর উদ্ভাবনী সৃজনশীলতা ও আগ্রহকে নির্দেশ করে ৷ তিনি অদ্ভুত সব বিষয়গুলো সবার সামনে এনেছেন তাঁর ডিজিটাল আর্ট ও পথ শিল্পের মাধ্যমে, যা শক্তিশালী প্রতিবাদের মাধ্যম ৷ কারণ এগুলো সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছে যায় এবং এই প্রতিবাদ গুলো দমিয়ে রাখা যায় না ৷ ২০১৩ সালের শুরুর দিকে আযযাম সাড়া বিশ্বের শিরোনামে পরিণত হন তাঁর “ফ্রিডম গ্রাফিতি” শিল্পকর্মের জন্য, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে ভাইরালে পরিণত হয় ৷ সম্প্রতি তিনি তাঁর আঁকা ছবিতে এমন সব চিত্ররূপ ব্যবহার করেছেন যা মানুষকে এক অনন্য চিত্রকল্পের দিকে মনোনিবেশ করতে তাড়িত করে ৷ তাঁর ক্যানভাসের শিল্পকর্ম তাকে পরিচয় করিয়েছে বিধ্বংসী এক বিশাল জগৎ এর সাথে , যা থেকে বাদ যায়নি তাঁর স্বদেশ সিরিয়া ৷ দামেস্ক শহরের যুদ্ধ বিধ্বস্ত দালানকোঠাই হয়ে উঠেছে তাঁর ক্যানভাসের প্রাণ ৷
গোস্তাভ ক্লিমটের বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্যা কিস’ কে অভিযোজন করে দামেস্কের একটি আবাসিক ভবনের সামনে আঁকা সোনালী হলুদ রঙ্গের চিত্রটিকে নবরূপ দান করেছেন যা এখন বুলেটের আঘাতে হয়েছে ধূসর কালো এবং ক্ষতবিক্ষত ৷ ২০১৪ সালের শুরুর দিকে, এই ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে “ফ্রিডম গ্রাফিতি” শিরোনামে ছড়িয়ে পড়ে ৷ ঐ সময়, কিছু লোক বিশ্বাস করেছিল, কেউ হয়তো সিরিয়ার আবাসিক ভবনের দেওয়ালে ঘনিষ্ঠ চুম্বন দৃশ্যটি এমনিতেই এঁকেছেন ৷ যাইহোক, মানুষ দেেখছিলো তাম্মাম আযযামের সত্যিকার ‘ফোটোমনটেজ’ চিত্রটি ৷ ‘ফ্রীডম গ্রাফিতি” হচ্ছে “সিরিয়ান মিউজিয়াম” ফটো সিরিজের জন্য তার দীর্ঘমেয়াদী কাজের একটি অংশ ৷
তাম্মাম আযযাম, দক্ষ একজন চিত্রশিল্পী, আর্ট শিখেছেন দামেস্ক থেকে ৷ গম্ভীর এই চিত্রশিল্পী বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে আমি উদ্ভাবন করেছি অনেক নতুন নতুন পদ্ধতি ৷এসব ছাড়াও আমি স্থাপনার কাজে ব্যবহৃত বস্তু সামগ্রী ব্যবহার করে শিল্পকর্ম তৈরি করতে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছি কিন্তু আমি অধিক পছন্দ করি ক্যানভাসে আঁকা তৈলচিত্র ৷”
সিরিয়া বিদ্রোহ তাম্মামের জীবন ও কাজ সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে ৷ বিদ্রোহ শুরুর মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর ২০১১ তিনি নোটিশ পান এবং বাধ্য হন সিরিয়ান নিয়মিত সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে ৷ ঐসময় ,এই চিত্রকর বাস করতেন দামেস্কে ৷
তাম্মাম আযীম বলেছেন, ” বিশ্ব যদি সিরিয়ায় আসতে না চায় , তাহলে সিরিয়াই পুরো বিশ্বের কাছে যাবে এবং দেখাবে এখানে এখন ঠিক কি ঘটেছে “৷ অনেক সিরীয়দের এমন জায়গাও নেই যেখানে তারা ফিরে যাবে ৷ ৷তারা যেখানে বাস করতো শুধু সেখানেই নয়, পুরো সিরিয়া তার রূপ হারিয়েছে ৷ তারা এখন শুধুমাত্র আমাদের কল্পনার মধ্যে বাস করছে ৷তাম্মাম আযযামের শিল্পকর্মগুলো চিন্তার দ্বার খুলে দেয় এবং গভীর অর্থ প্রকাশ করে ৷ যদি দর্শনার্থীরা গভীরভাবে চিন্তা করে তাহলে দেখতে পাবে আন্তর্জাতিক শক্তিকেন্দ্র গুলোও হুমকির মুখে আছে ৷ “বিশ্বের ক্ষমতাবান শক্তিগুলোও সিরিয়ায় গণহত্যা বন্ধের একের পর এক সুযোগ হারিয়েছে ৷” , তাম্মাম আরও বলেন, “তারা নিজেদের এক গভীর নৈতিক সংকটে নিপতিত করেছে ৷”
সিরিয়ার সম্ভাব্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আযযামের ভাবনা কোন আশার আলো দেখায় না ৷ আযযাম প্রকৃতপক্ষে এই যুদ্ধের কোন শেষ দেখতে পাচ্ছেন না, কোন ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করার মতো বিশ্বাস তাঁর নেই ৷ “মৃত্যুই একমাত্র সত্য ৷”
” আমি, একজন সিরিয়ান ” হচ্ছে একটি একক চিত্র প্রদর্শনীর কাজ যা আযযাম করেছিলেন ২০১৪ সালে লন্ডন ও লিবিয়াতে ৷ ২০১৪ সালের গ্রীষ্ম পর্যন্ত তিনি উত্তর আমেরিকা, এশিয়া, ও ইউরোপে তাঁর ব্যক্তিগত কাজ প্রদর্শন করেন ৷ দুবাইয়ে নতুন স্টুডিও নির্মাণের পর তিনি পুনরায় পেইন্টিং এ মনোনিবেশ করার পরিকল্পনা করেন ৷
এক সাংবাদিক আযযামকে প্রশ্ন করেছিলেন, “অনেক বেশি বিনাশ কি অনেক বেশি সৃষ্টিশীলতার পেছনের কারণ?”
উত্তরে তাম্মাম আযযাম বলেছিলেন, “সম্ভবত, এটা আপনার দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে ৷ ” কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে শিল্পীরা চায় তাঁদের বাস্তবতাকে ধারণ করতে যা তাঁরা দেখে ৷ “হ্যাঁ, আমি সিরিয়ান, কিন্তু আমি কারো মাউথপিচ না ৷ একজন শিল্পী হিসেবে আমি শুধুমাত্র আমার মনোভাবই ব্যক্ত করি ৷ আমি চাই দর্শকদের ভাবাতে এবং চাই তাঁরা প্রশ্ন করুক ৷ সম্ভবত এমন রঙিন ক্যানভাস সত্যিই কোথাও আছে এবং যুদ্ধের আগে সিরিয়া কি এমনই ছিল না ? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, সিরিয়ার বিশাল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিলও যার আংশিক ধ্বংস হয়েছে অথবা পুরোপুরিই আসন্ন ধ্বংসের মুখে ৷ ”
তাম্মাম আযযাম ও তাঁর পরিবার অন্ততপক্ষে একটা নিরাপদ জায়গা পেয়েছে দুবাইতে বাস করার জন্য এবং কাজ করার জন্য ৷ কিন্তু তাঁদের মনে সব সময় সিরিয়ার সেই অসহায় মানুষদের ছবি ভাসে, ধ্বংসযজ্ঞের কথা ভেবে তাঁরা চরম অসহায় বোধ করেন ৷
“সিরিয়ায় বিদ্রোহের কারণে আমি একজন আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত শিল্পী হয়েছি ৷ মোটের উপর, তথাকথিত আরব বসন্তের কারণে পশ্চিমা ও আরব শিল্পীদের মাঝে সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে ৷ মানুষ ইদানীং আমাদের লক্ষ্য রাখে, আমাদের কাজ সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখে ৷” দ্বিধাহীন ভাবে বলেন আযযাম ৷
“যাহোক, বলতে গেলে, আমাদের শিল্পীদের কোন শক্তি নাই ৷ দেখুন, আমরা তো কতো সৃজনশীল বিষয় তৈরি করি, শৈল্পিক মন্তব্য করি কিন্তু এই সব আসলে কোন পরিবর্তনই বয়ে আনে না সিরিয়ার মানুষদের জন্য ৷ ”
মাঝেমাঝে তিনি নিজেকে অনুভব করেন একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হিসেবে, “কিভাবে আপনি নিজের মাঝে শিল্পকে লালন করবেন যখন সিরিয়াতে একদিনেই দুইশত মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে ? যেহেতু, আমরা শিল্পীরা বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করি কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহ, রাজনীতি শিল্পকে দাড়ানোর সুযোগ দেয় না ৷”
সে সাই হোক, তাম্মাম আযযাম বললেন, তিনি একটা অবস্থান দখল করতে চান ৷ ৷আরেকটা ফটোমনটেজ(একাধিক আলোকচিত্র একসাথে করে তৈরি করা নতুন ছবি) সিরিজ যা “সিরিয়ান মিউজিয়াম” সিরিজের সাথে যুক্ত হবে, তা হলো বোমা বর্ষণে বিচ্ছিন্ন, আলাদা বিধ্বস্ত একটা বাড়ি যা তার মূল কাঠামো হতে সম্পূর্ণ বদলে গেছে ৷ যেই বাড়িটি একগুচ্ছ রঙিন বেলুনের মাধ্যমে শূন্যে ভাসিয়ে নিচ্ছে ৷
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আযযাম কিছু একক ও যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ৷ যেমন, বাইয়েনাল ডেল সূর,ক্যারাকাস (২০১৭), ফর-সাইট ফাউন্ডেশন, সানফ্রান্সিসকো (২০১৬, ২০১৭), ইউরোপিয়ান ক্যাপিটাল অফ কালচারাল প্যাফোস, প্যাফোস (২০১৭), সিটি মিউজিয়াম অফ অডেনবার্গ, ওলডেনবার্গ (২০১৭), কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নিউইয়র্ক (২০১৬), আইয়াম গ্যালারি-১১, দুবাই (২০১৬), ১×১ আর্ট গ্যালারি, নিউ দিল্লি (২০১৪) সহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তাঁর চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়েছে ৷
তাঁর জনপ্রিয় কাজগুলো মাঝে আছে, “দ্যা রোড “, “ইউনিভার্স”, “ব্রেকিং নিউজ”, তবে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন
তুলেছিল “ফ্রিডম গ্রাফিতি ” যার মাধ্যেমে সারা বিশ্বে তিনি সমাদৃত হন ৷