ঢাকা বেশ প্রাচীন এক নগরী। আমরা বর্তমানে ঢাকা বলতে যেই ব্যস্তময় , যান্ত্রিক নগরী কল্পনা করি পূর্বে মোটেও এমনটি ছিল না।বলা হয়ে থাকে যে , প্রায় দেড় থেকে দুইশো আগেও এই ঢাকা ছিল নোংরা, অস্বাস্থ্যকর । কিন্তু বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে এই নোংরা চেহারাটা ঢাকা পড়ে যেত , বদলে যেত ঢাকা শহরের চেহারা। এর মূলে ঈদ,মুহররম এবং জন্মাষ্টমী –এই উৎসবগুলো ছিল।
এই উৎসব গুলো ছিল ঢাকার প্রধান উৎসব যা খুব জাঁকজমকভাবে পালন করা হতো।এই তিনটি উৎসবই ধর্মীয় উৎসব কিন্তু মুহররম এবং জন্মাষ্টমী, এই উৎসব দুইটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছিল।এই তিনটি উৎসবের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল –মিছিল।

ঈদ
মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হল ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আযহা। আমাদের দেশে এই উৎসব দুইটি খুব ধুমধাম ভাবেই পালন করা হয়। ‘ইসলামী পার্বণের সামাজিক নৃতত্ত্ব’ নামক প্রবন্ধে প্রবন্ধকার বাহারউদ্দিন বলেছেন যে, ‘ঈদ ,সওম এবং রমজানের মূল অর্থ তাদের উৎসভূমির ভিত্তিতেই অনুমান হয় রোজার উপবাস জন্ম দিয়েছে কৃষিনির্ভর সমাজে হয়ত বা প্রাচীন সিরিয়ায়।‘
পবিত্র রমজান মাসের শেষে আসে ঈদ –উল-ফিতর।ঢাকার রোজা এবং ঈদ –এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল খাবার।ইফতারির জন্য চকবাজার ছিল বিখ্যাত যার ঐতিহ্য বর্তমান সময়েও বিদ্যমান ।
ঈদের সময় এই নগরীতে ঈদের মিছিল বের হতে দেখা যেত আর ঈদের দিন নগরবাসীর জন্য ঈদের মিছিলই ছিল প্রধান আকর্ষণ।নায়েব-নাজিমরা খুব আড়ম্বরের সাথে মিছিল বের করতেন এবং অংশগ্রহণও করতেন।নায়েব-নাজিম বসতেন হাতির পিঠে , অভিজাত বংশীয়রা বসতেন পালকিতে।একদল মানুষ রঙ্গিন কাপড়ের পতাকা বহন করত ।রঙ্গিন এবং কারুকার্য করা ছাতা বহন করত
ছাতাবাহকরা।আর মিছিলের সামনে পিছনে থাকত বাদ্য বাদকের দল।ধারণা করা হয় যে, জন্মাষ্টমীর মিছিল থেকেই অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল ঈদের মিছিল। কেননা, পূর্বে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে জাঁকজমকপূর্ণ মিছিল বের করা হত।
পবিত্র ঈদ- উল- আযহা বা কোরবানির ঈদ হজ্জ ব্রতের যুক্ত।তবে আমরা বর্তমানে যেভাবে কোরবানির ঈদ পালন করি তা চল্লিশ- পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস মাত্র।পূর্বে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক বিরোধিতার কারণে ধুমধাম করে পালন করা যেত না। বাংলাদেশে এই উৎসব দুটি যেভাবে পালিত হতো তা এই দেশের কৃষিজীবী মানুষের লোকায়িত বিশ্বাসে প্রভাব ফেলেছিল।মুসলমানরা এই দেশে বহিরাগত এবং হয়ত এই কারনেই মুসলমানদের উৎসবে হিন্দু রীতিনীতির প্রভাব বেশি ছিল।বিভিন্ন বই থেকে জানা যায় যে, পূর্বে এই উৎসব দুটি বড় কোন ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালন করা হয় নি। তবে এসকল কথার ঊর্ধ্বে হল- ঢাকায় মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। উভয়ে উভয়ের ধর্মীয় অনুভতিতে আঘাত দিত না এবং উৎসবে অংশগ্রহণ করত।

মুহররম
বাংলাদেশে মুহররম-এর প্রধান কেন্দ্র ছিল ঢাকা। ঢাকার জীবন পদ্ধতি ও সংস্কৃতির উপর ইরানীদের আংশিক সংস্কৃতি অনেকাংশে প্রভাব বিস্তার করেছিল।যদিও মুহররম শোকের মাস ,বাংলাদেশে তা পরিণত হয়েছিল উৎসবে । এর প্রবর্তক মূলত ইরানের শিয়ারা। মুঘল আমলে ঢাকায় শিয়াদের ব্যাপক আধিপত্য ছিল। তাছাড়া ঢাকা ছিল নায়েব নাযিমদের বাসস্থান । এই উৎসবের কেন্দ্র ছিল শিয়া সম্প্রদায়ের ইমারবাড়ি- হুসেনী দালান।মুহররম-এর ৮ম দিনে হুসেনী দালান থেকে একটি মিছিল বের হত।আলম মুসাওয়ার নামে এক শিল্পী ঢাকার মুহররম ও ঈদ এ বের হওয়া মিছিলের ৩৯ টি ছবি এঁকেছেন, যা দেখলে বুঝা যায় নবাবি আমলের মিছিলের বর্ণাঢ্য রূপ ,ব্যাপকতা।
‘জাদু’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছিল-মুহররমের অনুষ্ঠান শুরু হতো চাঁদ উঠার পর। এরপর থেকে নহবৎ বাজানো শুরু হত, মজলিস শুরু হত।১ম তিন রাত হুসেনী দালানের প্রাচীরে জ্বালানো হতো অসংখ্য মোমবাতি।৪র্থ দিনে যে ভাতিয়ালি মার্সিয়া শুরু হতো তাতে শিয়া,সুন্নি দুই সম্প্রদায়ই যোগ দিত।৫ম দিনে ভিস্তিরা মিছিল বের করত এবং ৬ষ্ঠ দিনে তারা হুসেনী দালানে গিয়ে তাদের লাললাঠি গুলো মাঠে কাঁচির মত রেখে দিত। ৭ম দিনে আলো দিয়ে হুসেনী দালান সাজানো হতো। ৮ম দিন বিকেলে বের হতো মিছিল।৯ম দিনেও অনুষ্ঠান শুরু হতো বিকেলে। ১০ম দিন অর্থাৎ আশুরার দিন আজিমপুরে বসতো বিরাট মেলা (এখনো এসব লুপ্ত হয়ে যায় নি)। তবে বর্তমানে কিছু রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠানে সামান্য কিছু পরিবর্তন এসেছে ।

জন্মাষ্টমী
জন্মাষ্টমী ঢাকা নগরীর প্রাচীন একটি উৎসব।জন্মাষ্টমীর সময় ঢাকায় যে বিশাল মিছিল বের হতো ,তা সারা বাংলায় বিখ্যাত ছিল এবং এতে কমবেশি সব সম্প্রদায়ের মানুষই অংশ নিত।মিছিল গুলো এতটাই জাঁকজমকভাবে পালন করা হতো যে, এই মিছিল দেখার জন্য এবং এতে অংশ নেয়ার জন্য অনেক দুরাঞ্চলের মানুষজন ঢাকায় এসে ভিড় করত।তখন এই ঢাকা নগরী পরিণত হতো উৎসব নগরীতে।অনেক পূর্বের ঢাকার এক সংবাদপত্র থেকে জানা গেছে যে,তামাসায় কতগুলো বড়চৌকি, ছোটচৌকি,হাতিঘোড়া ও পদাতিকের মিছিল বের হতো। বড়চৌকি ছিল তামাসার প্রধান অংশ , যেখানে পৌরাণিক প্রতিমূর্তি প্রদর্শিত হত। আর ছোটচৌকিতে নাচ ও বিভিন্ন প্রকার সঙ্গ বের হত।তবে এসব কিছুই এখন কেবল এক স্মৃতি মাত্র। কেননা এখন আর এভাবে জমকালো উৎসব বের হয় না।মিছিল কবে লুপ্ত হয়েছিল ,সেই সময়টা নির্দিষ্টভাবে জানা যায় নি।বলতে গেলে, এখন আর তেমন জন্মাষ্টমী পালিত হয় না। তবে অনেকে ব্যক্তিগত ভাবে পালন করে। এছাড়াও বেশ কয়েক বছর ধরে, পুনরায় জন্মাষ্টমীর উৎসব পালন করা হচ্ছে।
তাছাড়াও হোলি ও ঝুলন ঢাকার বড় উৎসব হয়ে উঠেছিল। এই উৎসবে সব সম্প্রদায়ের লোকেরা উৎসাহের সাথে যোগ দিত।দোলযাত্রার সময় উর্দুতে হোলির গান রচিত হতো। সাথে আবির বা ফাগ মাখানোও চলত।হোলি ছাড়া এমন আড়ম্বরের সাথে ঝুলন ও বনবিহার পালিত হতো।ঝুলনের সময় তিনদিন ধরে নাচ,গান,কীর্তন,যাত্রা ও সেতারের আসর চলত শহরের ঠাকুর বাড়িগুলোতে।আর শ্রীকৃষ্ণের বনবিহার উৎসব জমত লালমোহন সাহার বাড়ির কাছে মৈশুণডিতে। অন্যান্য উৎসব যেমন ধর্মীয় গণ্ডি ছাড়িয়ে সার্বজনীন হয়ে উঠেছিল, ঝুলন উৎসবটি তা পারে নি।এই উৎসব লুপ্ত হয়েছিল,বাবু কালচারের পৃষ্ঠপোষকদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার সাথে।