আগ্রার যমুনা নদী দিয়ে যুগে যুগে জল গড়িয়েছে অনেক। স্রোতের প্রবাহের সাথে পাল্লা দিয়ে তাজমহলের প্রেমের স্তুতি পৌঁছে গেছে বিশাল এই দুনিয়ার প্রত্যেকটি আনাচে কানাচে। প্রেমের উত্তাল মহাসমারোহের ভেতরেও কোথা থেকে যেন একটি কালো রংয়ের স্রোতও খুবই ক্ষীণ আকারে বহমান। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই ক্ষীণকায় স্রোতপ্রবাহ প্রেমের সেই বিশালাকার ধারার সাথে কখনই পাল্লা দেওয়ার চরম ঔদ্ধত্যতা প্রকাশে সমর্থ হয়নি। তাজমহল তাইতো এখন অসীম এক প্রেমের সমার্থক শব্দ হিসাবে পরিগণিত হয়।
ইলিশ মাছ স্বাদে এবং গুণে অতুলনীয়, কিন্তু অধিকাংশ মাছের তুলনায় তার শরীরে কাঁটার পরিমাণও কিন্তু অত্যধিক বেশি। তাজমহলের তুলনাও অনেকটা ইলিশের মতই। তার বিশ্বনন্দিত প্রেমের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ঘৃণার অভিব্যক্তি।

Source: Clarks Shiraz, Agra
‘prince of builders’ খ্যাত শাহজাহানের অমর কীর্তি তাজমহল আর তার প্রেমের গল্পগুলো তো সবাই জানি, কিন্তু তাজমহলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত তীব্র ঘৃণার গল্পগুলোর কতটুকু জানি আমরা??
মুঘল সম্রাটদের মধ্যে শাহজাহান ছিলেন বেশ বিলাসী। আকর্ষণীয় স্থাপত্যের প্রতি তার শুধু ঝোঁকই ছিল না, বরং তা রীতিমত এক নেশায় পরিণত হয়েছিল। ফলাফলস্বরূপ পুরো ভারতবর্ষজুড়ে গড়ে উঠেছিল এমন সব শৈল্পিক নিদর্শন, যা এখন পর্যন্তও ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের দৃষ্টিকে ভারতের দিকে ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে।
ইতিহাসের ধূসর পাতা সাক্ষী দেয় তাজমহল নির্মাণের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয় ১৬৩২সালের প্রারম্ভে। ১৬৪৭ (মতান্তরে ১৬৫৩)এর দিকে বাস্তব রূপ লাভ করে শাহজাহানের স্বপ্নের স্থাপত্য।
আরজুমান আরা বেগমের সাথে খুররমের (যিনি পরবর্তীকালে শাহজাহান নামে পরিচিত হন)প্রথম দেখা হয় ১৬০৭ সালে। তার অপরূপ স্নিগ্ধতায় মোহিত হয়ে যান ১৫ বছর বয়সী শাহজাহান, যাকে বলে প্রথম দর্শনেই প্রেম। এরপর খুব তড়িঘড়ি করে সেই বছরেই বাগদান সম্পন্ন হয়।
আরজুমান আরার পিতৃকুল ছিলেন পারস্যের বেশ সমৃদ্ধশালী এক পরিবার। তার বাপ-দাদারা মুঘলদের দরবারে বেশ সম্মানজনক পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের পত্নী নূরজাহান ছিলেন আরজুমানের ফুফু।এসব বিবেচনায় নিয়ে বলা যেতেই পারে আরজুমান মুঘল সম্রাজ্ঞী হওয়ার জন্য একেবারে অযোগ্য ছিলেন না।
বাগদানের দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে ১৬১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয় তাদের। শাহজাহান তার নামকরণ করেন ‘মমতাজ মহল'(chosen one of the palace /pearl of the palace) নামে। নামের ভেতরেই ফুটে উঠে তার প্রতি শাহজাহানের সীমাহীন ভালবাসা।

Source: Pinterest
পরবর্তীকালে সমগ্র বিশ্বের কাছে তিনি আজও মমতাজ মহল নামেই পরিচিত হয়ে আছেন।
তবে মমতাজ কিন্তু শাহজাহানের একমাত্র পত্নী ছিলেন না। ইতিহাস সাক্ষী দেয় শাহজাহানের অন্তত আরও তিনজন স্ত্রী ছিলেন, এমনকি মমতাজের পরেও তিনি আরও একটি বিবাহে অবতীর্ণ হন। সেই যুগের সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ধারণা করা হয় রাজনৈতিক কারণেও শাহজাহান একের অধিক পত্নী গ্রহণ করে থাকতে পারেন। কোন কোন সূত্র থেকে জানা যায় যে মমতাজের নাকি আগে একবার বিবাহ হয়েছিল, শাহজাহানের হস্তক্ষেপেই নাকি সেই সম্পর্কের অবসান ঘটে এবং তারপরের গল্প আমাদের সকলেরই জানা। তবে শাহজাহান যে মমতাজকেই অন্য সবার চেয়ে অধিকতর বেশি ভালবাসতেন এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
তবে শাহজাহান যে মমতাজকেই অন্য সবার চেয়ে অধিকতর বেশি ভালবাসতেন এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তাদের দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয় ১৯ বছর। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে অসীমের পথে পাড়ি দেন ভালবাসার প্রতিমা মমতাজ মহল।
মাত্র ১৯ বছরের দাম্পত্য জীবনেই ১৪ বার বাচ্চা প্রসব করেন মমতাজ। এমনকি তার মৃত্যুও ঘটে ১৪তম বাচ্চা প্রসবকালীন সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলেই। এই তাবৎ দুনিয়ার অন্যতম কঠিন কাজ হল মায়েদের প্রসববেদনা। চিন্তা করে দেখুন মাত্র ১৯ বছরের ভেতরেই মমতাজকে গুনে গুনে ১৪ বার সেই বেদনাকে হাসিমুখে গ্রহণ করতে হয়েছে, এমনকি শেষবারে যমদূত এসে তাকে স্বর্গের ঠিকানা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। অনেকে তো কৌতুকের ছলে বলেই ফেলেন…. শাহজাহানের কাছে প্রেমের সংগা ছিল বছরান্তে একটি করে বাচ্চা উপহার দেওয়া!!
১৬৩১ সালে মমতাজ মহলের অকালপ্রয়াণে বেশ ভেঙে পড়েন শাহজাহান। প্রায় বছর দু’য়েক নেহাত প্রয়োজন ছাড়া কারও সাথে নাকি কথাও বলতেন না। চরম বিরহ তার তেজদীপ্ত জীবনে হঠাৎ যেন বার্ধক্যের জড়তায় স্থবির করে তুলল। আমৃত্যু সেই শোকের ছায়া পরিলক্ষিত হত তার বিষণ্ন চাহনিতে। তবে নারীপ্রীতি যে একেবারেই উবে গিয়েছিল, ঠিক তেমনটি নয়। শোনা যায় মমতাজের মৃত্যুর বছর পাঁচেক পরে তারই ছোট বোনের সাথে নাকি বিবাহ বহির্ভূত অন্তরঙ্গ এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ঠিক এই জন্যই অনেকে শাহজাহানের অসীম প্রেমের দিকে আঙুল তোলার অবকাশ খুঁজে পান।২০ হাজার সুদক্ষ কর্মীর দেড়যুগ ধরে রাতদিন চরম খাটুনির ফসল এই তাজমহল। তাজমহলের সাথে জড়িত সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপারটি ঘটল এর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।

Source: Famous Wonders of the World
শাহজাহানের সরাসরি নির্দেশে চোখের ওপর আঘাত করে চিরদিনের মত অন্ধ করে দেওয়া হল স্থপতিদের। পাশাপাশি যেসকল শ্রমিকদের পাথরভাঙা হাতে মস্তবড় সেই তাজমহলের পত্তন ঘটেছিল, তাদের সবার হাতের আঙুল অত্যন্ত নির্মমভাবে কেটে ফেলা হল।
শাহজাহানের যেমন শৈল্পিক একটি মন ছিল,তেমনি সেই শিল্পের জন্য অহংবোধও ছিল তার প্রবল। পরবর্তী সময়ে যদি সেই সকল শ্রমিকের হাত ধরে তাজমহলের মত অন্য কোন অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপনা পৃথিবীর কোন প্রান্তে দাঁড়িয়ে যায়,তাহলে শাহজাহানের নাম অনেকটা স্তিমিত হয়ে যেতে পারে–এই আশংকায় এমন চরম বর্বরতার পথ বেছে নেন তিনি। তাজমহলে শ্বেতপাথরের ফলকে ফলকে জগদ্বিখ্যাত যে কারুকার্য খচিত রয়েছে, তাতে শুধু শ্রমিকের ঘাম নয়,তাজা রক্তও মিশে আছে। এসব চিত্র যখন চোখের সামনে ভেসে উঠে, তখন তাজমহলকে প্রেমের নিদর্শন বলতে গিয়ে দ্বিধাবোধ কাজ করলে তা নিশ্চয়ই খুব একটা অযৌক্তিক হবে না।
জীবনের শেষদিকে এসে নিজ ছেলের নির্দেশে বন্দি করা হয় শাহজাহানকে। মুঘলদের আধিপত্য তখন শাহজাহানপুত্র আওরঙ্গজেব হাতে। মুকুটহীন বৃদ্ধ শাহজাহান বন্দিশালার এক ক্ষুদ্র জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে চেয়ে দেখতেন তার সেই অমর কীর্তি।

Source: tripadvisor.co.uk
রোদের আলোয় তাজমহলের দেখা মেলে একরূপে, সন্ধ্যার গোধূলিলগ্নেই হয়তো আবার অন্য কোন মায়াবিনী রূপে হাজির হয় সে। আর জ্যোৎস্নারাতে ঝর্ণা-নহর- বাগান সমেত তাজমহল যেন হয়ে ওঠে স্বর্গেরই প্রতিচ্ছবি।
আলো-আঁধারির এসব খেলা দেখতে দেখতে হয়ত মৃত্যুপথযাত্রী শাহজাহানের চোখে দু’এক ফোঁটা জল চলে আসতো। চোখের জলেই হয়ত স্মরণ করার চেষ্টা করতেন তার অতীত গৌরবগাঁথা। হয়ত তখন অদৃশ্যলোক থেকে বিনীত এক আহ্বান ভেসে আসতো প্রাণাধিক মমতাজ মহলের কাছ থেকে।
তাজমহলকে কেন্দ্র করে ভালবাসার অংশটুকুই বড় ছিল, নাকি ঘৃণার—এ বিতর্ক হয়ত চিরকাল থাকবে। থাকবে নানা যুক্তি-তর্ক, আর তর্কের খাতিরেই সৃষ্টি হবে নিত্যনতুন বিতর্ক। মূলত এসব বিতর্কও এক ধরণের সৌন্দর্য্য। বির্তক আছে বলেই তো তার প্রতি গোটা দুনিয়ার আকর্ষণও আছে, যে আকর্ষণের ইশারায় সাড়া দিয়ে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে যায় আগ্রার যমুনার তীরে।

শেষ করব রবির ভাষাতেই…
“শুধু থাক
একবিন্দু নয়নের জল
কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জল
এ তাজমহল”।