সুপার পাওয়ার হিসেবে আমেরিকার উত্থান – পেছনের কথা

2

বর্তমান পৃথিবীতে সবথেকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আজ আমি আপনাদের বলবো,  ১৭৭৬ সালে স্বাধীন হওয়া এই দেশটি কিভাবে পৃথিবী ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করল।

প্রথমেই চলুন জেনে নেই দেশটি সম্পর্কে কিছু তথ্য – আপনি জেনে অবাক হবেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধুমাত্র তাদের মিলিটারিদের পেছনে যে বাজেট খরচ করে তা সারা বিশ্বের মিলিটারী বাজেটের ৩৭ ভাগ। ২০১৬ সালে দেশটির মিলিটারি বাজেট ছিল ৫৯৬ বিলিয়ন ডলার যেখানে ২য় সর্বোচ্চ চীন এর বাজেট হল ২১৫ বিলিয়ন ডলার আর তৃতীয় সৌদি আরবের বাজেট ৮৭ বিলিয়ন ডলার। শুধু তাই নয়, আপনাদের আরেকটি তথ্য দেই। সারা বিশ্বের ৮০০ এর বেশি স্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারী বেজ আছে যা কিনা শুধু মাত্র ওই সকল এলাকায় নিজেদের প্রভাব টিকিয়ে রাখতে রাখা হয়েছে।

Source: National Priorities Project

আমেরিকার আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে রয়েছে চমকপ্রদ এবং সময়োপযোগী কিছু সীদ্ধান্ত। চলুন তাহলে দেখে নেই ধীরে ধীরে কিভাবে দেশটি আজকের এই অবস্থানে আসল। দেশটির আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনের বিভিন্ন ঘটনাকে আমরা তিনটি যুগে ভাগ করতে পারি।

প্রথম যুগ বা প্রথম ৭০ বছরে দেশটি সম্পূর্ণভাবে তাদের সীমানা বাড়ানোর দিকে নজর দেয়। এই প্রথম ৭০ বছরে দেশটি নর্থ আমেরিকাতে নিজেরদের অবস্থান দৃঢ় করে এবং তাদের সীমানা প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত করে। এই সময়ে এটি লুয়িজিয়ানা (১৮০৩), টেক্সাস (১৮৪৫), ওরিয়গন(১৮৪৬), ফ্লোরিডা (১৮১০-১৮১৯) এই অঙ্গরাজ্যও গুলো ব্রিটিশ, স্প্যানিশ ও অন্যান্য উপনিবেশ স্থাপন করা দেশগুলোর কাছ থেকে কিনে নেয়। এই সীমানা বাড়ানোর নীতিতে আমেরিকার জনগণ দুইভাগে বিভক্ত ছিল । একভাগ চাইত আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলো ও যাতে আমেরিকা দখল করে নেয় আরেকভাগ এই নীতির বিরোধী ছিল।

William McKinley | Source: Miller Center

দ্বিতীয় যুগ কিংবা ১৮শ শতাব্দীর শেষের দিকে এই সীমানা বাড়ানোর বিতর্কের ধীরে ধীরে অবসান ঘটতে থাকে। এর পেছনে কারন ছিল আমেরিকাতে শিল্প বিপ্লবের সূচনা এবং আমেরিকা র অর্থনীতির অবস্থার ব্যাপক উন্নতি। ১৮৯৮ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাকেনলি কিউবা দখল করতে স্পেন এর সাথে যুদ্ধ শুরু করে। এই যুদ্ধে স্প্যানিশরা পরাজিত হয় এবং আমেরিকা র পোর্ট রিকো, গুয়াম এবং ফিলিপিন দখল করতে সক্ষম হয়। এর পরবর্তী দুই বছরে আমেরিকা তার সীমানা আরও বৃদ্ধি করে। এই দুই বছরে আমেরিকা হাওয়াই(১৮৯৮), ওয়েক আইল্যান্ড(১৮৯৯) এবং আমেরিকান সামওয়া (১৯০০) তাদের আওতায় নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। তার আরও দুই বছরের মাঝে আমেরিকা পানামা খালের (১৯০৩) কন্ট্রোল নিতে সক্ষম হয়। ১৯৬১ সালে আমেরিকা ডমিনিক রিপাবলিক এবং আমেরিকান ভার্জিন আইল্যান্ড দখলের জন্য সৈন্য বাহিনী পাঠায়। এই পিরিয়ডে সাম্রাজ্য বৃদ্ধি এত তাড়াতাড়ি হয়েছিল যা বর্তমান আমেরিকার এই অবস্থানের পিছনে অনেক জোরালো ভূমিকা রাখে । 

আমেরিকা
League of Nations Conference

তৃতীয় যুগ বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পুরো বিশ্ব আমেরিকার পাওয়ার সম্পর্কে প্রথম ধারনা লাভ করে। শুধু যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বন্ধের পেছনে আমেরিকার হস্তক্ষেপ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিল তা নয়, এই সময়ে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উইলসন প্যারিস শান্তি সম্মেলনে এই যুদ্ধ স্থগিতের পেছনে জোরালো ভূমিকা রাখে। এই সম্মেলনেই আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী বৈদেশিক নীতির প্রথম আত্মপ্রকাশ দেখা যায়। যার ফলস্বরূপ প্রস্তাব করা হয় লীগ অব ন্যাশনস এর। যা কিনা সারা বিশ্বে শান্তি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু ঝামেলা বাঁধে আমেরিকার পার্লামেন্ট এ প্রস্তাব পাস করাতে ব্যার্থ হওয়ায়।  লীগ অব ন্যাশনস ব্যার্থ হলেও এর মাধ্যমে আমেরিকার উত্থানের মূল বেইজ তৈরি হয়ে যায়। এদিকে ইউরোপে ধীরে ধীরে হিটলার এবং এশিয়াতে সমানতালে জাপানিজদের উত্থান শুরু হয়।এসব কিছুতে আমেরিকা তখন নাক না গলানোর নীতিতে ছিল। কিন্তু ঝামেলা ঘটায় জাপানী বিমানবাহিনী দ্বারা পার্ল হারবার আক্রমণ। আর এই আক্রমণের ফলশ্রুতিতে আমেরিকা জড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। আর এই সিদ্ধান্তই আমেরিকাকে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার শেষ ধাপ হিসেবে কাজ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পাওয়ারফুল রাষ্ট্রগুলোর মাঝে একমাত্র আকেরিকাই অর্থনৈতিক মন্দা থেকে রক্ষা পেয়েছিল। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকার এটমিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ পুরো বিশ্বকে এতটাই স্তম্ভিত ও ভীত করে দিয়েছিল যে তখন আমেরিকার যেকোন নীতি মেনে নিতে অন্য রাষ্ট্রগুলোর কোন দ্বিধা ছিলনা। পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা এবং তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পুরো বিশ্ব তাকিয়ে ছিল আমেরিকার দিকে। আর সেই সময়ে আমেরিকা হাজির হয় জাতিসংঘের প্রস্তাব নিয়ে যা কিনা লীগ অব নেশনস এর নতুন রুপ মাত্র।

আমেরিকা
40 nations converged on the small US ski resort of Bretton Woods, New Hampshire, to hammer out a new international monetary system.

শুধু জাতিসংঘ নয়, একই সময়ে মিত্রবাহিনীর ৪৪ টি দেশের ৭৩০ জন প্রতিনিধি নিউ হ্যাম্পশায়ারে মিলিত হয়। আর এখানেই “দ্যা ব্রিটন উডস এগ্রিমেন্ট” সাক্ষর হয়, যা কিনা বর্তমান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম এর মেরুদণ্ড। এই চুক্তির ফসলই হল বিশ্বব্যাংক এবং ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড। কিন্তু এর মাধ্যমেও আমেরিকা পুরো বিশ্বে প্রভাব বিস্তারে  তখন ও সক্ষম হতে পারেনি। কেননা এশিয়া ও ইউরোপ এর বিশাল অংশ তখনও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণ করত। আমেরিকা অর্থনৈতিক ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দুর্বল করতে এবং ইউরোপ এর সাথে বানিজ্য বাড়াতে প্রতিষ্ঠা করে ন্যাটো (North Atlantic Treaty Organization)। এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এর কমিউনিজম নীতির ফলে ক্রমেই অনেক দেশ আমেরিকাকে বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে গ্রহন করে নেয়। যার মাঝে সৌদি আরব, ইজরায়েল এবং সাউথ কোরিয়া অন্যতম। এর পাশাপাশি আমেরিকা কিছু কিছু দেশের বিদ্রোহী গ্রুপ গুলোকে অস্ত্র সরবরাহ শুরু করে।এই দেশগুলো মূলত সোভিয়েত ইউনিয়ন এর বন্ধুরাষ্ট্র ছিল বা আমেরিকার নীতির বিরোধী ছিল। এই Cold War পিরিয়ডে আমেরিকা বিভিন্ন দেশের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে সমর্থ হয় এবং এই পিরিয়ডেই আমেরিকা বিশ্বের নানা স্থানে তাদের মিলিটারি বেজ স্থাপনেও সক্ষম হয়। কেননা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এর কমিউনিজম এবং সীমানা বাড়ানোর নীতিতে অন্য রাষ্ট্রগুলো ভীত ছিল এবং এই সুযোগটাই আমেরিকা খুব ভালোভাবে কাজে লাগাতে পেরেছিল। Cold War পিরিয়ডে আমেরিকা যে সিস্টেম দাড় করিয়েছিল তাই পরবর্তীতে আমেরিকাকে পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।

 

Cold War নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে পড়ে আসুন এই লিখাটি –   Cold War বা স্নায়ুযুদ্ধের ইতিবৃত্ত ও বিশ্বব্যাপী এর প্রভাব (প্রথম পর্ব)
Leave A Reply

Your email address will not be published.

2 Comments
  1. Courelp says

    buy cheap generic cialis online The aim of this study is to describe the clinical course of these patients

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More