সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের পূর্বপরিচয় সম্বন্ধে অদ্যাবধি কিছু জানা যায় নাই।
১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহকে হত্যা করার পর হাজী ইলিয়াস ‘সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ’ উপাধি ধারণ করে বাংলার সিংহাসন দখল করে ছিলেন। তাঁর শাসনামলে বাংলার প্রথম স্বাধীনতার ঘোষক ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ তদানীন্তন পূর্বাঞ্চলের শক্তিশালী শাসক ছিলেন বিধায় সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে বরং তিনি পশ্চিমাঞ্চলে রাজ্য সম্প্রসারণে মনোযোগী হন এবং এই কাজে তিনি বিশেষ সফলতা ও লাভ করেছিলেন। ৭৪৭ হিজরি সনে ত্রিবেণী জেলার সাতগাঁও গ্রামে তাঁর মুদ্রা আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে এই কথা নিশ্চিৎ হয় যে উহা শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের রাজ্যভুক্ত ছিলো।
এছাড়াও তিনি নেপাল অভিযানের লক্ষ্যে তাঁর সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে ছিলেন এবং সেখান হতে প্রভূত ধনসম্পদ হাসিল করতে সমর্থ হয়ে ছিলেন। এছাড়াও জাজনগর তথা উড়িষ্যা বিজয়, সোনারগাঁও বিজয় ছিলো তাঁর শাসনামলের উল্লেখযোগ্য বিজয়। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো দিল্লীর সুলতান ফিরোজ খান তুঘলকের বাংলা আক্রমণ। ইতঃপূর্বে তাঁর পিতা মুহম্মদ খান তুঘলক বারবার বাংলা অাক্রমণ করে ব্যর্থ হতে থাকলে তার সুযোগ নিয়ে এই অঞ্চলের শাসকগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করতে থাকেন। তন্মধ্যে ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার পূর্বাঞ্চলের শাসক ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ সর্বপ্রথম বাংলার স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন।
শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের সাথে ফিরোজ খান তুঘলকের যুদ্ধের বহু কারণ থাকতে পারে। নব্বই হাজার অশ্বারোহী, এক লক্ষ পদাতিক ও তীরন্দাজ এবং লক্ষাধিক রণতরী নিয়ে বাংলা আক্রমণ করেন ফিরোজ খান তুঘলক। বাংলা আক্রমণ করার সময় তিনি নিশান জারি করে ছিলেন :
“…ইলিয়াস হাজী লখনৌতি ও ত্রিহুত (তিরহুত) অঞ্চলের লোকেদের উপর যথেচ্ছাচারিতা ও উৎপীড়ন চালাইতেছে, অহেতুক রক্তপাত করিতেছে, এমনকি স্ত্রীলোকদেরকেও হত্যা করিতেছে, যদিও ধর্ম ও মতবাদের সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি এই যে, স্ত্রীলোকদের হত্যা করা চলিবে না, যদি সে স্ত্রীলোক কাফির হয়, তবুও না; এবং ইসলামের আইনে অনুমোদিত নয় এমন সব কর আদায় করিয়া লোকদেরকে কষ্ট দিতেছে;…”
এইদিকে, ফিরোজ খান তুঘলকের বাংলা আক্রমণের খবর পেয়ে শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ একডালা দুর্গে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। তবে এই ‘একডালা দুর্গের’ অবস্থান নিয়ে ঐতিহাসিকদের ভিতরে সংশয় ও মতভেদ রয়েছে । কেউ কেউ একে ঢাকার অদূরে বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ আবার মনে করেন এটি , মালদহ জেলায় । তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক এর মতে , এটি পাণ্ডুয়ায় অবস্থিত ছিলো যাঢ় একদিকে ছিলো নদী আর অপর দিকে ছিলো গহীন বন। এদিকে, যখন শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ একডালা দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহকে ফিরোজ খান তুঘলকের সেনাবাহিনীর কাছে বন্দি হন। বাইশ দিন ধরয়ে অবরোধ চলার পরে যখন ইলিয়াস শাহ বের হয়ে আসলেন না, তখন ফিরোজ খান তুঘলক ভিন্ন পথ ধরলেন। তিনি বুঝলেন, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেওয়া হলে ইলিয়াস শাহের সৈন্যরা বের হয়ে আসবেন ।
শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ দশ হাজার অশ্বারোহী, বিশ লাখ সৈন্য এবং পঞ্চাশটি হস্তি নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবার সময় দিল্লীর বাহিনীর উপর আক্রমণ করে বসেন। ফলশ্রুতিতে ফিরোজ খান তুঘলক যা চাইছিলেন তাই ঘটল। কিন্তু ফিরোজ খান তুঘলক একডালা দুর্গ বেশিদিন দখল করে থাকতে পারলেন না। এর কিছুদিনের মধ্যেই শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের সৈন্যরা একডালা দুর্গ অবরোধ করে । দ্বিতীয়বার এই অবরোধ ঠিক কতদিন স্থায়ী হয়েছিলো তা বলা যায় না। তবে ঐতিহাসিক বারুনির মতে, এসময় মুসলিম রমণীরা বাড়ির ছাদে উঠে কাঁদতে থাকে। তাদের কান্নার ধ্বনিতে বিচলিত হয়ে ফিরোজ খান তুঘলক ইলিয়াস শাহের সাথে এক চুক্তি করতে বাধ্য হন।
সন্ধির শর্তগুলো হলো:
১. ইলিয়াস শাহ বাংলার শাসনকর্তা রহিবেন
২. দিল্লীর দরবারে উপঢৌকন ও বার্ষিক কর প্রেরণ করিতে হইবে
৩. পাণ্ডুয়ার বন্দি সকল সৈন্যকে মুক্তি দেবেন
এই সন্ধি চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দার শাহসহ বহু বন্দি মুক্তিলাভ করে ছিলেন।