বরেন্দ্রভূমির বৈচিত্র্যময় সাঁওতাল জীবন

0

সম্রাট অশোকের আমলে আদিবাসীন্দাদের নামে এই ভূমির নাম ছিলো পারিদাঙ্গন। কালের প্রবাহে পারিদাঙ্গন হয়েছে বারিন্দা আর বারিন্দা থেকে বরেন্দ্র। প্লাইস্টোসিন যুগে প্রাচীন পলিমাটিতে গড়া সবুজ-শ্যামল এ ভূমি। পুরাণ কাহিনী মতে, এই ভূমি দেবরাজ ইন্দ্রের ‘বর বা আশীর্বাদ’ প্রাপ্ত তাই এর নাম বরেন্দ্র ভূমি। উত্তরবঙ্গের প্রায় ৭,৭৭০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই বরেন্দ্রভূমিতেই বসতি গড়েছে রাজশাহীর পবা থানার সাঁওতালরা।

সাঁওতাল
সাঁওতাল
Source: The Daily Ittefaq

পবা থানার এই অঞ্চলগুলোতে বরেন্দ্রভূমি এনেছে ভূ-বৈচিত্র্য আর সাঁওতালরা এনেছে জনবৈচিত্র্য। সাঁওতালদের আদি নিবাস ছিলো ভারতের উড়িষ্যা, বিহার ও ছোট নাগপুরে। কবে ওরা বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করেছিলো ঠিক করে বলা মুশকিল তবে ওদের মধ্যেই কেউ কেউ বলে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকেই বাংলাদেশে চলে আসে এবং যুদ্ধও করে। তবে ওরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় এসেছে ১৮৪০-১৯৪০ সাল এই ১০০ বছরে।

সাঁওতালদের সেই বৈচিত্র্যময় জীবন নিয়েই আজ আমাদের এই আয়োজন-

কৃষিকাজ/জীবিকা

ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম আদিবাসীন্দা সাঁওতালরা কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা ও কৃষি সংস্কৃতির জনক ও ধারক হিসেবে স্বীকৃত।

ধান কাটার ক্ষেত্রে সাঁওতালরা প্রথমে কাটে উঁচু জমির ধান পরে কাটে নিচু জমির ধান। নারী-পুরুষ সকলেই এই মৌসুমে মহা ব্যস্ত থাকে। কেউ ফসল তুলতে আসে সপরিবারে। ক্ষেতের পাশেই তাই তাদের অস্থায়ী ঠাঁই হয়। বরেন্দ্রভূমি মূলত ধানেরই এলাকা। সাঁওতালদের জীবন ঘিরেও রয়েছে ধান।

সাঁওতালদের জীবিকা
সাঁওতালদের জীবিকা
Source: Desh Bhabona – দেশের কথা দশের কথা

সাঁওতালদের আরও অন্যতম একটি পরিচয় হলো এরা শিকারজীবীও। যদিও এটি তাদের মূল পেশা নয় তবে আদি সাঁওতাল আর তাদের ট্রেডিশন ধরে রাখার জন্য এখনও তারা পশু-পাখি শিকার করে থাকে। বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে তারা মেতে ওঠে শিকারে। শিকারের জন্য বনবিড়াল তাদের কাছে খুবই প্রিয় শিকার।

শিকার করার উপকরণ হিসেবে তারা নিজেদের বানানো যন্ত্র ব্যবহার করে থাকে।

গরু, ছাগল, হাস, মুরগি পালনে সাঁওতালরা বেশ উদ্যোগী। তাছাড়া তাদের ধর্মীয় সংস্করণের কারণে গরুর খুব যত্ন নেয় ওরা। গরুর খাবার যোগান দেয়ার জন্য তারা একবেলা কমও খেয়ে থাকে।

ঘরবাড়ি

নিজেদের ঘরবাড়ি সাঁওতালরা নিজেরাই বানায়। মাটির ঘর তৈরির দক্ষ কারিগর ওরা। ইটের বদলে ওরা দেয়াল তৈরি করে থরে থরে কাঁদা জমিয়ে। বরেন্দ্র ভূমির এটেল মাটি মাটির ঘর গড়ার আদর্শ উপাদান। ঘরে সাধারণত এরা জানালা রাখে না অপদেবতা বোঙ্গার ভয়ে।

ঘরবাড়ি
Source: DW

সমতল ভূমির আদিবাসী বলে পাহাড়িদের তুলনায় সাঁওতাল জীবনধারার মিল বেশী বাঙ্গালীদের সাথে। প্রতিদিনের ঘর কন্যায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়টাকে বেশ গুরুত্ব দেয় সাঁওতালরা। ওদের ঐতিহ্য আছে সৌন্দর্য প্রীতিরও। আকর্ষণীয় রং দিয়ে ওরা রঙ্গিন করে ঘরের ভিটি। সেই রং এর উপাদান আর কিছু নয় মাটিই। পরিচ্ছন্নতায় আর অলঙ্করণে সাঁওতালদের ঘরবাড়ি আসলেই দেখার মতো।

খাদ্যাভ্যাস              

কৃষিজীবী হওয়ায় বাঙ্গালীদের মতো ওদেরও প্রধান খাবার মাছ, ভাত, শাক-সবজি। এছাড়াও খায় নানা রকম অপ্রচলিত খাবার। যেমন: শামুক, ইঁদুর, বনবিড়াল, কাঠবিড়ালি, শুকর, কুঁচে, কচ্ছপ ইত্যাদি। আর পানীয় হিসেবে নিজেদের বানানো হাঁড়িয়া পান করে। অতিথি আপ্যায়ন, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান এবং উৎসবাদিতে হাঁড়িয়া পান তাঁদের সমাজের একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে পালনীয়। এ পানীয় তারা নিজেরাই তৈরি করে। ভাতকে পচিয়ে এ পানীয় তৈরি করা হয়। একে ‘পচানি’ও বলা হয়।

সকালে নাস্তা খাওয়ার কোন চল নেই বলে ওদের রান্না করা আর খাওয়া শুরু হয় দুপুরের পর থেকে। কৃষি প্রধান হওয়ায় ওরা নারী-পুরুষ সকলেই মাঠে কাজ করে। নারীরা দুপুর পর্যন্ত কাজ করে চলে আসে এর পর রান্না আর সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে নারীরা।

ধর্মীয় বিশ্বাস

বাহারবে শালফুলকে ভক্তি করছেন এক সাঁওতাল
Source: http://www.salekkhokon.net

সাঁওতালদের বিশ্বাস আত্মা অমর এবং সে অনৈসর্গিক আত্মা সব ভালো মন্দ বিচার করে থাকে। তাঁদের বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তা অমর ও অবিনশ্বর। সাঁওতালী ভাষায় দেবতাকে বলা হয় ‘বোঙ্গা’। বোঙ্গা যদি প্রসন্ন হয় তবে সমাজ জীবনে ভালো ফল হয়। আর যদি বোঙ্গা রুষ্ট হন তবে সমাজজীবনে অমঙ্গল হতে পারে। এজন্যই বোঙ্গাকে খুশি করার জন্য সাঁওতালরা বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পূজা-পার্বণ করেন। তবে বর্তমানে সাঁওতালদের মাঝে হিন্দু দেব দেবীর পূজা করতে দেখা যায় এবং বেশিরভাগ সাঁওতালরা খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে।

সাঁওতালদের ধর্মীয় বিশ্বাস
Source: e – Paper — e পত্রিকা

উৎসব

সাঁওতালরা অত্যন্ত আমোদপ্রিয়। বছরব্যাপী বিভিন্ন পর্ব উৎসব এবং সামাজিক অনুষ্ঠানাদি পালনের আনন্দের মধ্য দিয়ে তাঁদের জীবন অতিবাহিত হয়।

সাঁওতালরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উৎসব পালন করে থাকে। শিশু জন্ম, মৃত্যু দিবস ও বিবাহ উৎসব, নবান্ন উৎসব হিসেবে পালিত হয় ‘সোহরাই’ উৎসব, ফাল্গুন মাসে বাহা উৎসব ইত্যাদি জনপ্রিয় উৎসব ছাড়াও আরও বিভিন্ন উৎসব পালন করে থাকে সাঁওতালরা।

সাঁওতাল সমাজে প্রচলিত আছে যেমন নাচ, গান তেমনিভাবে প্রচলিত আছে নানা লোক কাহিনী, আছে কিংবদন্তী নিয়ে নানা কথা, আছে নানা প্রকারের লোকবিশ্বাস ও কুসংস্কার।

বাহারবে শালফুলকে ভক্তি করছেন এক সাঁওতাল
বাহারবে শালফুলকে ভক্তি করছেন এক সাঁওতাল
Source: salekkhokon

প্রায় সমস্ত সাঁওতাল বাড়ির আঙ্গিনাতেই আছে জবা ফুল সহ অন্যান্য ফুল গাছ। উৎসবের সময় তারা জবা ফুল তাদের সাজের অন্যতম উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।

বাঙ্গালীদের মতো এদেরও বারো মাসে তেরো পার্বণ। ফুলের সাজে সাঁওতাল মেয়েরা হাত ধরাধরি করে নাচে। কখনও ওরা বসন্তে নাচে বাহা উৎসবে, কখনওবা পৌষে মাতে পৌষনা নাচে। এই নাচ তারা ফসল তোলার সোহরাই উৎসবে নাচে। ফসলের দেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ওরা নবান্নের আনন্দ ছড়ায় নাচে, গানে।

সাঁওতাল মেয়েরা নাচে ঝুমুর তালে। নাচের সাথে পরিবেশিত হয় ঝুমুর গান। নাচের সময় বাদ্য হিসেবে থাকে মাদল, বাঁশি, ঢোল আর শিঙ্গা।

পোশাক

সাঁওতালদের পোশাক
Source: নতুনকিছু

সাঁওতালদের পোশাকে তেমন কোন বৈচিত্র্য নেই। সাদামাটা পোশাক পরিধানেই তারা অভ্যস্ত। তবে ঐতিহ্যবাহী কিছু পোশাক তারা পড়ে থাকে বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে এবং বিভিন্ন উৎসবে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে।

সমাজ ব্যবস্থা

সাঁওতালরা মূলত ১২ টি গোত্রে বা টোটেমে বিভক্ত। সাঁওতালি ভাষায় এই গোত্রগুলোকে “পারিস” বলা হয়। তাদের এই গোত্রে বিন্যাসের উদ্ভব আদিম সমাজেরই বৃত্তি বিন্যাসের অনিবার্য ফলশ্রুতি। তাদের গোত্রগুলির নাম হলো:

১.কিস্কু

২.হাঁসদাক/হাঁসদা

৩.মুরমু/মুর্মু

৪.হেমব্রম

৫.মারনদী, মারান্ডি/মার্ডি

৬.সরেন

৭.টুডু

৮.বাস্কে/বাস্কি

৯.বেসরা

১০.পাঁওরিয়ার/পাউরিয়া

১১.গুয়ৌসরেন

১২.চোঁড়ে

তবে এই ১২ টি গোত্র ছাড়াও তাদের প্রায় শতাধিক গোত্র ছিলো বলে জানা যায়।

সাঁওতালরা বিয়ের অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মেনে চলে। এরা নিজ গোত্রের বাইরে বিয়ে দেয়। তাদের বিশ্বাস গোত্রে গোত্রে বিয়ে দেয়া যায় না গোত্রে গোত্রে সবাই ভাই বোন।

কালের স্রোতে সাঁওতাল সমাজে রূপান্তর ঘটলেও তাঁরা স্ব-সমাজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলেছেন। ঐতিহ্যবাহী সামাজিক নেতৃত্ব এখনও বহাল আছে এদের। সাঁওতালদের প্রতিটি পল্লীতে আছে পল্লী প্রধান বা গ্রাম প্রধান। গ্রামের মানুষের সমস্যা সমাধান করার জন্য ভোট দেয়ার মাধ্যমে তারা তাঁদের গ্রাম প্রধানকে নির্বাচন করে থাকেন।

বর্তমান প্রেক্ষাপট

অন্যসব আদিবাসীদের তুলনায় সাঁওতালরা কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও বেসরকারি উদ্যোগে পার্থক্যটা কমে আসছে দিন দিন।

পিছিয়ে পরা সাঁওতালদের নানা ভাবে সহযোগিতা করার জন্য খ্রিষ্টান মিশনারিরা নানা ভাবে এগিয়ে এসেছে। যার ফলশ্রুতিতে সাঁওতালরা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আশ্বাস পাচ্ছে। মিশনারিদের অবদান সাঁওতাল জনগোষ্ঠীতে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে। বর্তমানে বেশিরভাগ সাঁওতালরা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। এমনকি সাঁওতালদের প্রতিটি পল্লীতে রয়েছে একটি করে উপাসনালয় বা গির্জা। এক্ষেত্রে মিশনারিদের অবদানের পেছনে তাদের স্বার্থটাও চোখে লাগার মতো। তারা সাঁওতালদের যেমন একদিকে সাহায্য করছে বিভিন্ন স্কুল স্থাপনার মধ্য দিয়ে, বাড়ি-ঘর তৈরি করে  দিয়ে তেমনি তাদের সম্প্রদায়ের পাল্লাটাও ভারী হচ্ছে। তবে সে যাই হোক না কেন মূলত সাঁওতালরা থাকার জায়গা পেয়েছে, শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় পেয়েছে, প্রার্থনার জন্য পেয়েছে গির্জা এসব নিয়ে তারা মহা আনন্দে কাটাচ্ছে তাদের দিন। সাধারণের মাঝেই আসলে অসাধারণের বসবাস সাঁওতালরা সেটাই প্রমাণ করে।

জমি ফেরতের দাবি সাঁওতাল আদিবাসীদের
জমি ফেরতের দাবি সাঁওতাল আদিবাসীদের
Source: Daily CHT

তাঁরা অত্যন্ত সহজ সরল প্রকৃতির। এই সহজ সরলতার সুযোগে বরেন্দ্র অঞ্চলের অধিবাসীরা বিভিন্ন উপায়ে অসহায় সাঁওতালদের ভূমিহীন কৃষকে পরিণত করেছে। ফলে ক্রমান্বয়ে দরিদ্র হয়ে যাওয়ায় শিক্ষা দীক্ষার দিক দিয়েও মোটেও তারা অগ্রসর হতে পারছিল না। তনে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী সাঁওতালদের মধ্যে শিক্ষার হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার অন্যদিকে অধিকাংশ সাঁওতাল ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে সাঁওতাল সংস্কৃতি মিশ্র সংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছে। যার কারণে সাঁওতালরা হারাতে বসেছে নিজস্ব সংস্কৃতি। তাই আমাদের উচিত এসব সংস্কৃতির উপযোগিতা ধরে রাখা কেননা এসব সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করবে।

Source Featured Image
Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More