মিসরীয় সভ্যতা নিয়ে আমাদের জল্পনাকল্পনা আর আগ্রহের শেষ নেই। তাই বহুবছর ধরেই এ প্রাচীন সভ্যতা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা চলছে। এক্ষেত্রে মিসরের ফারাও বা ফেরো অর্থাৎ সম্রাটগণ হল মিসরীয় গবেষণার মূলবিন্দু। এসব ফারাওগণের মমি উদ্ধারের পর তাদের ইতিহাস ও জীবনযাপন সম্পর্কে আমরা অনেকখানি জানতে সক্ষম হয়েছি। বিভিন্ন রিসার্চের পর জানা গেছে তাদের বিলাসিতা, রাজনীতি এবং বহু ঈশ্বরবাদ সম্পর্কে। তবে মিসরীয় সভ্যতায় স্বল্পসময়ের জন্য একেশ্বরবাদের যে প্রথা লক্ষ্য করা গেছে তা মুলত ঘটেছিল সম্রাট আমেনহোটেপ ৪ বা আখেনাতেনের সময়কালে। যার কারণে ইতিহাসবিদগণ আখেনাতেনকে প্রাচীন মিসরের ধর্মসংস্কারকও বলে থাকেন।
শুরুর দিক থেকেই মিসরে বহু ঈশ্বরবাদ প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন প্রাচীন নিদর্শন হতে জানা যায় তারা মুলত আতেন(সুর্যদেবতা), ন্যুট(সুর্যদেবের মাতা), ওরিসিস(শস্য ও নীলনদের দেবতা), হারাখতি(আলোর দেবতা), হ্যাথোর(আকাশের দেবী), থোট (নক্ষত্রের দেবী), আনুবিস (মৃত্যুর দেবতা) সহ বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করত। প্রাথমিক ভাবে ধারনা করা হয় মিশর যখন একক সাম্রাজ্য হিসেবে কোনো এক নৃপতির অধিকারে আসে তখন ঐক্য বজায় রাখার জন্য প্রথম এই ঈশ্বরের ধারনার প্রচলন করা হয় সম্রাটের ক্ষমতার প্রতি সম্ভ্রম অর্জনের জন্য।

অষ্টাদশ রাজবংশের ফারাও আমেনহোটেপ (4) বা আখেনাতেন আনুমানিক ১৩৫৩- ১৩৩৬ মতান্তরে ১৩৫১-১৩৩৪ খৃষ্টপূর্ব সময়কাল পর্যন্ত মিসর শাসন করেছেন।
আখেনাতেন মনে করতেন ঈশ্বর বলতে শুধু একজনই রয়েছেন আর তিনি হলেন আতেন বা সূর্যদেব। তিনি তার এই মতবাদকে সারা মিসরে ছড়িয়ে দিলেন। বহু ঈশ্বরবাদের ধারণাকে মুছে ফেলে এক ঈশ্বর অর্থাৎ আতেনের উপাসনা করার নির্দেশ দিলেন। যদিও বহু ঈশ্বরবাদের ধারা ভেঙে দিয়ে নতুন প্রথা চালু সেই সময়ের মিসরে সহজ কাজ ছিল না। শক্তিশালী পুরোহিতদের বিরোধিতা এবং জনগণের আপত্তির মুখেও আখেনাতেন এই কর্মযজ্ঞ চালিয়ে গেছেন। আখেনাতেন সব দেবতাকে গৌণ ঘোষণা করে একমাত্র সূর্যদেবকে প্রধান উপাস্য হিসেবে উপাসনা করার নির্দেশ দিলেন এবং তার এই আদেশ মানতে বাধ্য করার চেষ্টা করলেন। পুরো মিসরের ধর্মীয় চেতনায় কালোমেঘ নেমে আসে তার এই ঘোষনায়।
নতুন ধর্মমতে লক্ষনীয় ভাবে বদলে যেতে থাকল মিসরীয়দের জীবনধারা। ফারাও আমেনহোটেপ তার নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখলেন আখেনাতেন। আখেনাতেন শব্দের মানে হচ্ছে আতেনের অর্থাৎ সূর্যদেবের পুত্র। আখেনাতেন তার রাজ্যের রাজধানীর স্থান পরিবর্তন করলেন। নতুন রাজধানীতে শুরু করলেন সুর্যদেব আতেনের মন্দির তৈরির কাজ। পরবর্তীতে সেখানকার প্রধান পুরোহিত হন আঈ। আঈয়ের ভুমিকা মিসরীয় ইতিহাসে পুরোহিততন্ত্রের ক্ষমতার মাধ্যমে জানা যায়। দেবতা আতেন এর উপাসনার ধরন ছিল কিছুটা আলাদা। এই দেবতাকে পূজা করা হতো দিনের আলোতে বাইরে সবার সামনে ।

source: ancientegipts.net
এর আগে আমুন-রার পূজা তার পুরোহিতরা অন্ধকার মন্দিরগুলোর ভেতরে রহস্যময় কায়দায় করতেন। সাধারণ মানুষ সেই উপাসনার বিষয়ে তেমন জ্ঞাত ছিল না। নতুন উপাস্য এবং নতুন উপাসনার ধরনের ফলে দেবতা এবং জনগণের মাঝের দূরত্ব ঘুঁচে গিয়ে শুধু একটি সত্ত্বাই রয়ে গেল। তিনি হলেন স্বয়ং ফারাও আমেনহোটেপ বা আখেনাতেন। একারনে পুরোহিতদের গুরুত্ব সমাজে চরমভাবে কমে যেতে থাকল। সূর্যদেবতাকে পূজা করার পদ্ধতি খোলামেলা হওয়ার কারণে পুর্বে পুরোহিতরা দেবতাদের উৎসর্গ করার উদ্দেশ্যে জনসাধারণের কাছ থেকে যে চাঁদা গ্রহণ করতো সেই পন্থাও বন্ধ হয়ে এলো।
শুধু তাই নয়, ফারাওয়ের হুকুমে কার্নাকের মন্দিরের সব জৌলুসগুলো সরানো হল। সাম্রাজ্যের নানা প্রান্তে তার আদেশে আমুন-রা এবং অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তিসমূহ সরিয়ে ফেলা হলো। থেকে গেল শুধু একজন আতেন বা সূর্য। আর সেই সঙ্গে বাড়তে থাকল পুরোহিতদের ক্ষোভ।কিন্তু তার একার পক্ষে সব করা সম্ভব ছিল না। তার স্ত্রী নেফারতিতি সবসময় তার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। আবার কারও কারও মতে, এই বিশাল কর্মকাণ্ডের মূল হোতা ছিলেন নেফারতিতিই।

মিশরের মানুষজন এই বিশাল পরিবর্তন মেনে নেয় নি। তারা বিদ্রোহ করে এবং রাজা তাদের দমনের চেষ্টা করেন। আখেনাতেন এতটাই অনুপ্রানিত উপাসক ছিলেন তিনি রাজ্য নষ্ট করে একক উপাস্যের উপাসনা করেছেন। মিশর জুড়ে একপ্রকার নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। গুপ্তহত্যা, সংঘাতে মিশরের রাজনৈতিক অবস্থা গোলমেলে হয়ে যায়। এবং এই অস্থিরতার পর একটা ভাঙ্গনের সূচনা ঘটে। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেই আখেনাতেনের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুকে রহস্য আবৃতই বলা চলে। খুব বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারলেন না তিনি। সূর্য দেবতার শহরের কাজ শেষ হওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়। তার পরবর্তীতে সমেনখারেন সম্রাট হন। তিনিও সূর্যদেবের উপাসনা প্রচলিত রাখার চেষ্টা করেন। তার রাজ্যকাল ছিলো সংক্ষিপ্ত। মাত্র কয়েক মাসের। হয়তো অন্তর্বর্তীকালীন রাজা ছিলেন তিনি।

এরপরই ঘটে সেই অবিস্মরণীয় পরিবর্তন। মিসরের ফারাও হন আখেনাতেনের স্ত্রী নেফারতিতি। নেফারতিতির তত্ত্বাবধানে আতেন দেবতার আখেনাতেন শহরের কাজ আরও জোরেশোরে শুরু হয়।কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর মধ্যেই নেফারতিতির মৃত্যু হয়। আখেনাতেন এবং নেফারতিতির কোনো ছেলে সন্তান ছিল না, ছিল ছয় মেয়ে। তাই নেফারতিতির মৃত্যুর পর পুরোহিতরা আখেনাতেনের অন্য রানীর আট বছর বয়সী ছোট ছেলে তুতেনখামেনকে মিসরের ফারাও নির্বাচন করেন। বালক তুতেনখামেনকে সিংহাসনে বসিয়ে মূলত পুরোহিতরা সমগ্র মিসরকে আগের অবস্থায় নিয়ে যান। আখেনাতেন শহরের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। আবার পুরোদমে উপাসনা শুরু হয় কার্নাকের মন্দিরে। সূর্য দেবতা আতেনের বিদায় হয় এবং আবার শুরু হয় দেবতা আমুন-রা এবং অন্যসব দেবদেবীদের উপাসনা। এরই মধ্যে ক্ষমতায় আরোহন করেন প্রধান পুরোহিত আঈ। তিনি মিসরজুড়ে আবারও উপাসনার জন্য সকল দেবতাকেই সমান প্রাধান্য দিলেন। মিসর আবারও একীভূত হলো।

পরবর্তীতে তুতেনখামেনকেও হত্যা করা হয়েছিলো এবং এ হত্যাকাণ্ডে সন্দেহের তীর পুরোহিত আঈ এবং তুতেনখামেনের স্ত্রীর দিকেই যায়। এদের সাথে আঈয়ের স্ত্রীও জড়িত বলে মনে করা হয়। তুতেনখামেনের সন্তানকেও তার সাথেই সমাধিস্থ করা হয়। ক্ষমতার সংঘাতে শিশুরাও বলি হয়। বহু ঈশ্বরের ধারণা থেকে একক ঈশ্বরের ধারণা গমন এবং সেখান থেকে পুনরায় বহু ঈশ্বরবাদে ফিরে আসার পথে যত গুপ্তহত্যা হলো সবই ধর্মীয় কারনে।

এক্ষেত্রে বলে রাখা দরকার যে ফারাও আখেনাতেনের একঈশ্বরবাদী মতবাদের কারণে অনেকে তাকে মূসা (আঃ) এর সাথে মিলিয়ে ফেলেন। যদিও এর কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। আখেনাতেন মিসরীয়দের প্রচলিত সকল দেব-দেবতার বাতিল করে, এক ঈশ্বরের উপাসনা চালু করেছিলো, এক্ষেত্রে বলা চলে আখেনাতেন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছিলো। কিন্তু প্রাচীন মিসরীয় পুরোহিতদের কাছে তাকে হেরে যেতে হয়েছিল।
[…] রিজন, শাহরিয়ার। “ফারাও আখেনাতেন এবং মিসরীয় একেশ্বরবাদ।” ইতিবৃত্ত, আগস্ট ১৪, ২০১৮।https://itibritto.com/pharaoh-akhenaten-and-egyptian-monotheism/ […]