২৩ ডিসেম্বর ১৭৮৭ সাল । ইংল্যান্ড থেকে একটি ছোট বাণিজ্য জাহাজ যাত্রা শুরু করে প্যাসিফিক সাগরের দিকে । জাহাজের নেতৃত্বে রয়েছেন ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির চৌকস অধিনায়ক উইলিয়াম ব্লিগ । গন্তব্য তাহিতি দ্বীপ । এই যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল তাহিতি দ্বীপ থেকে রুটি ফলের চারা সংগ্রহ করা ও ব্রিটিশদের দখলকৃত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিভিন্ন দ্বীপ প্রেরণ করা, যাতে ওই সব এলাকার খাদ্য চাহিদা পুরন করা যায় । ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিভিন্ন দ্বীপে খাদ্য সরবরাহ করা ছিল ব্রিটিশদের জন্য অনেক বড় সমস্যা । উদ্ভিদ বিজ্ঞানি স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কের পরামর্শে ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটি এই অভিযানটি আয়োজন করে । আদতে এই সাধারন অভিযানটি পরবর্তীতে ব্রিটিশদের ইতিহাসে স্থান করে নেয় । প্রিয় পাঠক আজ আমরা জানবো মার্চেন্ট শীপ এইচ এম এস বাউন্টির ইতিহাস বিখ্যাত বিদ্রোহের কথা ।
জাহাজ হিসেবে বাউন্টি কেমন ছিল?
বাউন্টি ছিল মূলত একটি ছোট বাণিজ্য জাহাজ । ১৭৮৭ সালে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি এই জাহাজ টি ক্রয় করে । তার আগে এটি বাণিজ্যিক কাজেই ব্যবহার করা হত । বাউন্টির দৈর্ঘ্য ছিল ২৭.৭ মিটার । নাবিক ও অফিসার মিলে মোট লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ৪৬ জন । বাউন্টির ওজন ছিল মাত্র ২১৫ টন ।
২০ ডিসেম্বর ১৭৮৭ সালে লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ব্লিগ এইচ এম এস বাউন্টি কে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন । জাহাজের ক্রু এবং অফিসার মিলে সর্বমোট ছিল ৪৬ জন । তার মাঝে ৪৪ জন ছিলেন ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির সদস্য ও ২ জন ছিলেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী । তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ফ্লেচার ক্রিস্টিয়ান, অ্যাডামস, ব্রাউন, মারটিন প্রমুখ । বাউন্টি তাহিতিতে পৌঁছে এবং পাঁচ মাস তাহিতিতে অবস্থান করে । তাহিতি থেকে ইংল্যান্ড ফেরার পথেই ঘটে বিপত্তি । ২৮ এপ্রিল ১৭৮৯ সালে লেফটেন্যান্ট ফ্লেচার ক্রিস্টিয়ানের নেত্রীত্বে জাহাজের কিছু ক্রু ও অফিসার বিদ্রোহ ঘোষণা করে । বিদ্রোহ কারীরা লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ব্লিগকে ও তার অনুসারী আঠারো জনকে একটি ছোট নৌকাতে উঠতে বাধ্য করে এবং অল্প কিছু খাবার দিয়ে বিদ্রোহকারীরা পালিয়ে যায় । বিদ্রোহকারীরা কখনও স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি যে লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ব্লিগ আবার ইংল্যান্ড এ ফিরতে পারবেন । লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ব্লিগ ও তার দলবলকে বাঁচতে হলে কমপক্ষে ৩৫ হাজার নটিক্যাল মাইল সমুদ্র পারি দিতে হবে একটি ছোট নৌকাতে করে যা ছিল প্রায় অসম্ভব একটি কাজ । তাছাড়া তাদের কাছে খাবারও ছিল অনেক অল্প । কথায় আছে, রাখে আল্লাহ মারে কে । এই অসম্ভব কাজ টিকে সম্ভব করে দেখিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ব্লিগ ও তার দলবল । লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ব্লিগ ছিলেন প্রচণ্ড একরোখা একজন মানুষ । তার জেদ চেপে গিয়েছিল, যেভাবেই হোক বিদ্রোহীদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে । লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ব্লিগ ছিলেন একজন অভিজ্ঞ নাবিক ও দক্ষ নেতা । তিনি মাত্র সাত বছর বয়সে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভিতে যোগ দিয়েছিলেন । তার জীবনের একটি বড় অংশই তিনি সমুদ্রে কাটিয়েছিলেন । তিনি তার বিশাল অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দলকে সঠিকভাবে নেত্রীত্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন । লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ব্লিগ ছিলেন প্রচণ্ড বদ মেজাজি ও একরোখা, নৌকার বাকি সব অভিযাত্রী তাকে খুব ভয় পেত এবং তার প্রতি অনুগত ছিল । যেহেতু তাঁদের কাছে খাবার খুব অল্প ছিল তাই তিনি প্রতিদিন খুব অল্প পরিমানে খাবার অভিযাত্রীদের মাঝে ভাগ করে দিতেন । অনেক দিন কঠিন পরিশ্রম ও অনেক বিপদ মোকাবেলা করে অবশেষে ১৭৯০ সালে তারা ইংল্যান্ড এ পৌঁছান ।
বিদ্রোহ কেন হয়েছিল ?
আগেই বলেছি লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ব্লিগ ছিলেন প্রচণ্ড বদ মেজাজি ও একরোখা । তিনি সর্বত্র তার প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করতেন । বাউন্টির বেশিরভাগ ক্রু এবং অফিসার ব্লিগ এর বাছাই করা ছিল । সেইলিং মাস্টার ছিলেন জন ফ্রেজার । উইলিয়াম প্যাকওভার এবং জোসেফ কোলম্যান আগেই এইচ এম এস রেজুলেশন জাহাজে উইলিয়াম ব্লিগের সাথে কাজ করেছিলেন । জাহাজ ব্রিটানিয়া তে ব্লিগ এর সাথে কাজ করা বেশির ভাগ নাবিককে তিনি বাউন্টি তে নিয়োগ দিয়েছিলেন । অর্থাৎ বেশির ভাগ ক্রু এর ব্লিগ এর সাথে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল । ক্রুদের মধ্যে ২৩ বছর বয়সী ক্রিশ্চিয়ান ছিল খুবই সম্ভ্রান্ত পরিবার এর সন্তান । অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ক্রিশ্চিয়ান জাহাজকেই তার পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ।
ক্রিশ্চিয়ানের ব্লিগ এর সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল এবং ব্লিগ ক্রিশ্চিয়ানকে খুবই পছন্দ করতেন । প্রথম দিকে ব্লিগ ও ক্রিশ্চিয়ানের সম্পর্ক অনেক আন্তরিক ছিল । বাউন্টিতে অধিকাংশ ক্রু এর গড় বয়স ছিল ৩০ বছর । উইলিয়াম ব্লিগের বয়স ছিল ৩৩ । জাহাজের সবচাইতে বেশি বয়স্ক ছিলেন ৩৯ বছর বয়সী উইলিয়াম প্যাকওভার । জাহাজে থাকার যায়গা অফিসারদের র্যাঙ্ক অনুযায়ী নির্দিষ্ট করা হয়েছিল । সবচাইতে বড় কেবিনটি ছিল উইলিয়াম ব্লিগের । তার বিপরীত দিকে ফ্রেয়ারের কেবিনটি ছিল খুবই ছোট । প্রথম দিকে ক্রিশ্চিয়ান ছিল মাস্টার মেট । পরবর্তীতে ব্লিগ তাকে প্রমোশন দিয়ে লেফটেন্যান্ট বানান । এই সিদ্ধান্তে ফ্রেয়ার খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন । ব্লিগ জাহাজের নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য খুবই কঠোর ছিলেন । পান থেকে চুন খসলেই ব্লিগ নাবিকদেরকে শাস্তি দিতেন । শাস্তির মধ্যে ছিল খাবার বন্ধ করে দেওয়া, জাহাজ পরিস্কার করানো ইত্যাদি । অপরাধ বেশি হলে বন্দি করে রাখতেন । ব্লিগ এর এই কঠিন নিয়ম কানুনের জন্যই মূলত নাবিকদের মধ্যে অসন্তুষ্টের দানা বাঁধতে থাকে । বাউন্টি তাহিতি দ্বীপে পৌঁছার পর পাঁচ মাস ওইখানে অবস্থান করে । ওই পাঁচ মাসে নাবিকদের থেকে ব্লিগ এর নিয়ন্ত্রণ অনেক কমে যায় । নাবিকরা পলিনেসিয়ান মেয়েদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে । অনেক নাবিক নাচ গান ও মদের নেশায় মত্ত থাকত । এসব কারনে ব্লিগ খুবই অসন্তুষ্ট হতে থাকে । ক্রিশ্চিয়ান তাহিতির এক সর্দারের মেয়ে মাওয়াতুয়ার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পরেন । তখন থেকেই ব্লগ ও ক্রিশ্চিয়ানের সম্পর্কে চির ধরে । ব্লিগ ক্রিশ্চিয়ানকে ক্রমাগত তিরস্কার করতে থাকেন । ব্লিগ ইংল্যান্ড এ যাওয়ার পরে নাবিকদের বিরদ্ধে রিপোর্ট করবে বলে হুমকি দিতে থাকেন । বাউন্টি পুনরায় ইংল্যান্ডের পথে যাত্রা করার পূর্বে নাবিকরা সবাই বেশ অস্বস্তির মধ্যে ছিল । তারা ভয় পাচ্ছিল যে ব্লিগ যদি রিপোর্ট করে তাহলে তাদের পরিনতি খুব ভাল হবে না । তাই কয়েক জন জাহাজ ছাড়ার পূর্বে জাহাজের হিসাব বইয়ে সাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান । অপর দিকে বাউন্টির ডাক্তার সার্জেন হুগান এর ভুল চিকিৎসায় ও অবহেলায় জেমস ভ্যালেন্টাইন মারা যায় । নিজের ভুল ঢাকতে হুগান ব্লিগকে অনুরোধ করেন এই মর্মে রিপোর্ট তৈরি করতে যাতে জেমস ভ্যালেন্টাইন স্কার্ভি রুগে মারা যায় । কিন্ত ব্লিগ হুগানকে গালি গালাজ করে তাকে দেখে নেবে বলে হুমকি দেন । এদিকে ক্রিশ্চিয়ানের তার বান্ধবী মাওয়াতুয়ার কাছে আবার ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল । ফিরতি যাত্রার মাত্র তিন সাপ্তহের মধ্যেই নাবিকরা বিদ্রোহ করে বসে । ২৮ এপ্রিল ১৭৮৯ সাল, বাউন্টি তখন তউফা দ্বীপ থেকে ৩০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিনে ছিল । ক্রিশ্চিয়ান সারা রাত অনেক চিন্তার পর বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নেয় । সে প্রথমে তার সবচাইতে অনুগত ক্রু ইয়ং এবং স্টেওয়ারটকে তার সিদ্ধান্ত জানায় । তারা তাকে পূর্ণ সমর্থন করে । ভোর ৫ টা ১৫ মিনিটে ক্রিশ্চিয়ান উপরের ডেকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেন ।
ক্রিশ্চিয়ানের সাথে আরও কয়েকজন বিদ্রোহতে অংশ নেয় । তারা ব্লিগ ও বাকিদের অস্ত্র কেড়ে নেয় । প্রথমে তারা ব্লিগকে একটি ছোট নৌকাতে নামিয়ে দিতে চেয়েছিল যার ধারন ক্ষমতা ছিল মাত্র ১০ জন । কিন্তু জাহাজের অর্ধেক নাবিকই ব্লিগ এর সাথে যেতে চেয়েছিল । তাই পরে ক্রিশ্চিয়ান জাহাজের সবচাইতে বড় নৌকাটি দিয়ে দেন, যার দৈর্ঘ্য ছিল ২৩ ফুট । আরও কয়েক জন নাবিক ব্লিগ এর সাথে যেতে চেয়েছিল কিন্তু স্থান সংকুলান না হওয়াই তারা জাহাজে থেকে যায় ।
ব্লিগ নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ১২ জুন Timor পৌছায় । ১৪ জুন একটি জাহাজে করে ব্লিগ Coupang harboiur এর দিকে যাত্রা করে । ওইখানে পৌঁছার পরে ব্লিগ বিদ্রোহের কথা চিঠিতে তার স্ত্রী ও রয়্যাল নেভি কে জানান ।
অপরদিকে ক্রিশ্চিয়ানের ভয় ছিল ইংল্যান্ড থেকে বাউন্টিকে খোঁজতে কোন জাহাজ এলে তারা ধরা পরে যাবেন । তাই ক্রিশ্চিয়ান প্রথমে তুবাই দ্বীপে পৌছায় যা তাহিতি থেকে ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল । ২৮ মে ১৭৮৯ সালে বাউন্টি তুবাই দ্বীপে পৌছায় । কিন্তু তুবাই এর স্থানীয়দের সাথে ক্রিশ্চিয়ানদের সংঘর্ষ হয় । ক্রিশ্চিয়ানরা তুবাই দখল করে ফেলে । ৬ জুন বাউন্টি তাহিতিতে আবার যায় এবং ১৬ জুন প্রায় ৩০ জন তাহিতির পলিনেশিয়ানকে নিয়ে বাউন্টি আবার তুবাই ফিরে আসে । ওইখানে আসার পরেও অনেক সংঘর্ষ হতে থাকে । বিদ্রোহীদের নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ হতে থাকে । পরবর্তীতে ১৬ জন তাহিতিতে আবার ফিরে যেতে চায় এবং ৮ জন ক্রিশ্চিয়ানের সাথে থাকতে চায় । বাউন্টি আবার ২২ সেপ্টেম্বর তাহিতিতে ফিরে আসে এবং ১৬ জনকে নামিয়ে দিয়ে ক্রিশ্চিয়ানের দলবল চলে যায় ।
ব্লিগ ১৪ মার্চ ১৭৯০ সালে ইংল্যান্ড পৌঁছান । ১৭৯০ সালের নভেম্বরে এইচ এম এস পাণ্ডুরা বিদ্রোহীদের ধরে আনতে অভিযান চালায় । ক্রিশ্চিয়ানের বাহিনীকে ধরা সম্ভব হয় নি । বাকি বিদ্রোহীদের আটক করা হয় । বিদ্রোহীদের কোর্ট মার্শাল হয় । অনেকের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয় । কয়েক জনের ফাঁশি হয় । অনেক বছর ধরে ক্রিশ্চিয়ানের দলবলের খোঁজ পাওয়া যায় নি । ক্রিশ্চিয়ানের দলবল পিটকেয়ারন আইল্যান্ড এ বসবাস করছিল । পরবর্তীতে ১৮০৮ সালে পিটকেয়ারন আইল্যান্ড আবিস্কার হয় । কিন্তু ততোদিনে ক্রিশ্চিয়ান সহ অনেকেই মারা যায়
তথ্যসূত্রঃ
১. Winfield 2007
২. Hough 1972
৩. Alexander 2003
৪. Darby 2004
৫. Bligh 1972