মুভি রিভিউঃ মেঘে ঢাকা তারা

0

 

ওষ্ঠে পাতার বিড়ি আর নিম্ন দামি বাংলা মদের বোতল হাতে, মাথাভর্তি  অগোছালো চুল, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ । চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। যদি কেউ তাকে প্রশ্ন করতো “আপনি কে?” তিনি সরাসরি উত্তর দিতেন “আমি একজন মাতাল । ভাঙা বুদ্ধিজীবী, ব্রোকেন ইন্টেলেকচুয়াল ।” নিজের পরিচয় এভাবে দিতে পছন্দ করতেন বিশ্ববিখ্যাত বাঙালী জীবনমুখী পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক (১৯২৫-১৯৭৬) । ভারতে অঁতর ধারার নিরীক্ষাধর্মী সিনেমাতে ঘটকের কাজ উল্লেখযোগ্য । তার আটটি সিনেমার মধ্যে “মেঘে ঢাকা তারা” চতুর্থ ও প্রথম ব্যবসা সফল সিনেমা । ১৯৭৫ সালে একটি বার্ষিক পত্রিকায় তিনি বলেছিলেন “দেশ বিভাগের প্রেক্ষাপটে নির্মিত মেঘে ঢাকা তারা ( ১৯৬০); কোমল গান্ধার( ১৯৬১); এবং সূর্বণরেখা( ১৯৬২) এই তিনটি মিলে ট্রিলজি নির্মিত হয়েছে ।”

"মেঘে ঢাকা তারা" সিনেমা
“মেঘে ঢাকা তারা” সিনেমা
Source: SlideShare

” মেঘে ঢাকা তারা” সিনেমার মূল কাহিনী গড়ে উঠেছে পঞ্চাশ দশকে কলকাতার এক বাঙালী পরিবারকে ঘিরে । ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে এই শরণার্থী পরিবার আশ্রয় নেয় কলকাতা শহরে । এই পরিবারের বড় মেয়ে নীতা-ই সিনেমার প্রধান ট্রাজিডি চরিত্র । বি,এ পাশ করে সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে । নীতার বৃদ্ধ বাবা স্কুলে পড়ায়, মা গৃহিণী । নীতার বড় ভাই শংকর, সে সংঙ্গীত চর্চা করে, ইচ্ছে পেশাদার গায়ক হবে । সংসারের কাজে শংকরের মন নেই । নীতার ছোট বোন গীতা ও ছোট ভাই মন্টু স্কুল পড়ুয়া । নীতার একজন ভালোবাসার মানুষও আছে তার নাম সনৎ । সনৎ নীতাকে কথা দিয়েছে পি এইচ ডি শেষ করে সে তাকে বিয়ে করবে । একদিন নীতার সব স্বপ্ন পূরণ হবে এমনটাই আশার করে সে, শংকর বড় গায়ক হবে, মন্টু ভালো চাকরি করবে, গীতার ভালো ছেলের সাথে বিয়ে হবে । আর সনৎকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে পাবে । এভাবে জীবনযৌবন নিয়ে নীতার গল্প সামনে গড়াতে থাকে । রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, অসুখ কোন কিছুই নীতা পরোয়া করে না । কখনো অফিস থেকে ফেরার সময় মাঝপথে চটিজোড়ার একটি ছিড়ে গেলে, খালি পায়ে হাঁটতে থাকে । তবু আশা ছাড়ে না নীতা । একসময় শংকর অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে বোম্বে চলে যায়, গায়ক হবার জন্য । কাহিনী মোড় নেয় অন্যদিকে । সনৎ পি এইচ ডি শেষ করে দেশে ফেরে । নিয়মিত নীতাদের বাড়িতে আসে নীতার সাথে দেখা করতে ।  একসময় নীতা জানতে পারে গীতা সনৎ কে ভালোবাসে । সনৎও তাকে পছন্দ করে । তারা বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে । নীতার পরিবারও তাই চায় । কারণ নীতার বিয়ে হয়ে গেলে সংসারের হাল ধরবে কে । এরপর সনৎ গীতাকে বিয়ে করে শহরের ভালো একটি বাড়িতে আনন্দে সংসার করতে থাকে।

" মেঘে ঢাকা তারা" সিনেমার একটি দৃশ্য
” মেঘে ঢাকা তারা” সিনেমার একটি দৃশ্য
Source: Art House Cinema

হঠাৎ মন্টু অসুস্থ হয়ে যায়, তার চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে নীতা মানসিক ও শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে । অবেশেষে শংকর বোম্বে থেকে দেশে ফিরে আসে বড় গায়ক হয়ে । কিন্তু ততোদিনে নীতার সব স্বপ্ন মরে গেছে । এখন নিজেকে বাঁচানোই তার জন্য কঠিন হয়ে গেছে । বাড়ি ফিরে শংকর বুঝতে পারে নীতার টিবি হয়েছে । সে আর বাঁচবে না । শংকর নীতাকে চিকিৎসার জন্য পাহাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যায় । সেখানে জীবন মৃত্যুর দোলাচলে এসে নীতা শংকরকে জানায় “দাদা আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম,দাদা আমি বাঁচতে চাই” । সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখা যায় আকাশে,পাহাড়ের গাঁয়ে নীতার সেই আরতি ক্রমাগত প্রতিধ্বনি হতে থাকে ।

" মেঘে ঢাকা তারা" সিনেমার একটি দৃশ্য
” মেঘে ঢাকা তারা” সিনেমার একটি দৃশ্য Source: Alchetron

১৯৬০ সালের সেই নীতার আরুতি আজো এই সমাজে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে । এখনো আমাদের সমাজে নারীরা সন্তান উৎপাদন আর ঘরগেরস্থির কাজের ভেতর বন্দি । ঋত্বিক ঘটক একবার বলেছিলেন ” ছবি লোকে দেখবে । ছবি দেখানোর সুযোগ যতদিন খোলা থাকবে । ততোদিন মানুষকে দেখাতে আর নিজের পেটের ভাতের জন্য ছবি করে যাবো । কালকে বা দশ বছর পরে যদি সিনেমার চেয়ে ভালো কোনও মিডিয়াম বেরোয় আর দশবছর পর যদি আমি বেঁচে থাকি, তাহলে সিনেমাকে লাথি মেরে আমি সেখানে চলে যাবো । সিনেমার প্রেমে নেশায় আমি পড়িনি । আই ডু নট লাভ ফিল্ম ।”

পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক
পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক
Source: somewhere in… blog

কিন্তু তার অধিকাংশ সিনেমা তখন ব্যবসা সফল হয়নি এবং কেন হয়নি সেটাও তিনি জানতেন । তাই নিজের ছবি সম্পর্কে তিনি বলেছিন ” আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাব যে ইট ইজ নট এন ইমেজারি স্টোরি বা আমি সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি ।” অথচ আজও বাঙালি দর্শক সস্তা আনন্দ পেতে সিনেমা দেখতে হলে যায় মন ভরাতে । ভারি কিছু দিলে এরা নিতে পারে না, তখন ভালো সিনেমাও মুখ থুবড়ে পড়ে । শুধু ভালো পরিচালক এলে ভালো সিনেমা হবে না, সিনেমা বোঝার মতো রুচিসম্মত দর্শক তৈরি হওয়ারও প্রয়োজন আছে ।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More