রাজধানী ঢাকার ইতিহাস ঘাটলে নিদারুন পরিতাপ আর আফসোস পোহাতে হয়৷ আজকের এ নাগরিক হাসফাসের আড়ালে চাপা পড়ে থাকা সমৃদ্ধ ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয় বসবাসের অযোগ্য শহরের তকমা বয়ে বেড়ানো এই ঢাকা শহর কোন একসময় পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর ছিল৷ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান অবলুপ্ত হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ঢাকা শহর হারায় তাই তার মর্যাদা। আজকের জনবহুল ঢাকার বিভিন্ন রাস্তাও ছিল একসময় গাছপালা দিয়ে আচ্ছাদিত, বুড়িগঙ্গার কলকল ধ্বনি শোনা যেত কান পাতলে। ঢাকার জংগলে চরানো হত হাতি, আজ যা কল্পনা করা দুস্কর। পিলখানায় গড়ে উঠেছিল হাতির চারণকেন্দ্র। এলিফ্যান্ট রোড, হাতিরপুল, হাতিরঝিল, মাহুতটুলি, হাতিঘাট, গজমহল ইত্যাদি এলাকার সাথে মিশে আছে হাতির স্মৃতি। বিশ শতকের প্রথমার্ধে ঢাকায় হাতির সংখ্যা কমতে থাকে৷ ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে মিশে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া হাতির পালের কথা জানব আজ।
ঢাকায় হাতির পালের আগমন ঘটে মুঘল আমলে। হাতি ধরা, পোষ মানানো এবং হাতির প্রশিক্ষণের জন্য হাতিখেদা নামে একটি নতুন বিভাগ খোলা হয়। মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে হাতি ধরে একটি বিশেষ কায়দায় ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলে এনে পোষ মানানো হত। পোষা হস্তিনী দিয়ে বন্য হাতিকে ফাঁদে আনার এ পদ্ধতির নাম ছিল কুনকী। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যে স্থানে হাতি স্থানান্তর করা হয় সে স্থান পরিচিত হয় পিলখানা নামে। ফারসি পিল শব্দের অর্থ ছিল হাতি এবং খানা অর্থ ছিল জায়গা। সেই থেকে আজ পর্যন্ত জায়গাটি পিলখানা নামেই পরিচিত, বর্তমানে যেখানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদর দপ্তর স্থাপিত হয়েছে।
মুঘল আমলের পর থেকে পিলখানার হাতিগুলোকে বহুলাংশে সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা শুরু হয়৷ ১৮৬০ হতে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত উত্তর পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি উপজাতিদের দমনে হাতিকে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া উচ্চপদস্থ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা কর্মচারীদের যোগাযোগ বাহন, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদির কাজে হাতি একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হতে থাকে৷ ১৮৮১ সালে হাতিখেদা বিভাগে ১ জন সুপারিন্টেন্ডেন্ট, ১ জন হেড এসিস্ট্যান্ট, ২ জন ভেটেরিনারি সার্জন, ৩ জন কেরানি, ১ জন পশু হিসাবকারী এবং কয়েকজন মাহুত কর্মরত ছিলেন। শুধু যে সরকারি কাজেই হাতি ব্যবহার করত তা না, ঢাকার অভিজাত নাগরিকরাও শখের বশে হাতি কিনে নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কাজে ব্যবহার করত। প্রাচীন ঢাকার ইদ মিছিল, মহররমের মিছিল কিংবা জন্মাষ্টমীর মিছিলে সুসজ্জিত হাতির পাল ছিল অন্যতম আকর্ষণ।
ঢাকার রাস্তায় হাতির স্মৃতি
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পিলখানা থেকে হাতির পালকে শহরের ভেতর দিয়ে রমনা উদ্যানে চড়ানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হত৷ পথিমধ্যে হাতির পায়ের আঘাতে রাস্তাঘাট, অবকাঠামোর, ফসলাদির ক্ষতি হওয়ার কারণে সাধারণ জনগণ হাতিকে স্রেফ উপদ্রব মনে করত৷ এর প্রতিবিধানের জন্য ঘনঘন শহর কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের হাতি নিয়ে অভিযোগ করতে হত৷ সাধারণের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ১৮৬৪ সালে ঢাকা পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হলে পৌর কর্তৃপক্ষ শহরের উত্তরাঞ্চল দিয়ে রমনা যাওয়ার জন্য একটি আলাদা রাস্তা তৈরি করে, যার নাম দেয়া হয় এলিফ্যান্ট রোড।
এই এলিফ্যান্ট রোড দিয়েই রমনা ও সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় হাতির পাল চরানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হত৷ এছাড়াও ঢাকার হাতিরপুল, হাতিরঝিল, হাতিঘাট, মাহুতটুলি ইত্যাদি জায়গার সাথেও মিশে আছে হাতির স্মৃতি। ঊনবিংশ শতকে নবাবগঞ্জের যে ঘাটে হাতিদের গোছল করানো হত, সেই ঘাটটিকে স্থানীয়রা হাতিরঘাট নামেই ডেকে আসছে। সোনারগাঁও রোডের এলিফ্যান্ট রোড ও পরিবাগের মধ্যখানে একটি বড় পুল ছিল, আর এই পুলের নিচ দিয়ে হাতির পাল চলাচল করত বলে এলাকাটি হাতিরপুল নামে পরিচিতি পায়। মুঘল আমলে আজকের মাহুতটুলি তে ছিল প্রচুর পরিমাণে মাহুতের বাস, আর এ থেকেই জায়গাটির নাম হয়ে যায় মাহুতটুলি। এ জায়গাগুলো ছাড়াও হাতিরঝিল, সাতমসজিদ ঝিল, কুড়িপাড়া ঝিল কোন না কোনভাবে জড়িয়ে আছে হাতির স্মৃতির সাথে।
হাতির পালের বিলুপ্তি
বেংগল ইঞ্জিনিয়ার্সের লেফটেন্যান্ট কর্নেল সি.যে. সি ডেভিনসন ১৮৪১ সালে তার ঢাকা ভ্রমণে পিলখানা দেখতে গিয়েছিলেন। তখন সেখানে ১২৫ টি হাতি ছিল, যার মধ্যে বেশিরভাগ ছিল বাচ্চা হাতি। ১৮৬৪ সালের বর্ণনায় রেমিনিসেন্স অফ ঢাকা গ্রন্থের লেখক হৃদয়মাথ মজুমদার বলছেন পিলখানায় হাতির সংখ্যা ছিল ১৫০ টি। তার দেয়া তথ্যমতে জানা যায় ১৮৮৫ সালে হাতিখেদা বিভাগ যখন বার্মাতে স্থানান্তরিত করা হয় তখন পিলখানায় কয়েকটি দেশি স্কুল গড়ে উঠে এবং বাকি জায়গা ঢেকে যায় জংগলে। হাতিখেদা বিভাগ বার্মাতে নিয়ে যাওয়ার পর কার্যত ঢাকায় হাতির বিচরণ স্তব্ধ হয়ে যায়, তবুও ১৯০৯ সালে পিলখানায় শেষবারের মত কিছু হাতি দেখা গিয়েছিল।আজকের এলিফ্যান্ট রোড কিংবা হাতিরপুলের রাস্তায় কান পাতলে হয়তো শুনা যাবে পুরনো ঢাকার সেই হাতির পালের থপথপ শব্দ!