এল ডোরাডো, হারিয়ে যাওয়া সেই “সোনার শহর” স্প্যানিশ দখলদারদের থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বহু অনুসন্ধানীদের মন্ত্রমুগ্ধের মত আকর্ষণ করেছে। সেই আকর্ষণ কিন্তু শুধু অজানা কে জানার নেশায় নয় বরং এল ডোরাডো অভিযানের পেছনে রয়েছে সোনার প্রতি মানুষের এক অদম্য লোভ। শত শত বছর ধরে ধন রত্নের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই জন্ম নিয়েছে কাল্পনিক সেই সোনার শহরের গল্প।
ষোল এবং সতের শতকের দিকে ইউরোপীয়রা বিশ্বাস করত যে দক্ষিণ আমেরিকার কোন একটা অংশে লুকিয়ে আছে সোনায় মোড়ানো একটি শহর যার নাম এল ডোরাডো। সেই সোনার শহরের স্বপ্নে বিভোর হয়ে বহু অভিযাত্রী দল দক্ষিণ আমেরিকার রেইন ফরেস্ট এবং পার্বত্য অঞ্চল সমূহে ব্যর্থ অভিযান চালিয়ে আসছে কিন্তু এই সোনার সন্ধান আজও মেলেনি। কারণ সেই সোনার শহর কোন স্থান নয় বরং একজন ব্যক্তি!
এল ডোরাডো মিথ (Myth) এর উৎপত্তির কাহিনী মূলত দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ায় বসবাসকারী মুইসকা(Muiska) সম্প্রদায় এর সাথে জড়িত। ‘এল ডোরাডো’ শব্দটি স্প্যানিশ, যার অর্থ ‘স্বর্ণের তৈরি’ । মূলত, স্প্যানিশরা ‘এল হমব্রে ডোরাডো’ (সোনায় খচিত মানুষ) বা ‘এল রেই ডোরাডো’ (সোনায় খচিত রাজা) এই শব্দগুলো ব্যবহার করত একটা প্রাচীন উপজাতি, কলম্বিয়ার ‘মুইসকা’ জাতির প্রধান ‘জিপা’-কে নির্দেশ করতে। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে, ‘মুইসকা’-রা রাজ্যাভিষেক এর সময় নতুন রাজা কে সোনা দানায় সজ্জিত করে নিয়ে যেতো গুয়াতাভিতা নামক একটি হ্রদের কাছে।রাজা সেই হ্রদে ডুব দিয়ে তার শরীরে জড়ানো সোনা দানা বিসর্জন দিতো সূর্য্য দেবতাকে খুশি করতে।আর সেই থেকেই এসেছে ‘এল ডোরাডো’ লোককথা। ‘এল ডোরাডো’-কে নিয়ে লোককথা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়; এটা শুরু হয় একটা সোনায় মোড়ানো মানুষ দিয়ে, তারপর সোনার শহর , সোনার রাজ্য হয়ে পরবর্তীতে এটা সোনার সাম্রাজ্যের লোককথায় পরিণত হয়।
‘মুইসকা’ সম্প্রদায় এর মানুষরা নিচু এলাকা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে বসবাসের জন্য কলম্বিয়ার চুন্দিনামার্কা ও বয়াকা অঞ্চলের উঁচুভূমিতে আসে যথাক্রমে খ্রিষ্টপূর্ব ১২৭০ ও খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০-৫০০ সালের মধ্যে। এসময়ে পৃথিবীতে থাকা অন্যান্য অনেক সমৃদ্ধ সম্প্রদায়, যেমন মায়া ও ইনকা সমপ্রদায়ের লোকেরাও উচু ভূমিতে এসে বসবাস শুরু করে। মায়া বা ইনকার মত মুইসকা সম্প্রদায় ও সমৃদ্ধ ছিলো। যখন তাদের নতুন নেতা নিযুক্ত হতো, তখন তার দায়িত্ব গ্রহণের আগে অনেক প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। এরকমই একটা প্রথা ছিলো যা পালন করতে নতুন রাজাকে গুয়াতাভিতা হ্রদের কাছে আনা হতো, তারপর তাকে সোনা দানায় সজ্জিত করা হতো। তারপর সোনা তৈরি উপকরনে সজ্জিত একটা ভেলায় অনেক সোনা ও দামী পাথরের সাথে তাকে ও তার সাথীদেরকে রাখা হতো। তারপর ভেলাটাকে হ্রদের কেন্দ্রে পাঠানো হতো, যেখানে হবু রাজা হ্রদের পানিতে ডুব দিয়ে সূর্য্য দেবতার সমস্ত সোনা দানা বিসর্জন দিতো। সেসময়ে ভেলায় থাকা রাজার সাথীরা ও সোনা ও মূল্যবান পাথরগুলো হ্রদের পানিতে নিক্ষেপ করতো। এই প্রথাটাকে মুইসকা্রা দেবতার প্রতি তাদের ত্যাগ বলে বিবেচনা করতো। সেখানে ‘এল ডোরাডো’ নামে কোনো শহর ছিলো না, বরং ঐ প্রথার মধ্যমণি রাজাকেই ‘এল ডোরাডো’ (স্বর্ণে খচিত) বলা হতো। যদিও ‘এল ডোরাডো’ একমাত্র রাজাকেই বলা হতো, তবে পরবর্তীতে ‘সোনার হারানো শহর’ বা দ্রুত সম্পদ আহরণ করা যায়, এমন কোন জায়গাকে নির্দেশ করতেও এ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়।
এ প্রথার বর্ণনা পাওয়া যায় Juan Rodriguez Freyle এর লেখা ঘটনার বিবরণে। Freyle এর মতে, মুইসকার প্রধান ‘জিপা’ গুয়াতাভিতায় একটা প্রথা পালন করেছিলো যেটায় সে ভেলায় করে লেকের মাঝখানে গিয়ে নিজের সোনা দানায় মোড়ানো দেহ পরিষ্কার করছিলো আর তার সাথীরা সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিস লেকে ফেলছিলো। ১৬৩৮ সালে Freyle গুয়াতাভিতার গভর্নরের বরাত দিয়ে এ প্রথা সম্পর্কে লিখেন, “এই অনুষ্ঠানটা নতুন শাসকের দায়িত্ব গ্রহণের সময় হয়।
দায়িত্ব গ্রহণের আগে তাকে একটা গুহায় কিছু নির্ধারিত সময় অবস্থান করতে হয়, নারীসঙ্গ ছাড়া, যেখানে তার লবণ খাওয়া মানা বা দিনের আলোতে বাইরে যাওয়াও মানা। প্রথম যাত্রায় তাকে গুয়াতাভিতার বিখ্যাত উপহ্রদে যেতে হয়, যেখানে তাকে দৈত্যকে কিছু মূল্যবান জিনিস উপহার দিতে বা ত্যাগ করতে হয় যাকে তারা তাদের দেবতা হিসেবে মানে। এই অনুষ্ঠানে তারা সরু কাণ্ডবিশিষ্ট পাতাহীন একপ্রকার উদ্ভিদের তৈরি ভেলা প্রস্তুত করে, যেটাকে তারা তাদের কাছে থাকা সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসগুলো দিয়ে সাজায়। তারপর তারা ভেলাটিকে চারটি প্রজ্বলিত কয়লা রাখার পাত্রের উপর স্থাপন করে, যে পাত্রগুলোতে তারা নানা রকম সুগন্ধি ও ধুপ-ধুনা জ্বালানো থাকে। উপহ্রদটি এতই বড় ও গভীর ছিলো যে, ভালোভাবে সজ্জিত নারী-পুরুষে পূর্ণ একটা উঁচু ডেকের জাহাজও এতে চলতে পারতো। এভাবে ভেলাটিকে সাজানোর পর ভেলা চলতে শুরু করলে ভেলা থেকে ধুপের ধোয়া বের হতো, সেটা দেখে তারাও সৈকতে ধুপ জ্বালাতো, যাতে ধোয়ায় দিনের আলো ম্লান হয়ে চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। এ অনুষ্ঠানে তারা হবু রাজার দেহত্বক হতে লোম তুলে নেয় ও তার দেহ স্বর্ণের গুড়াযুক্ত আঠালো মাটি দিয়ে লেপে দেয়। ফলে তার দেহ সোনা দিয়ে পুরোপুরি আবৃত হয়ে পড়ে। তারপর তাকে ভেলায় রেখে আসা হয় এবং তার পায়ে এক স্তূপ সোনা ও দামি পাথর রাখা হয়, যাতে সে তা ঈশ্বরকে উপহার দিতে পারে। ভেলায়, তার সাথে আরো ৪ জন গোত্রীয় প্রধান নেতা যায়; যাদের মুকুট – গয়না – সবই সোনার তৈরি। তারা সবাইও থাকে নগ্ন, আর সবাই নিজ নিজ উপহার বহন করে। ভেলাটি হ্রদের কেন্দ্রে পৌঁছলে তারা একটা ব্যানার উঠায়, যা পাড়ের সবাইকে নীরব থাকার নির্দেশস্বরূপ। তারপর মূল নেতাটি সোনার স্তূপ থেকে সব সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী পানিতে ছুড়ে ফেলে দেয়, তার দেখাদেখি বাকি ৪ সাথী নেতাও তাদের সাথে থাকা সব সোনা ও মূল্যবান পাথর পানিতে ছুড়ে ফেলে দেয় । তারপর, তারা ব্যানারটা নামায়, যেটা এতক্ষণ ত্যাগের সময়ে উড়ছিল। তারপর ভেলাটা সৈকতের দিকে রওনা হয়। সৈকতে থাকা মানুষদের মধ্যে চিৎকার-চেঁচামেচি, বাঁশির শব্দের পরিমাণ ক্রমে বাড়তে থাকে। বড় বড় দলে তারা গান গাইতে আর নাচতে থাকে। তারপর, ভেলাটি তীরে পৌঁছালে এ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে ও রাজাকে রাজা ও শাসক হিসেবে মেনে নেয়া হয়। এটাই সেই অনুষ্ঠান যেটা পরবর্তীতে বিখ্যাত ‘এল ডোরাডো’ আখ্যানে পরিণত হয়, যা অনেক জীবন ও ভাগ্য নিয়ে খেলা করেছে।”
এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে মুইসকাদের ভেলার একটা সোনার রেপ্লিকা, যেটি কলাম্বিয়ার পাসকায় একটা গুহায় পাওয়া যায় ১৮৫৬ সালে, সোনার তৈরি আরো অনেক জিনিসের সাথে। এটাই সেই মুইসকাদের ভেলা, যাতে চড়ে সোনার গুঁড়োয় আবৃত রাজা ‘জিপা’ গুয়াতাভিতা লেকের মাঝে গিয়ে দেবতার উদ্দেশ্যে মহামূল্যবান ধনরত্ন উৎসর্গ করতো।
মুইসকা সম্প্রদায় এর ধন রত্ন বিসর্জনের সেই কাহিনী সময়ের সাথে বদলে গিয়ে আজকের এই হারানো সোনার শহরের কল্পকাহিনিতে পরিণীত হয়েছে। কিন্তু অনেকের কাছে এই শহরের সত্যিই অস্তিত্ব রয়েছে এবং এই সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছে। লোভের বশবর্তী হয়েই হউক বা খ্যাতির মোহে অথবা রহস্যের সন্ধানে , অনেকেই এল ডোরাডো’র সন্ধানে বহু অভিযান পরিচালনা করেছে। কল্পকাহিনী যেমন পরিবর্তিত হয়েছে তেমনি বদলেছে এল ডোরাডো’র অবস্থান। সোনার শহরের সন্ধান শুধু কলম্বিয়া বা গুয়াতাভিতা হ্রদের আশে পাশে সীমাবদ্ধ থাকেনি সমস্ত ল্যাটিন আমেরিকায় এর অনুসন্ধান কার্য ছড়িয়ে পড়েছিলো এবং আজো শেষ হয়নি সে অনুসন্ধান।
উপরের ছবিটা হলো কলাম্বিয়ার চুন্দিনামারকায় অবস্থিত গুয়াতাভিতা লেকের। শত শত বছর এখানে স্বর্ণের তৈজসপত্রের লোভে খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছে, লেকের পানি বালতি ভরে ভরে পাহাড়ের নিচে ফেলে লেকটা শুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কোনো স্বর্ণের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ১৯৬৫ সাল নাগাদ ঐতিহ্যবাহী এই লেকটি রক্ষার্থে কলাম্বিয়া সরকার আইন করে এখানে সকল প্রকার স্বর্ণ অনুসন্ধানী কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
সবশেষে বলা যায়, এল ডোরাডো, অপরমেয় সম্পদে পরিপূর্ণ হারিইয়ে যাওয়া সোনার শহর আসলে কখনো ছিলইনা। এল ডোরাডো, শুধু একজন ব্যাক্তি বা একজন রাজা এবং তার সম্প্রদায়ের আবাসস্থলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে গুয়াতাভিতা হ্রদের কাছাকাছি কিন্তু কল্পকাহিনীর বর্নীত সেই অঢেল সম্পদের সন্ধান মেলেনি যা যুগ যুগ ধরে অনুসন্ধানকারীদের আকৃষ্ট করেছে।
তথ্য সূত্রঃ
- Wikipedia
- BBC.com
- ancient origin.net
buy semaglutide without a prescription – desmopressin generic desmopressin
zyprexa street value
zofran and serotonin
wean myself off wellbutrin