বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন যে খুব একটা সমৃদ্ধ নয় তা আমাদের সবারই জানা। যা একটু তোড়জোড় শোনা যায় সেটি ক্রিকেট নিয়েই। তাও ক্রিকেট দলটি মাঝে মাঝেই খেই হারিয়ে ফেলে। ফুটবল তো তার স্বর্ণালী অতীত নিয়েই পড়ে আছে। এখন তো আবার আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার যোগ্যতাটুকুও হারিয়েছে। চমক দেখিয়ে যাচ্ছে শুধু নারী দল।
যাহোক আজ পরিচিত হই দেশের আরেকটি স্বল্প প্রচলিত খেলা হকি নিয়ে। আসলে বাংলাদেশের হকি সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? আগে মানুষ যতটুকু খোঁজখবর রাখত এখন তাও রাখে না। তবে বর্তমানে হকি কিছুটা হলেও সামনে এগুনোর পথে। সম্প্রতি কিছু ভালো ফল এসেছে যুব হকি দল থেকে। বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন আগের চেয়ে ভালো করার ব্যাপারে আশাবাদী। আজ আপনাদের জানাবো বাংলাদেশের হকির আদ্যোপান্ত।
বাংলাদেশে হকি খেলার প্রচলন সেই ব্রিটিশ শাসনামল থেকে। ১৯০৫ সালে নবাব খাজা সলিমুল্লাহ এদেশে হকির পৃষ্ঠপোষকতা করেন। কিন্তু তা শুধু নবাব পরিবারদের ভেতর প্রচলিত ছিল। সে সময় দেশে ফুটবল খুব জনপ্রিয় ছিল। তারপরেও কিছু পৃষ্ঠপোষক, সংস্থার মাধ্যমে অনেক দ্রুত খেলাটি এগিয়ে যেতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশিষ্ট হকি খেলোয়াড় ধ্যানচাঁদের একটি দল আরমানিটোলায় একটি প্রদর্শনী ম্যাচও খেলতে আসে। উল্লেখ্য যে, চমৎকার বল কন্ট্রোলিং ও গোল করার ক্ষমতার জন্য ধ্যানচাঁদকে জাদুকর বলা হত। এরপর ১৯৪৭ সালের দেশভাগ হলে হকির প্রসার অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে আমাদের দেশে যারা হকি খেলত ও হকিকে ভালোবাসতো তারা ভারতে পাড়ি জমায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি মৌসুমি খেলায় রূপ নেয়। পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান হকি দল বেশ কিছু টুর্নামেন্টে অংশ নেয়। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল ম্যাচ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ২-৩ জন খেলোয়াড় জাতীয় হকি দলে নিয়মিত খেলত।

দেশ স্বাধীনের পর দেশের হকিকে নিয়মিত মাঠে রাখার উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন (বাহফে)। ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশনের ফুল মেম্বারশীপ অর্জন করে বাহফে। ১৯৮৭ সালে একটি হকি স্টেডিয়াম তৈরি হয় যা মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম নামে পরিচিত। এটি হচ্ছে হোম অফ হকি।

Source: Daily Sun
১৯৭৭ সালের ১ম জুনিয়র বিশ্বকাপ কোয়ালিফাইয়িং রাউন্ড (এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চল) এ অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের করাচিতে আয়োজিত ১ম এশিয়া কাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ। এছাড়া ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে আয়োজিত এশিয়ান গেমসেও অংশ নেয় বাংলাদেশ। ১৯৮৫ সালে সবাইকে চমকে দিয়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয় এশিয়া কাপ হকির আয়োজন করে এবং চমৎকার পারফর্ম করে নজর কাড়ে। সে সময়ের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানের কাছে মাত্র ১-০ গোলে পরাজয় বরণ করে বাংলাদেশ। যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ম্যাচগুলোর একটি। এছাড়া ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক আমন্ত্রণ প্রাপ্ত হকি টুর্নামেন্টের আয়োজক ছিল বাংলাদেশ। যেখানে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা অংশ নেয়। এছাড়া দ্বিতীয় এশিয়া হকিতে ভারত, পাকিস্তান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, জাপান, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর ও ইরান অংশ নেয়।
সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে হকির অগ্রগতি তেমন একটা নেই। সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ডে হকি অঙ্গনকে দাঁড় করালে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারি হবে। এদেশের হকি তার সেরা সময় পার করেছে ১৯৮৫ সালে। বিশ্বকে জানান দেয় যে বাংলাদেশ উঠে আসছে। হকি চরম জনপ্রিয়তা লাভ করে, অলিতে গলিতে কিশোর তরুণদের হকি খেলতেও দেখা যেত। তবে পরিকল্পনার অভাবে তা আর ধরে রাখতে পারে নি বাংলাদেশ।
১৯৯৫ সালের মাদ্রাজ সাফ গেমসে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুর্দান্ত হকি খেলে বিতর্কিত এক পেনাল্টি স্ট্রোকে হেরে যায়। ১৯৯৭ সালে এক ঝাঁক তরুণদের দিয়ে আবারো লাইম লাইটে আসে বাংলাদেশ। কিন্তু ইতালিতে বাছাইপর্বে আশানুরূপ ফল আসে নি। সেই দলেরই একজন মাহবুব হারুন বর্তমান জাতীয় হকি দলের কোচিংয়ের দায়িত্বে। ১৯৭১সালে বার্সেলোনা ওয়ার্ল্ড কাপে তৎকালীন পাকিস্তান দলে ইব্রাহিম সাবের ও আব্দুস সাদেককে দলে নেয়া হয়েছিল। তারা ছিলেন দেশ বরেণ্য হকি স্টার। এছাড়া বিশেষভাবে জুম্মন লুসাইয়ের কথা তো বলতেই হয়। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্ব একাদশের হয়ে খেলার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৮২-১৯৮৯ পর্যন্ত দেশের রক্ষণভাগের দায়িত্ব সামলান। ১৯৮৫ সালে এশিয়া কাপে ইরানের বিপক্ষে খেলায় হ্যাট্রিক করেন। ১৯৮৯ সালে দিল্লীতে এশিয়া কাপে অংশগ্রহণ করে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ করেন তিনি। আবাহনীর কোচের দায়িত্ব পালন করতেও তাকে দেখা গিয়েছিল। ক্রীড়া ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ২০১১ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারে ভূষিত হন।
অনেক তো হলো পুরনো বুলি আওড়ানো। এবার দেখা যাক বর্তমান হকির কি অবস্থা। কেমন যাচ্ছে বর্তমান হকির দিনকাল?

Source: www.observerbd.com
সম্প্রতি ২০১৬ সালের অনূর্ধ্ব-১৮ হকি দল এশিয়ান কাপ হকিতে অংশ নেয় যার আয়োজক ছিল বাংলাদেশ। গ্রুপ পর্বে ভারতকে ৫-৪ গোলে হারিয়ে দারুণ শুরু করে বাংলাদেশ। এরপর ওমানকে ১০-০, চাইনিজ তাইপেকে ৬-১ গোলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। তবে ফাইনালে সেই ভারতের কাছেই স্বপ্নভঙ্গ হয় বাংলাদেশের। ফাইনালে ৪-৪ এ সমতা থাকা অবস্থায় শেষ বাঁশি বাজার ঠিক ৩ সেকেন্ড আগে গোল হজম করে ৫-৪ ব্যবধানে পরাজয় বরণ করে। যদি ম্যাচটি জিততে পারত তবে এটিই হত দেশের হয়ে হকির ১ম কোনো শিরোপা। ১৯৮৫ সালের পর আবারো ২০১৭ সালের এশিয়া কাপ হকির আয়োজক হয় বাংলাদেশ। গ্রুপ পর্বে সুবিধা করতে না পারলেও স্থান নির্ধারণী ম্যাচে চীনকে পেনাল্টি স্ট্রোকে ৪-৩ ব্যবধানে হারিয়ে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করে বাংলাদেশ। যার ফলে এশিয়া কাপ হকিতে এরপর সরাসরি অংশ নিতে পারবে বাংলাদেশ জাতীয় হকি দল।
এবার আসি ranking নিয়ে। ranking এর দিক হিসাব করলে বলতেই হবে যে উন্নতি হচ্ছে। জুলাই মাসেও আমাদের অবস্থান ছিল ৩৪তম। সেখানে ২০১৭ এশিয়া কাপে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করার ফলে ranking এ চার ধাপ এগিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় হকি দল অবস্থান করছে ৩০তম স্থানে। তবে উন্নতি যেন থেমে না থাকে সেটাই আমাদের সকলের কাম্য। বেশ কয়েকবছর ধরেই হকি শুধু জাতীয় দল কেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে। ঘরোয়া লীগ আয়োজন হচ্ছে না। তবে সম্প্রতি নতুন অ্যাডহক কমিটির অধীনে ঘরোয়া লীগ শুরু হচ্ছে যা অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে নতুন প্লেয়ার তৈরির ব্যাপারে আমাদের ফেডারেশনের আরো তৎপর হওয়া উচিত। রাজু, আশরাফুলের মত তরুণরা যেমন উঠে আসছে, ভবিষ্যতেও যেন এ ধারা অব্যাহত থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শুধুমাত্র বিকেএসপির দিকে তাকিয়ে না থেকে নিয়মিত স্কুল হকি টুর্নামেন্ট আয়োজনের পদক্ষেপ নিতে হবে। খেলোয়াড়দের যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। নিয়মিত বিদেশে ক্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে যে কোনো পরিবেশেই দেশের প্লেয়ার নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। আশা করছি দেশের এই সম্ভাবনাময় খেলাটি অনেক দূর যাবে, ক্রিকেটের মত এটিও দেশের জনপ্রিয় একটি খেলায় পরিণত হবে।