হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদ ধ্বংসের করুণ কাহিনীঃ মোঙ্গল নৃশংসতা ও পতন
১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ১২৫৮ সাল। দজলা নদীর শান্ত শীতল পানি ক্রমশ রক্তিম আকার ধারণ করছে। একটু আগেই সেখানে শুরু হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম ন্যাক্কারজনক গণহত্যা। জ্ঞান, সভ্যতা আর শিল্প-সংস্কৃতির অন্দরমহল মুসলিম সভ্যতার গর্বের ধন আরব্যোপন্যাসের নগরী বাগদাদে চলছে রক্তের হোলি খেলা। সাম্রাজ্যবাদের লোলুপ দৃষ্টির বলি নিরীহ মুসলিম নরনারী। শিশুদের আর্তচিৎকার আর ধ্বংসলীলার দোর্দণ্ডপ্রতাপে বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। মুদ্রার ওপর পাশে নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত রূপ দেখিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্য মোঙ্গল সেনাবাহিনী। মানবিকতার বালাই নেই, নেই বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়ার মানসিকতা। টানা এক সপ্তাহব্যাপী চলল নির্দয়, পাশবিক গণহত্যা! প্রাণ গেল দশ লক্ষাধিক নগরবাসীর।
মোঙ্গল নেতা হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদ ধ্বংসের করুণ কাহিনী আজ থাকছে ইতিবৃত্তের পাঠকদের জন্যে। সাথে উঠে আসবে মোঙ্গলদের পরিচয়, গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় ও বাগদাদ আক্রমণের পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ।
মোঙ্গল কারা?
পৃথিবীর বুকে একসময় দাপিয়ে বেড়ানো মোঙ্গলদের অস্তিত্ব আজ ইতিহাসের ঠুনকো পাতায় লিখিত। বোধ করি পৃথিবীর ধ্বংস পর্যন্ত এমন অবিবেচক, দুর্ধর্ষ, যুদ্ধংদেহী জাতিসত্তা আর আসবে না। নির্বুদ্ধিতা, অজ্ঞতা আর শক্তিমত্তার মিশেলের ফলাফল হিসেবে মোঙ্গলদের হাতে দুনিয়ার কত লোক যে নিহত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মানুষ হত্যার সাথে সভ্যতা ধ্বংস করে দেওয়ার পাশবিকতার সাথে যুক্ত হয়েছিল ইতিহাসের করুণ আর্তনাদ, এই দায় মেটাতে তাই লেগেছিল অর্ধ সহস্র সময়। কেমন ছিল এই ভয়ানক জাতি, অমানবিকতার দেবতার প্রতিটি কর্মী?
মোঙ্গলদের আদি নিবাস ছিল গোবি মরুভূমির উত্তর ও বৈকাল হ্রদের দক্ষিণে। মধ্য এশিয়ার মরু অঞ্চল ও পার্বত্যভূমির অজানা অনেক যাযাবরদের মধ্যে মোঙ্গলরা ছিল একটি। অনেক নৃতত্ত্ববিদ মনে করেন, মোঙ্গলদের আদি নিবাস বর্তমান মঙ্গোলিয়ায়। কিন্তু চৈনিক ঐতিহাসিকদের মতে, চৈনিক শব্দ মংগ থেকেই মোঙ্গল নামের উৎপত্তি যার অর্থ সাহসী। কাস্পিয়ান সাগরের তীর ঘেঁষে বসবাস করা ‘হুন’ জাতির বংশধর ছিল মোঙ্গলরা এমন তথ্য স্বীকার করেছেন অনেক ঐতিহাসিক। অনেক সময় তাঁতার জাতির সাথে মোঙ্গলদের গুলিয়ে ফেলা হলেও পরবর্তীতে তাদের পৃথক অস্তিত্বের কথা প্রমাণ পাওয়া যায় এবং তারও পরে তাঁতার ও মোঙ্গলদের সমন্বয়ে আবারো অভিন্ন মোঙ্গল জাতির গোড়াপত্তন হয়। ঐরাইট, মেরাইট, নাইমান ইত্যাদি নামের আলাদা গোত্রে বিভক্ত ছিল মোঙ্গলরা। মোঙ্গলরা নাকি সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল এমন দাবির পক্ষে মত দেন কিছু ঐতিহাসিক। কিন্তু তাদের সরল জীবনযাপনের নমুনা তুলে ধরলে তাদের আদৌ সরল বলে মনে হয়না। পার্বত্য ও মরু অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়ায় তাদের মধ্যে এক ধরণের খাপছাড়া ভাব চলে আসে। তাদের প্রধান পেশা ছিল লুটতরাজ ও পশুশিকার। পশুর চামড়া দিয়ে তারা তাদের বস্ত্রের চাহিদা মেটাত। তাদের নির্দিষ্ট কোন ধর্ম ছিল না। কেউ ছিল সূর্যপূজারী, কেউ খ্রিষ্টান, কেউবা বৌদ্ধ আবার কিছুসংখ্যক মুসলিমও ছিল। মোঙ্গল জাতির পিতা চেঙ্গিস খান ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন একজন সূর্যপূজারী। ধর্মীয় কোন বাধানিষেধ না থাকায় প্রায় সকল মোঙ্গলগণই যা খুশি তা করতে পারত, যা খুশি তা ভক্ষণ করতে পারত। জাতিতে বড় একরোখা মোঙ্গলরা স্বাভাবিকভাবেই হয়ে উঠেছিল সমরবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী। প্রস্তর যুগের মানুষদের মত ছিল তাদের স্পৃহা, কর্মপন্থা। চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মোঙ্গলরা তাদের সামর্থ্যের ষোলকলা দেখিয়ে দেয় বড় নিষ্ঠুরভাবে। রক্তের সাগরে জাহাজ চড়িয়ে তারা দখল করত নতুন নতুন এলাকা। মর নয় আত্মসমর্পণ কর এই নীতির উপর ভর করে আধিপত্য কায়েম করেছিল পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে পশ্চিমে কৃষ্ণসাগর এবং উত্তরে তুর্কিস্তান হতে দক্ষিণে সিন্ধু পর্যন্ত। নিহত হয়েছে ইউরোপ এশিয়ার কোটি মানুষ। তবে একথাও সত্য যে, মোঙ্গলদের ইতিহাস মনে রেখেছে একতরফাভাবেই। অপরিমেয় ধ্বংসযজ্ঞ ম্লান করে দিয়েছিল তাদের সকল ইতিবাচক অবদান। তারা যেমন সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য ধ্বংস করেছিল তেমনি নতুন সাম্রাজ্যের নবজীবন দিতেও খুব কম কার্পণ্য করেনি। মোঙ্গল আমলে মধ্য এশিয়ার পিকিং, তাশখন্দ, সমরকন্দ ছিল ঐ সময়ের উন্নত শহর। এই শহরগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল আন্তঃমহাদেশীয় যোগাযোগ। তাশখন্দ ছিল অস্ত্র সম্ভারের জন্য বিখ্যাত। সির দরিয়া ও আমু দরিয়া দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেও খদ্দের আসত সমরাস্ত্র কেনাবেচার জন্য। কুবলাই খানের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় চীনে চর্চা হয় জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিল্পকলার। তিনি সর্বপ্রথম ধাতুর পরিবর্তে কাগুজে নোট প্রচলন করেন। প্রাচ্যের রাফায়েল খ্যাত চিত্রকর কামাল উদ্দিন বিজোদ এবং কবি হাফিজ, শেখ সাদী, জালালুদ্দিন রুমী পারস্যের ইলখানি শাসনামলে মোঙ্গল সাম্রাজ্যে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যান। নিশ্চয়ই ওপর মহল থেকে তারা যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন নয়তো তা সম্ভব হত না আদৌ। এমনকি বাগদাদ ধ্বংসকারী নেতা হালাকু খানের পৃষ্ঠপোষকতায় নাসিরুদ্দিন তুসী আজারবাইজানে তৈরি করেন একটি মানমন্দির। মোঙ্গল রাজাধিরাজরা ধর্মের ক্ষেত্রেও উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। এর ফলাফল হিসেবে রাজদরবারে আগমন ঘটে মার্কো পোলো, কার্পিনি ও উইলিয়ামদের মত ইউরোপীয় পর্যটক ও ধর্মপ্রচারকদের।
বাগদাদের কসাই হালাকু খান
ভারতীয় উপমহাদেশের মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট অশোক যেমন কলিঙ্গ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন সাক্ষাৎ যমদূত হিসেবে, হালাকু খান সেই অশোকেরই প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন বাগদাদে। বাগদাদকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া এ নেতা ছিলেন চেঙ্গিস খানের নাতি। ১২১৭ খ্রিষ্টাব্দে তার জন্ম হয়। তার পিতা ছিলেন চেঙ্গিস খানের ছোট ছেলে তুলি এবং মায়ের নাম ছিল বেকি। তার মা ছিলেন একজন নেস্টোরিয়ান খ্রিষ্টান। মৃত্যুর ঠিক পূর্বমুহূর্তে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেও ১২৬৪ সালে এক আমেরিকান ইতিহাসবেত্তার কাছে নিজেকে জন্ম থেকে একজন খ্রিষ্টান বলে দাবি করেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিন সন্তানের জনক ছিলেন। পারস্যের ইলখানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন হালাকু খান। তার বংশধরগণ ইতিহাসে ইলখান নামে পরিচিত। তার ভাই মেংগু খান যখন মোঙ্গল সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন ভাইয়ের অধীনতা স্বীকার করে পশ্চিমাঞ্চলে সামরিক অভিযানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এই অভিযানেরই অংশ ছিল বাগদাদ আক্রমণ ও গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযান।
গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযান
মেংগু খান যখন পশ্চিমাঞ্চলে দ্বিতীয়বারের মত সামরিক অভিযান পরিচালনার কাজে হাত দেন তখন প্রথম কর্তব্য হিসেবে হালাকু খানের উপর বর্তে দেন দুর্ধর্ষ এসাসিন্স বা গুপ্তঘাতকদের ধ্বংস করে দেয়ার দায়িত্ব। একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইরান ও সিরিয়া অঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল এই রাজনৈতিক আততায়ীর দল। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের জন্য গুপ্তঘাতকদের ভাড়া করত প্রভাবশালী সব লোক। হাসান বিন সাবাহ নামের এক ব্যক্তি এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। এসাসিন্সরা নিজেদেরকে ‘ফিদায়িন’ বলে পরিচয় দিত। এদের কাজ ছিল টাকার বিনিময়ে রাজনৈতিক নেতৃবর্গকে খুন করা। আব্বাসী ও সেলজুকদের অনেক রাজকর্মকর্তা নির্মমভাবে নিহত হয়েছিল গুপ্তঘাতকদের হাতে। ইসমাইলি শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রধান দুর্গ ছিল পারস্যের আলামুত দুর্গ যার অর্থ ঈগলের বাসা। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ২,১৬৩ মিটার উঁচু এ দুর্গ ছিল কৌশলগত দিক দিয়ে খুব দুর্ভেদ্য। এছাড়া আলামুত দুর্গের আশেপাশে গড়ে উঠেছিল আরও প্রায় ৪০ টির মত দুর্গ। এরা সর্বদা মাদক ব্যবহার করত। সামরিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারা ছিল তাদের মূল টার্গেট। সেলজুক সুলতান মালিক শাহের উজির নিজামুল মুলক ছিলেন তাদের প্রথম শিকার। সুন্নি মুসলমানদের উপর এরা ছিল বিরাগভাজন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু থেকে আব্বাসীয় খলিফাদের দুর্বলতার সুযোগে এসাসিন্সরা পারস্যের পূর্বাঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করতে করতে মোঙ্গল সাম্রাজ্যে হানা দিতে শুরু করে। এতে মেংগু খান শঙ্কিত হয়ে এদের দমন করতে হালাকু খানকে পাঠান।
চূড়ান্ত অভিযান
১২৫৬ সালে হালাকু খান যখন মেংগু খানের নির্দেশে পারস্য অভিমুখে রওনা হন তখন ফার্সের বিদ্রোহী সেলজুক সুলতান আতাবেগ, আইজুদ্দিন এবং রুকুনুদ্দিন তার সাথে যোগ দেন। এ সম্মিলিত শক্তির তোপের মুখে পতন হয় এসাসিন্সদের শক্তিশালী চল্লিশটি দুর্গের। তারপরই হালাকু খানের বাহিনী গুপ্তঘাতকদের গর্বিত ও দুর্ভেদ্য দুর্গ আলামুতের দখল নিয়ে নেয়। একই সময়ে লানবাসার নামের অন্য একটি দুর্গও ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এরই সাথে কার্যত গুপ্তঘাতকদের সমূল উৎপাটিত হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত পারস্যের অসংখ্য সাধারণ নাগরিককে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় এ অভিযানে। যার ফলাফল হিসেবে তারা মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
বাগদাদ আক্রমণ!
অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাগদাদের শৌর্যবীর্য এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, সাম্রাজ্যবাদীরা এর উপর হানা দেয়ার মোক্ষম সুযোগ খুঁজতে থাকে। আরব্য রজনীর এ শহর তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে অর্থাৎ ৭৬২ সালে আব্বাসী খলিফা মনসুর যখন এ নগরী প্রতিষ্ঠা করেন ঠিক তার পরবর্তী পাঁচশত বছর আপন গাম্ভীর্য আর গৌরবে সমুজ্জ্বল ছিল মোঙ্গল নেতা হালাকু খানের ধ্বংস পূর্ব পর্যন্ত। বায়তুল হিকমা নগর বাগদাদ তৎকালীন সময়ে প্রথিতযশা সব পণ্ডিতদের যেন আঁতুড়ঘর ছিল। দুনিয়ার সর্বকোণের বিভিন্ন ভাষার বই অনুবাদের জন্য বিখ্যাত ছিল দারুল হিকমা। যুগের বিচারে এ গ্রন্থাগারকে মানবসভ্যতার জ্ঞানের গুদাম বললেও অত্যুক্তি হবে না। এই লাইব্রেরির কারণে পৃথিবীব্যাপী বাগদাদের আলাদা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়ে যায়। মুসলিম বিশ্বের রাজধানী হওয়ার কারণে আগে থেকেই মুসলিমদের নিকট বাগদাদ ছিল শ্রদ্ধার জায়গায়। তার সাথে আব্বাসী খিলাফতের গৌরবের ঝাণ্ডাও সগৌরবে বহন করে চলেছিল খলিফা হারুন অর রশিদের এ শহর। সবকিছু সুন্দর মতই চলছিল, কিন্তু কোথাকার এক বুনো দলের লকলকে জিহ্বার গ্রাস হতে যেন অপেক্ষা করছিল প্রাণের শহর বাগদাদ!
হালাকু খান গুপ্তঘাতকদের মর্মমূলে আঘাত করে তাদের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। স্বভাবতই সুন্নি মুসলমানগণ একটু দম নেবার চেষ্টা করে কেননা এসাসিন্সরা সুন্নিদের উপর বিরূপ মনোভাব করত। কিন্তু খুব শীঘ্রই সুন্নিদের কপালে ভাঁজ পড়ল। এর আগে গুপ্তঘাতকদের দমন করতে আব্বাসীয় খলিফা আল মুসতাসিম বিল্লাহ আশানুরূপ সাহায্য করেননি বা উদাসীনতা প্রকাশ করেছেন এমন দোহাই দিয়ে হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।মোঙ্গলদের দাবি অনুযায়ী গুপ্তঘাতকদের বিরুদ্ধে না গিয়ে সুন্নিদের খলিফা হওয়ার নীতিগত যোগ্যতা হারিয়েছেন মুসতাসিম। তাই বাগদাদ দখল করে সেই দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী মোঙ্গলরা। প্রকৃতপক্ষে এসব কারণ দেখানো স্রেফ অজুহাত ছিল। তাদের লক্ষ্যই ছিল আব্বাসীয় শৌর্যবীর্য ধ্বংস করে দেয়া এবং তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগায় বাগদাদ ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পনা।
১২৫৮ সালের জানুয়ারি মাস। মোঙ্গল বাহিনী বাগদাদের প্রান্তে তাদের সৈন্য সমাবেশ করল। মোঙ্গলদের চিরায়ত রীতি অনুযায়ী আত্মসমর্পণের জন্য মুসতাসিম বিল্লাহর কাছে পত্র পাঠানো হল। যথারীতি সে পত্রের ভাষা ছিল অত্যন্ত অপমানজনক। পত্রে বিশ্রীভাবে মোঙ্গলদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মুসতাসিম বিল্লাহকে কাপুরুষ আখ্যা দেয়া হল। সন্ত্রস্ত মুসতাসিম তখন তার আমির ওমরাহদের নিয়ে একটি সভা আহ্বান করলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসতাসিম বিল্লাহর প্রধান উজির ইবনুল আলকেমি তাকে সৈন্যবাহিনী কমিয়ে ফেলার পরামর্শ দেন। প্রকৃতপক্ষে আলকেমি ছিল মোঙ্গলদের গুপ্তচর। নৈতিকভাবে দুর্বল খলিফা তার পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং সেনাবাহিনী অর্ধেকে নামিয়ে আনেন। ওদিকে শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে আব্বাসীয়দের পক্ষ থেকে একদল প্রবীণ পরামর্শককে মধ্যস্থতা করার জন্য হালাকুর কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু জাত হিংস্র হালাকু প্রবীণ এ দলের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বেজে উঠে যুদ্ধের দামামা। মোঙ্গল, আর্মেনীয় খ্রিষ্টান আর চৈনিকদের সমন্বয়ে গড়া দুই লাখ সৈন্যের হালাকু বাহিনী অবরোধ করে বসে বিশ লাখ বাগদাদী জনগণকে। বিশ্বাসঘাতক আলকেমির কুপ্ররোচণায় দুর্বল, দায়িত্বজ্ঞানহীন, আমুদে খলিফা ১০ ফেব্রুয়ারি বাগদাদের নগর ফটক খুলে দিয়ে তার যাবতীয় ধন সম্পদ সঁপে দিয়ে আত্মসমর্পণ করে বসেন। বাঁচার শেষ চেষ্টা হিসেবে কাপুরুষোচিত ভূমিকা গ্রহণ করেও পার পেলেন না মুসতাসিম, সাথে মূল্য দিতে হয় বাগদাদের লাখ লাখ নিরপরাধ নাগরিককে। ক্ষুধার্ত আর উন্মত্ত মোঙ্গল বাহিনী তাদের নিষ্ঠুরতার চরম সীমা অতিক্রম করল। শেষ আব্বাসী খলিফাকে তারা বস্তাবন্দী করে তার উপর ঘোড়া চাপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করল। নির্বিচারে যাকে তাকে হত্যা করে রক্তের বন্যা বইয়ে দিল রূপকথার রহস্যনগরী বাগদাদে। কি শিশু, কি নারী, বয়োবৃদ্ধ, মসজিদ, হাসপাতাল কিছুই রক্ষা পায়নি হালাকুর গোগ্রাস থেকে। তিলোত্তমা নগরী পরিণত হল ভয়ানক ভুতুড়ে নগরীতে। ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এ গণহত্যা চলল টানা এক সপ্তাহ নাগাদ। নির্বোধ আর অপরিণামদর্শী মোঙ্গলদের হাতে ধ্বংস হল বিখ্যাত দারুল হিকমা এবং তারই সাথে নিঃশেষ হয়ে যায় শতবছর ধরে সঞ্চিত মানবজাতির জ্ঞানের প্রতিটি পাতা। কথিত আছে, রক্তের বন্যার সাথে ভস্মীভূত হওয়া বইয়ের পাতা বাঁধ সৃষ্টি করে দিয়েছিল বাগদাদের রাস্তায় রাস্তায়। দজলা নদী প্রবাহ করতে লাগল মনুষ্যরক্তের বিশুদ্ধ তরল। মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি আক্রোশের বলি হল গ্রন্থাগার, ধ্রুপদী স্থাপত্যিক সব নিদর্শন। আর কালের শ্রেষ্ঠ নগর শিকার হল নজিরবিহীন অত্যাচারের। ইবনে খালদুনের মতে, এ নারকীয় গণহত্যায় নিহত হয়েছে প্রায় ১৬ লক্ষ বাগদাদী। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, ২০ লক্ষ নগরবাসীর মধ্যে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ এই হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে গিয়েছিল শুধুমাত্র হালাকু খানের খ্রিষ্টান স্ত্রী ডোজুজ খাতুনের বদান্যতায়। এছাড়া কিছু মোসাহেব এ নির্দয় আক্রমণ থেকে বেঁচেবর্তে ফিরেছিল। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১৬ লক্ষ লোকের মৃত্যুবাণ ডেকে আনা পৃথিবীর জন্য এক করুণ অধ্যায়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাগদাদে নেমে আসে অপার্থিব নীরবতা। দেখে মনে হয়নি এটি ছিল একটি সমৃদ্ধ শহর আর মানুষের ভালবাসার বাগদাদ, আরব্যোপন্যাসের নগরী বাগদাদ!
মোঙ্গলদের পতন
নিরীহ নিরপরাধ মানুষের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে খ্যাতি অর্জন করা হালাকু খান শেষজীবনে অনুতপ্ত হয়েছিলেন ঠিক মৌর্য সাম্রাজ্যের সম্রাট অশোকের মত। কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাগদাদ ধ্বংসের আগমুহূর্তে যদি তার এই বোধোদয় হত তবে হয়তোবা রক্ষা পেত সভ্যতার সৌন্দর্য রাণী বাগদাদ এবং ১৬ লক্ষাধিক মানুষ!
হালাকু খানের বাইরে গিয়ে আমরা যদি পুরো মোঙ্গল জাতির বিচার করি তবে তাদের জন্য শুধুমাত্র ঘৃণার কুশপুত্তলিকা দাহ করারই প্রশ্ন আসবে। বর্বর এ গোষ্ঠীর মেকি দাম্ভিকতা বেঁচে থাকেনি শেষতক। বাগদাদ ধ্বংসের দুই বছর পর আইন-ই-জালুতের যুদ্ধে মিশরের মামলুকদের হাতে বাজেভাবে পরাজিত হয় পরাক্রমশালী মোঙ্গল বাহিনী। অস্ত্র ও ক্ষমতার হুক্কাহুয়া তখন থেকেই নিভে যায়, ইতিহাসের কালো পাতায় নাম লেখায় সময়ের শ্রেষ্ঠ বর্বর জাতিসত্তা মোঙ্গল!
তথ্যসূত্রঃ
১. মধ্যযুগের মুসলিম ইতিহাস -আশরাফ উদ্দিন আহমদ। পৃষ্ঠা ৪১-৬৫
২. https://www.thegreatcoursesdaily.com/the-mongol-sack-of-baghdad-in-1258/
৩. http://factsanddetails.com/world/cat58/sub385/item2375.html